ফেসবুক: বন্ধুতালিকায় কাকে রাখবেন, কাকে নয়!

অরুণ কুমার বিশ্বাস
 | প্রকাশিত : ১৩ জুলাই ২০২০, ১৫:৫৮

মার্ক জাকারবার্গের জাদুযন্ত্র ফেসবুক বর্তমান সময়ের সবচে দরকারি না হোক, অনুপেক্ষণীয় একটি বিষয়। এর বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। নিজেকে জাহির করা থেকে শুরু করে প্রিয়জনের সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা, আন্তঃযোগাযোগ, ব্যবসাপাতি, এমন কি, প্রতারণারও এক জবরদস্ত হাতিয়ার এই ফেসবুক। সুবিধা এই, এজন্য আপনাকে তেমন কোনো পয়সাপাতি খরচা করতে হয় না, শুধু অল্পকিছু এমবি থাকলেই হয়।

আসুন সবার আগে দেখে নিই, ফেসবুকে আমরা সচরাচর কী কী কাজ বা অকাজ করে থাকি। কাজের কথা বললে অবশ্যই ভারচুয়াল যোগাযোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পুরনোকে খুঁজে ফেরারও একটি মোক্ষম যন্ত্র এই ফেসবুক। ফেসবুকের মাধ্যমে অনেকেই অনেকের হারানো দিনের স্মৃতি থেকে শুরু করে তার সবচে প্রিয় বন্ধুটিকে খুঁজে পেয়েছেন। ভৌগোলিক সীমারেখা অতিক্রম করে সারা বিশে^র প্রান্ত সীমায় রয়েছে এর সার্চ অপশন্স। দখিনা দুয়ারের মতো ওটা মেলে দিয়ে আপনি পেতে পারেন প্রিয়জনের পেলব ছোঁয়া। উঁহু, ঠিক স্পর্শ নয়, তবে তার ছবি দেখা ও মনোলোভা কণ্ঠস্বর আপনি বিলক্ষণ শুনতে পারেন।

ইচ্ছে করেই মিস্টার বার্গ (আমার ছেলে বলে বারগার) ফেসবুকের বন্ধুসংখ্যা পাঁচ হাজারে সীমিত রেখেছেন। মুফতে আর কতই বা দেবে বলুন। তবে মুরিদ বা ফলোয়ারের সংখ্যা যত ইচ্ছে রাখুন, কুছ পরোয়া নেহি। কাকে আপনি বন্ধু বানাবেন, আর কাকে নয় এ ব্যাপারে ভেবেছেন কখনও! না ভেবে থাকলে বুঝতে হবে আপনি মানুষ হিসেবে বেহিসাবি শুধু নন, বেকুবও। ছোট্ট এই জীবনে একটুখানি হিসাবপাতি করে রাখা ভালো। জীবনটা খোলামকুচি নয় যে তাকে যথেচ্ছ খরচ করবেন। কেউ কেউ আছেন যারা কিনা বন্ধু নির্বাচনে বড্ড উদার। তারা বিপাকে পড়েন বেশি, কেননা, সমাজে একরকম শৃঙ্খলা রয়েছে, অথচ তারা তা বুঝতে চান না বা পারেন না। যাকে তাকে বন্ধুতালিকায় স্থান দেন, যার ফলে নানান রকম অনাকাক্সিক্ষত ঝামেলায় পড়েন। অর্থাৎ শ্রেণি বা স্তর মেনে চলা ভালো।

আমার মতে, চিন্তা-চেতনায় ধ্যান-ধারণায় আপনার সমগোত্রীয় মানুষ এই তালিকায় অগ্রাধিকার পাবেন। কারণ তারা আপনাকে জানেন, চেনেন এবং বুঝতে পারেন। তাদের রুচিবোধ এবং বৈদগ্ধ্য আপনাকে সমৃদ্ধ করে। আর যদি আপনি বিজাতীয় মানুষজনকে এখানে রাখেন তাহলে দেখবেন প্রায়শ তারা আপনাকে প্রীতির বদলে পীড়িত করে। তারা খালি গায়ে ছবি তোলে, হেঁড়ে গলায় গান গায়, কুরুচিপূর্ণ ভিডিও আপলোড করে, স্থ’ূল ডার্টি জোকস শোনায়, যখন তখন ভিডিও কল দেয় (কারণ তাতে পয়সা লাগে না), অথচ আপনি হয়তো তখন জরুরি কোনো সভায় ব্যস্ত রয়েছেন।

বার্গসাহেবের ফেসবুকের কারণে দেশে দেশে মিথ্যুকের খুব ছড়াছড়ি। কেউ কেউ আবার লিঙ্গান্তর ঘটিয়ে মেয়ে হলে নিজেকে ছেলে, আর ছেলে হলে মেয়ে পরিচয় দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলছে। প্রোফাইলে ভুরি ভুরি মিথ্যা তথ্যসম্বলিত খেরোখাতা দিয়ে রেখেছে। অযাচিত (এবং তালাবদ্ধ) ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে আপনাকে আবার মেসেঞ্জারে নক দিয়ে রাখছে যাতে আপনি তাকে সাদরে কোলে তুলে নেন। অথচ এটা ‘প্রকৃতির ডাক’ নয় যে ডাকলেই আপনাকে তা শুনতে হবে। অর্থাৎ বন্ধু নির্বাচনে আপনাকে অতি অবশ্যই বিবেচক হতে হবে, নইলে আপনি আপৎকালে বিপদে পড়তে পারেন।

লাইক-কমেন্টের একটা বিষয় এখানে প্রসঙ্গত এসে যায়। ব্যাপারটা পুরোপুরি মিউচুয়াল। লাইক-প্রীতি থাকলে আপনাকে রাত জেগে হলেও অন্যের পোস্টে এসব দিতে হবে। অর্থাৎ বেকার বেবুঝ লোকের পক্ষে এটা যায় ভালো। ইদানীং একটা ব্যাপার খুব হচ্ছে, অকারণ আপনার ইনবক্সে ভিডিও পাঠানো হয়, যে ব্যাপারে আপনার আদৌ কোনো আগ্রহ নেই। কেউ কেউ আবার নিজেকে জাহির করতে গিয়ে বউ-শালি-সম্বন্ধী চোদ্দগোষ্ঠীর হালহকিকত তুলে দেয় ফেবুর পাতায়। লাশের পাশে, নদীর ধারে, আগুনের সাথে সেলফি ছাড়াও বিশিষ্টদের সাথে ছবি তুলে তাতে চটকদার কমেন্টসমেত আপনাকে ট্যাগ করবে, যেন ভোগে নয় ‘ট্যাগে’ই তাদের প্রকৃত সুখ নিহিত। অথচ তারা জানে না যে, বিশেষ কারো সাথে ছবি তুললেই বিশিষ্ট হওয়া যায় না, তাতে বরং নিজেরই দেউলিয়াত্ব প্রমাণিত হয়।

প্রোফাইল পিকচার দেখেই আমি মূলত তার রুচিবোধ সম্পর্কে ধারণা পেয়ে যাই। তখনই ঠিক করি বেচারা অনুরোধকারীকে ঠিক কতদিন ঝুলিয়ে রাখবো, বা ডিলিট অপশন্সের সঠিক ব্যবহার করবো কিনা। যাকে তাকে নিজের সঙ্গে জুড়ে নেয়াটা আর যাই হোক, সুবুদ্ধির পরিচয় নয়। কথায় বলে, দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো।

নির্বোধ ও অতি বুদ্ধিমান- এই দুই শ্রেণির মানুষকে আপনি সযত্নে পরিহার করতে পারেন। ওরা আপনার ফরসা জীবন ধুয়ে ময়লা করে দেবে। ব্যবসায়ী রাখা যেতে পারে, তবে যারা হামেশাই তার পণ্যের ভিডিওসমেত বিজ্ঞাপন পাঠায় আর ক্রয়আব্দার করে তারা নিঃসন্দেহে পরিত্যাজ্য। গায়েপড়া লোক আমার মোটেও পছন্দ নয়। এরা মাঝরাত্তিরে দেখবেন জানতে চাইবে, ‘ভাইয়া, কেমন আছেন! রাতে খেয়েছেন তো’! কাছে পেলে নির্ঘাত তাদের উপর চামড়ার চটির সদ্ব্যবহার করতাম। আমার শিক্ষক মা বলতেন, গোমূর্খের চেয়ে চোর-চোট্টা হওয়া ভালো। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি মা আসলে কী বলতে চেয়েছেন।

বিরোধীদল টাইপ কিছু মানুষ আছে, এরা সবতাতেই তর্ক জুড়বে। বিতর্ক করতে শেখেনি, তবে ঝগড়াটা বেশ জানে। পড়ালেখা নাই, তাই অকারণ কূটতর্ক করে। বেকার, তার হাতে অঢেল সময়, তাই সে মনে করে তার মতো অন্যেরাও বেকার। আপনাকে অনলাইনে দেখলেই তারা অকারণ প্যাঁচাল পাড়ে। আবার ছাইভষ্ম কিছু পোস্ট করে আপনি তাতে লাইন দেননি কেন, তার কৈফিয়তও চায় এসব নির্বোধ গর্দভরা।

প্রতারণার কথা কিছু বলি। কিছু লোক আছে এরা যদি বুঝতে পারে আপনার মনটা বেশ নরম, সপসপে, অমনি ইনিয়ে বিনিয়ে বলবে, ভাই, কিছু সাহায্য চাই, দিন মোটে চলছে না। আমি বলছি না চেনা-পরিচিত বন্ধুবান্ধবকে অপনি অর্থসাহায্য করবেন না। অবশ্যই করবেন। তবে আপনি টাকা চাইবার মতো ঘনিষ্ঠ কিনা, এটুকু বিচার-বিবেচনা তো তার থাকতে হবে। সবাই খারাপ তাও বলছি না, তবে এক শ্রেণির প্রতারক হামেশাই এমন করে থাকে। বোকা বা সহজ-সরল বুঝে ওরা কৌশলে আপনার গাঁট কাটবে। মাধ্যম-ফেসবুক।

আবার কিছু আছে দেখবেন মাস্টার্স পাস, কিন্ত বোধের বালাই নাই। সূক্ষ্ম রসবোধও নেই তাদের। আপনি চলমান পরিস্থিতি নিয়ে কিছু একটা পোস্ট করলেন, তার গূঢ়ার্থ না বুঝেই অমনি আপনাকে চ্যালেঞ্জ করে বসলো। নিজেকে মহাজ্ঞানী প্রমাণের জন্য যা নয় তাই উল্টোপাল্টা যুক্তি দেখিয়ে আপনাকে ঘায়েল করতে চাইছে। এদের এগেনস্টে সোজা থানায় জিডি করবেন, নইলে উল্টো আপনি নিজেই ফেঁসে যাবেন।

প্রচারপ্রিয় মানুষ, নিজেকে সে জানান দিতে চায়। জনারণ্যে নাম ছড়াতে চায়। নিজের পরিচিতি কে না চায় বলুন! তাই বলে সারা গায়ে রঙ মেয়ে উল্টোপাল্টা ছবি পোস্ট করবেন? বউ বা আপনার হাবিকে জড়িয়ে ধরে সপাটে চুমু খাবেন, আবার তার ছবি ফেসবুকে পোস্ট করবেন, এ কেমন বেলেল্লাপনা! স্লিভলেস সাথে ফিনফিনে শিফন পরে খুল্লাম-খুল্লা টাইপ ছবিও শেয়ার করতে হবে! কালো টাকায় বিদেশ গিয়ে কলগার্লের সঙ্গে সুইমিং পুলে জলকেলি খেলেছেন, তার ছবিও আপনাকে দিতে হবে! এতটা রুচির প্রাদুর্ভাব আপনার হয় কী করে!

হালে আমার কিছু স্বগোত্রীয় বন্ধুকেও দেখেছি এহেন অরুচিকর কাজকারবার করতে। তার মানে দেশব্যাপাী রুচির খুব হাহাকার চলছে এখন। তাই ভাবছি এবার একটা ‘কালিং অপারেশন’ চালাতে হবে, বন্ধু-নির্ঘণ্ট থেকে ছেঁটে কিছু অর্বুদ বা টিউমার বাদ দিতে হবে। আমি সরকারি চাকুরে, তাই আমাকে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। অথচ আমার কিছু বন্ধুর সেই মাত্রাজ্ঞান নেই, তারা অহেতুক আমাকে আক্রমণ করে। কেন কোনো বিষয়ে আমি প্রতিবাদ করিনি তারও জবাব চায় তারা। আরে ভায়া, টিকে থাকতে গেলে তোমাকে সেলফ-সেন্সরশিপ মেনে চলতে হবে। নইলে তুমি নিজেও একদিন বেপাত্তা হয়ে যাবে। মুখে এলেই সবটা বলতে নেই, মন চাইলেই তা করতে নেই। ইন্দ্রিয়কে বশে আনো, জিতেন্দ্রিয় হও।

সবশেষে বলি, অ্যা ম্যান ইজ নোন বাই দ্য কোম্পানি হি কিপস। যাকে তাকে বন্ধুতালিকায় রাখবেন না। তাতে লোকে আপনাকে ভুল বুঝবে, এক পাল্লায় পরিমাপ করবে। এটা মোটেও অহংকারের কথা নয়, প্রকৃতির নিয়ম। বাঘে-মহিষে-ঘোড়ায় একসাথে চলে ফেরে এটা কখনও দেখা যায় না। শুধু লাইক আর কমেন্টের ধান্ধায় ফেসবুক চালানো থেকে বিরত থাকুন, তাতে আপনার ওয়েট মানে ওজন বাড়বে। জানেন তো, হাজারো বিলাইয়ের মিউ একলা বাঘের একখানা হুংকারের কাছে স্রেফ নস্যি। এবার আপনিই ঠিক করুন, কাদেরকে সঙ্গে রাখবেন- বাঘ না বিলাই! অবশ্য দুএকটা বিল্লি আপনি রাখতেই পারেন। ঘরে দুধ বেশি হলে একটুখানি খাইয়ে দেবেন। তাতে দুধের সদ্ব্যবহার হবে, আবার বিলাইও খুশি। দোষেগুণে মানুষ, জানেন তো! এক্কেবারে সব ঝেটিয়ে বিদায় করলে দিনশেষে আপনি একা হয়ে পড়বেন যে!

লেখক: কথাসাহিত্যিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :