বন্ধু তুমি শত্রু তুমি!

মফিজুর রহমান পলাশ
 | প্রকাশিত : ১৩ জুলাই ২০২০, ০৭:৩১

আধুনিক শহুরে জীবনে বাসাবাড়ির কাজে সাহায্য করার জন্য গৃহকর্মী এক অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে নিউক্লিয়াস পরিবারের কর্মজীবী দম্পত্তির ঘরে রান্না-বান্না, কাপড় ধোয়া, ঘর গোছানোসহ অন্যান্য কাজ করাতে গৃহকর্মীর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কিন্তু গৃহকর্মী বাছাইয়ে ভুল হলে "খাল কেটে কুমির আনার" মতো বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে আপনার জীবনে, দিতে হতে পারে ভয়াবহ খেসারত--যেমনটি দিয়েছেন ডা. বিচিত্রা রাণী দে নামের একজন চিকিৎসক।

চলুন গল্পটা শুনে আসা যাক।

২০১৯ সালের আগস্ট মাস। ৩৩ তম বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে চাকরি পেয়েছেন ডা. বিচিত্রা। থাকেন পুরোন ঢাকার নাজিরা বাজারে। বিচিত্রা রাণীর স্বামী চাকরিজীবী হওয়ায় এবং বাসায় দুটো ছোট বাচ্চা সন্তান দেখভালের কেউ না থাকায় মরিয়া হয়ে তিনি গৃহকর্মী খুঁজছিলেন। কাজের লোকের যখন চরম সংকট, তখন ত্রাণকর্তা হয়ে আবির্ভূত হন কোহিনুর নামের এক নারী। বিচিত্রা রাণীর নাজিরা বাজারের বাসায় গৃহকর্মী আমেনাকে নিয়ে উপস্থিত হন কোহিনুর। যথারীতি কাজ শুরু করেন আমেনা। গৃহকত্রী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন!

কাজের প্রথম দিনেই অজানা অচেনা এই আমেনাকে তার দুই শিশুসহ বাসায় রেখে ডাক্তার মা চাকরি বাঁচানোর দায়ে হাসপাতালে চলে যান। বাসায় ফিরে এসে দেখেন আমেনা বাচ্চা দুটিকে ফেলে রেখে লকার ভেঙে প্রায় ২০ ভরি স্বর্ণসহ পালিয়ে গেছেন।

মধ্যবয়সী, পরনে মলিন পোশাক, আপাত নিরীহ চেহারার যে নারীকে ঘরে তুললেন গৃহস্থালির কাজ করার জন্য, তিনি যে ভয়ংকর এক চোর চক্রের সদস্য সেটা ঘুর্ণাক্ষরেও জানতে পারেননি এই চিকিৎসক বা তার স্বামী। কিন্তু মাঝখান দিয়ে চলে গেলো এতগুলো মূল্যবান স্বর্ণালংকার।

কেউ কেউ এখন ভাবতে পারেন, গৃহকর্মী নিয়োগ দেওয়া মানে তো খাল কেটে কুমির আনা কিন্তু সবক্ষেত্র এমনটা ঘটে না, যেটা এই চিকিৎসকের ক্ষেত্রে ঘটে গেলো। উপায়ান্তর না দেখে ডা. বিচিত্রা বংশাল থানায় একটি মামলা করেন। কিন্তু গৃহকর্মী সম্পর্কে তার কাছে কোন তথ্য ছিল না। থানা পুলিশের তৎপরতা সত্ত্বেও পরিচয়হীন চোরের সন্ধানে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব হয়নি।

এরপর, থানা থেকে মামলা যায় ডিবিতে। অবশেষে গৃহস্থালির কাজের লোক সেজে বাসায় দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনার রহস্য উম্মোচন করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নবগঠিত গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগ। গ্রেপ্তার করা হয় আমেনা, কোহিনুর ও মো. আবুল হাসেম নামের তিনজনকে। এদের গ্রেপ্তার করার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে পুরো একটি চক্রের পেছনের গল্প।

লালবাগ ডিবির কোতয়ালি জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. সাইফুর রহমান আজাদ জানান, দুর্ধর্ষ কাজের বুয়া আমেনা একজন পেশাদার চোর। এর আগেও সে একই রকমভাবে বিভিন্ন বাসায় কাজের বুয়া সেজে চুরি করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে কোহিনুর বাসা বাড়িতে গৃহকর্মী সরবরাহ করতেন ও মো. আবুল হাসেম একটি জুয়েলার্সের মালিক।

গোয়েন্দা এই কর্মকর্তা বলেছেন, থানা থেকে মামলাটি গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের কোতোয়ালি জোনাল টিমে হস্তান্তর হলে গোয়েন্দা বিভাগ প্রথমে চক্রের অন্যতম সদস্য কোহিনুরকে গ্রেপ্তার করেন। কোহিনুরের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দীর্ঘসময় আত্মগোপনে থাকা গৃহকর্মী ও স্বর্ণালংকার চুরির হোতা আমেনাকে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।

আমেনার দেয়া স্বীকারোক্তি মোতাবেক ঢাকার তাতিবাজারের মেসাস ফোরস্টার জুয়েলার্সের মালিক মো. আবুল হাসেমকে গ্রেপ্তার করা হয়। আমেনা জানান, তিনি চোরাই স্বর্ণালংকার আবুল হাসেমের কাছে এক লক্ষ ২৮ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। এদিকে দীর্ঘ এক বছর আগের ক্রয়কৃত চোরাই স্বর্ণ ইতোমধ্যে গলিয়ে চোরাই বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন ফোরস্টার এর মালিক হাসেম।

গৃহকর্মী সেজে বাসায় চুরির ঘটনা সম্পর্কে নবগঠিত গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. রাজীব আল মাসুদ জানান, এই প্রতারক চক্রের অন্যান্য চুরি সম্পর্কে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।

তিনি জানান, ইতোমধ্যেই আমেনাকে আদালতে সোপর্দ করা হলে চুরির সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

গৃহকর্মী নিয়োগ করার আগে তার সঠিক নাম, ঠিকানা, পরিচয়পত্র গুরুত্ব সহকারে যাচাই করে নিন। তার পরিচয়পত্র, ছবি, নাগরিক সনদ, পরিবারের সদস্যদের নাম-ঠিকানা-ফোন নম্বরসহ আনুষঙ্গিক প্রমাণক নিজের কাছে রেখে দিন। গৃহকর্মী নিয়োগের সময়ে প্রয়োজনে এক বা একাধিক স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির মতামত/রেফারেন্স নিন। মনে রাখবেন, আপনার অবর্তমানে আপনার সন্তান, ঘর, ঘরের মূল্যবান সামগ্রী গৃহকর্মীর জিম্মায় থাকবে। কষ্ট হলেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটু বাড়তি যত্নশীল হোন। সতর্কতা হিসেবে গৃহকর্মীকে মূল্যবান সামগ্রী ও নগদ টাকা রাখার জায়গা সম্পর্কে অন্ধকারে রাখুন। প্রয়োজনে বাসায় নগদ টাকা রাখবেন না। গৃহকর্মীকে বোঝান আপনি বাসায় নগদ টাকা রাখেন না, যা প্রয়োজন এটিএম বুথ থেকে তুলে খরচ করেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সর্বদা আপনার সাথেই আছেন।

লেখক: সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি)

মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশনস ডিভিশন

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :