আমাদের একমাত্র দুর্বলতা শৃঙ্খলায়

মাসকাওয়াথ আহসান
 | প্রকাশিত : ১২ জুলাই ২০২০, ১৮:০১

যে কোনো পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বদেশ যখন দুর্নামের মাঝে পড়ে; তখন সতত স্বদেশ সমালোচনাটিতে আমি অংশ নিতে চাই না। করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে ইতালির মতো দেশগুলো যে হেজিমোনি করার চেষ্টা করছে; তার মাঝে যৌক্তিকতা যতটা চোখে পড়ে; তার চেয়ে বেশি চোখে পড়ে "মাতবরি" করার চেষ্টা।

ইউরোপের দেশগুলোতে নাগরিক সমাজ সতত মানবিক ও উদারনৈতিক হলেও; বর্ণবৈষম্যের একটা মনোজগত সেখানে তো রয়েছেই। ইতালিতে করোনাভাইরাস ব্যবস্থাপনায় ধস নামে করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই। সে এমন এক অবস্থা; যখন বয়স বুঝে শুধু কমবয়েসী করোনা রোগীদের ভেন্টিলেটর দেয়া হয়েছে; সিনিয়ার সিটিজেনরা বিনা ভেন্টিলেটরে মারা গেছেন।

একবিংশ শতকে এর চেয়ে নৃশংস সিদ্ধান্ত আর কী হতে পারে! নৈতিকতার মানদণ্ডে এটা ইতালির সুষ্পষ্ট সিনিয়র সিটিজেন ক্লেনজিং। যে মানুষগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লন্ডভন্ড ইতালি পুনর্গঠন করেছে; খাদ্যের অভাবে মাটির নীচ থেকে আলু তুলে খেয়ে দেশ গড়ার কাজে অংশ নিয়েছে হাসিমুখে; সেই মানুষগুলো কর্মক্ষম নয় বলে; তাদের করোনাকালে মৃত্যুর হাতে তুলে দেয়া; বিনা চিকিতসায়; এমন সভ্যতা কী আমরা চেয়েছিলাম!

ইতালিতে তরুণ জনসংখ্যার হার কম বলে; বাংলাদেশের মতো দেশগুলো থেকে তরুণ শ্রমজীবীদের সেখানে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। ইতালির অর্থনীতিতে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের অভিবাসীদের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের শ্রমজীবীরা সেখানে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করে। ২০১৭ সালে ইতালিতে সরজমিন পর্যবেক্ষণ থেকে জানি, বাংলাদেশী শ্রমিকদের আন্তরিকতা আর হাসিমুখে কাজ করার গুণটিকে ইতালির মানুষেরা অত্যন্ত পছন্দ করেছেন।

আমার স্ত্রী বিভিন্ন দোকান-পাট ঘুরে এসে জানিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার ছেলেদের মধ্যে বাংলাদেশের ছেলেরা পণ্য বেচাকেনায় সবচেয়ে বিনয়ী ও সাবলীল। ইতালি নারীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি। তাদের নৈর্ব্যক্তিক পর্যবেক্ষণে ইতালিয় সমাজে বাংলাদেশের পুরুষদের আচরণ প্রশংসিত। তার মানে ইন্টিগ্রেশানে বা সমাজে আত্মীকরণে কোন অসুবিধা হয়নি বাংলাদেশের ছেলেদের। ভারতীয় ও পাকিস্তানিরাও পরিশ্রমী; কিন্তু তাদের আচরণে কিছুটা পুরুষবাদী মনোভাব ধরা পড়েছে ইতালীয়দের চোখে।

ইতালির তরুণ সাংবাদিক গল্পচ্ছলে বলেছিলো, রাতে রিপোর্ট লেখার কাজ শেষ করে যখন দেখি সিগেরেট ফুরিয়ে গেছে; আমি জানি বাংলাদেশি কোন সেলসম্যান ঠিকই জেগে আছে; সে হাসিমুখে দোকানের সাটার নামিয়ে এক প্যাকেট সিগেরেট দেয় আমাকে।

এই বাংলাদেশের ছেলেরা তাদের রেষ্টুরেন্টে খাবার পর দেশি ভাই বলে বিল পর্যন্ত নিতে চায় না (আমি অবশ্য ফ্রি লোডিং অপছন্দ করি; কারণ দেশ থেকে অনেক দূরে কঠোর পরিশ্রম করে দেশে রেমিটেন্স পাঠান তারা)। সেখানে অল্প কিছু বিপথগামী ছেলে আছে; যারা ইতালিয় মাফিয়াদের খপ্পরে পড়ে; মানব পাচার ও প্রতারণার মতো কিছু অপরাধ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশিদের সাকসেস স্টোরির পাশে তা একেবারেই অনুল্লেখযোগ্য একটি সংখ্যা।

কাজেই ইতালির একজন মন্ত্রী উত্তেজিত হয়ে বাংলাদেশের বিমানকে করোনা বোমা ভর্তি বলে কটাক্ষ করলে; তাতে ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। করোনা বোমা ইতালিতে যত জোরে বিস্ফোরিত হয়েছিলো; ও ঘটনা আর পৃথিবীর কোথাও ঘটেনি।

বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ জনশক্তি; জনবোঝা নয়। ইতালির প্রশাসন তা আমাদের চেয়েও বেশি জানে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে। কাজেই তাদের নিজেদের স্বার্থেই এদেরকে প্রয়োজন তাদের। ইতালির মন্ত্রীর মন্তব্যে প্যানিক করার কিছু নেই। ইতালির রাজনৈতিক নেতারাও মানুষ; তারাও আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মতো ওভার-রিএকশান দেখিয়ে ফেলেন। আর শেক্সপিয়ারের মার্চেন্ট অফ ভেনিসের দেশে অল্প কিছু হৃদয়হীন শাইলক থাকাটা অত্যাশ্চর্য্য কিছু নয়।

আমাদের একমাত্র দুর্বলতা শৃংখলায়। করোনাকালেও দলবেঁধে হুজ্জোতি করা; হাডুডু খেলা; কোথাও ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে স্রেফ 'বানর খেলা দেখা"-র সামাজিক বদভ্যাস; আমাদের আচরণগত দুর্বলতার জায়গা। করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে কী করতে হবে; সে সম্পর্কে অনেক প্রচার-প্রচারণা চলেছে। এসব সাবধানতা অবলম্বন না করে, কিছু হবেনা টাইপের যে ডোন্ট কেয়ার ভাব; ওটার আক্কেল সেলামি হিসেবে কিছু বাংলাদেশিকে করোনা-পজিটিভ হিসেবে ধরা পড়ে ইতালিসহ দু'একটি দেশ থেকে ফিরে আসতে হয়েছে। এই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আগামি ১৪ দিন কোয়ারিন্টিনে থেকে; আবার সবাই ফিরতে পারবেন যে যার গন্তব্যে।

লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক

ঢাকাটাইমস/১২জুলাই/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :