জীবন কেন এমন...

হিমেল আশরাফ
 | প্রকাশিত : ১৪ জুলাই ২০২০, ১০:২৮

ভদ্র লোকের নাম ছিল নোমান রহমান। বয়স ৪৬। তার ফুটফুটে একটা মেয়ে, বয়স ৪ ছেলেটার বয়স ৯। মেয়েটা বেশি বাপ নেওটা ছিল, নোমান সাহেব ঘরে আসলেই ছুটে আসতো বাবার কোলে। নিউয়র্কে অনেক খরচ, নোমান ইয়েলো ক্যাব চালায়।

আগে দিনে ১২ ঘন্টা কাজ করতো, মেয়েটা একটু বড় হওয়ার পর ৮ ঘন্টার বেশি কাজ করতে পারে না। মেয়ের জন্য মন পুরে, কখন ঘরে যাবে মেয়েটাকে কোলে নিয়ে ঘ্রান নিবে। তার উপর তার বুকে ছাড়া মেয়ে এখন ঘুমায় না, মেয়ের মা নিপা এইটা নিয়ে খুব বিরক্ত।

নোমানের করোনা হলো, নিউয়র্কের হাসপাতালে তখন জায়গা নাই। নোমানকে বলা হল আপনারতো ইর্মাজেন্সি কোনো সমস্যা নেই আপনি বাসাতেই থাকেন। নোমান বাসায় থাকলো। দিন দিন নোমানের অবস্থা খারাপ হতে লাগলো। সে একা একটা রুমে থাকে, পাশের ঘরে নিপা ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকে।

সারাদিন মেয়ে বাবার রুমের দরজায় ডাকে আর বলে, বাবা বাইলে আচো, বাবা বাইলে আচো।বাবা আমাকে কোলে লাও। কাদতে কাদতে দরজায়ই ঘুমিয়ে পরে মেয়েটা। নোমান দরজার ওপারে দরজা ঘেষে বসে থাকে। দরজার নিচ দিয়ে মেয়ের তুলতুলে পা দেখে, ছোট ছোট আঙুল। নোমানের বড় ইচ্ছা করে হাত বাড়িয়ে পাগুলো ছুয়ে দেখতে। ছোঁয়া হয় না।

একরাতে নোমানের খুব শ্বাস কষ্ট শুরু হলো।

নোমার রুম থেকে চিৎকার করে বার বার বলল নিপা আমার কেমন যেন লাগছে,ডাক্তার ডাকো, আর শুনো আমার কিছু হয়ে গেলে তুমি আবার বিয়ে করিও কিন্তু আমার বাচ্চাদুটোরে কষ্ট দিও না। ধরা গলায় নিপা বলে তুমি চুপ করো। ৯১১ এ কল দেয় নিপা। নোমান শ্বাস নিতে পারে না।

নোমানের ডাকে মেয়েটার ঘুম ভেঙে গেছে। দরজার কাছে বলে বাবা দলজা খুল। বাবা দলজা খুল। সব সময় চুপচাপ থাকা ছেলেটা দেয়ালে কান পেতে বলে বাবা তোমার কি অনেক কষ্ট হচ্ছে? নোমান বলে না বাবা, আমি ভাল আছি। তোমরা ঘুমাও। নোমান মুখে বালিশ চাপা দেয়, তার আর্তনাদ সে তার সন্তানকে শোনাতে চায় না। একসময় আর কোন শব্দ নেই। নোমানের ঘরে সব নিস্তব্দ। নীপা চেষ্টা করে দরজা খোলার, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।

ডাক্তার আসে ভোর ৫ টায়। দরজা ভাঙে। রুম থেকে নিপাকে বলে আপনার স্বামী মারা গেছেন। লাশ নেয়ার ডিপার্টমেন্ট আলাদা। আমরা তাদের বলে দিচ্ছি। তারা এসে লাশ নিয়ে যাবে। দরজা বন্ধ করে চলে যায় ডাক্তার। নিপা বসে থাকে, নিথর। পাশে মেয়ে আর ছেলে কি বুঝে যেন কোন কথা বলে না। সময় যায়, ঘন্টা যায়, ৭ টা ৮ টা ৯ টা ১০টা কেউ আসে না।

নিপা পাশের ঘরে প্রিয় মানুষটার লাশ নিয়ে অপেক্ষায় আছে লাশবাহী গাড়ীর। ১১ টায় ৩ জন লোক আসে। জানায় তাদের গাড়ীর অনেক স্বল্পতা। তারা লাশটা একটা ব্যাগে ভরে রুমেই রেখে যাবে। লাশবাহী গাড়ী এভেইল এ্যাভেল হলে তারা লাশ নিয়ে যাবে। লাশটা একটা ব্যাগে আটকে দরজায় নো এন্ট্রি সাইন ঝুলিয়ে চলে যায়। নিপার আজ অনেক কথা মনে পরে, মনে পরে তার নোমান যেদিন প্রথম তাদের বাসায় দেখতে এসেছিল সেদিনের কথা।

বয়সে অনেক বড় আর কালো নোমানকে তার পছন্দ ছিল না একটুও। কিন্তু আমেরিকার আসার লোভেই হয়তো নিপা সেদিন কবুল বলে ছিল। কিন্তু এদেশে এসে দেখে কালো চামড়ার নোমানের ভেতরের মনটা অনেক সাদা। এত সহজ সরল মানুষটা। নোমানের সবটুকু ভালবাসা দিয়ে তাকে সুখি করেছিল, করতে চাইত অন্তত।

কখন কবে যে নোমানকে ঘিরেই তার জীবনটা গড়ে উঠে ছিল নিজেও টের পায় নি। আচ্ছা সাদা মানুষ মরে গেলে নাকি নীল হয়, কালো মানুষ মরে গেলে কেমন হয়? আহা নীপা জানতেও পারবে না তার ভালোবাসার মানুষটা মরে যেয়ে কেমন হয়েছিল।

মেয়েটা কাদে। দরজার যেয়ে বলে বাবা তুমি গুমাও? বাবা উটো, বাবা... ছেলেটা বুঝে গেছে বাবা মারা গেছে। সে বাবার দেয়ার ক্রিকেট ব্যাটটা হাতে নিয়ে জানালা দিয়ে দূরে তাকিয়ে। তার চোখে পানি নেই। সে কাদছে না। তার কান্না যেন কোথায় আটকে গেছে। ওর বার বার মনে হয় বাবা ছাড়া পৃথিবীটা আগের মতো না কেন? বাবাতো এখনো ঘরে তবু কেন সব উলট পালট লাগে। বাবা ছাড়া পৃথিবীটা ও মা কে নিয়ে কেমন করে থাকবে...ওর বোনটা...

বিকেল ৩টায় লাশবাহী গাড়ি আসে। নিপার সামনে দিয়ে লাশের ব্যাগটা নিয়ে চলে যায়। নিপার বড্ড ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে করে লাশটা। ওরা ছুয়ে দেখতে দেয় না। নিপা বলে মুখটা একটু দেখা যাবে, দূর থেকে, প্লিজ। ছোব না বিশ্বাস করুন। একটু। ব্যাগ খোলা যাবে না। যায় না।

বুকের মধ্যে পাথর হয়ে চেপে থাকা কান্না ছিটকে বের হয়ে আসে। নিউয়র্কের আকাশ আরো নীল হয়, পাখিরা থেমে যায়, মেঘ ছুটে চলে না, ঝরা পাতা ভেসে বেড়ায় না...

লাশের ব্যাগটা নিয়ে যাবার পর মেয়েটা হাসি মাখা মুখে বাবার রুমে ঢোকে, বাবা বাবা টুক, বাবা বাবা টুক, বাবা বাবা টুক, আমি একানে, বাবা আমি একানে... বাবা... বাবা...

লেখক: নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা

ঢাকাটাইমস/১৪জুলাই/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :