কাজের আগে ‘মিষ্টভাষী’ কাজ ফুরালে ‘ভয়ংকর’ আরিফ

প্রকাশ | ১৪ জুলাই ২০২০, ১৯:২৯ | আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২০, ২০:৩৮

শেখ সাইফ, ঢাকাটাইমস

যে কোনো কাজ আদায়ের আগে ভোলাতেন মিষ্টি কথায়। কাজ হাসিল হয়ে গেলে রূপ ধারন করতেন ভয়ংকর। তিনি হলেন কথিত স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান জেকেজির প্রধান নির্বাহী আরিফুল হক চৌধুরী। করোনা পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতি প্রতারণা করে তিনি এখন কারাগারে।

আরিফের মালিকানাধীন ওভাল গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথকেয়ারের করোনা প্রকল্পের কাজে অংশ নেওয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নানা কাজ করিয়ে বাকি রেখেছেন লাখ লাখ টাকার বিল। তার কাছে চারটি প্রতিষ্ঠানের অর্ধ কোটির বেশি টাকা পাওনা রয়েছে বলে তথ্য উঠে এসেছে।

পাওনা টাকা চাইতে গেলে তিনি পাওনাদারদের না চেনার ভান করতেন। বারংবার তাগাদা দিলে তার কর্মীদেরকে পাওনাদারের নির্যাতনের নির্দেশ দিতেন। জেকেজির কথিত করোনা পরীক্ষা চলাকারীন এক পাওনাদার বকেয়া টাকা চাইতে গেলে তাকে নির্যাতন করতে কর্মীদের নির্দেশনা দেন আরিফ চৌধুরী।

কর্মীকে ফোনে আরিফ চৌধুরী বলেন, ‘এই সাজেশন আমার দেওয়া লাগে? অফিসার আলফা, সিকিউরিটি নিয়ে ঘাড়টা ধরে বাইর করে দেন ক্যাম্প থেকে এবং এগুলো নিয়ে পাড়ান। সিকিউরিটি নিয়ে একটা রুম করেন তো। পানিশমেন্ট রুম করেন ক্যাম্পের ভিতরে। যারা কথাবার্তা শুনবে না সেগুলোরে নিয়ে বাইড়ানো হবে। পরে আমি যা দেখার দেখব।’

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আরিফ চৌধুরী এভাবেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে কাজ করিয়ে লোপাট করেছেন কোটি টাকা। কিন্তু যাদের সহযোগিতায় প্রকল্প নামিয়েছেন তাদের লাখ লাখ টাকার বিল বাকি রেখেছেন।

রাজ ক্রিয়েশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করোনার বুথ তৈরিসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি করেন তিনি। পরে প্রতিষ্ঠানটির চব্বিশ লাখ টাকা আর দেননি।

টাকার জন্য সোহাগ আরিফ চৌধুরীকে ফোন দিলে তিনি আরও একটি বড় কাজের কথা বলে ফোন রেখে দেন।

ওই ফোনালাপে শোনা যায়─

─আস সালামু আলাইকুম, ভাই ভালো আছেন?

─হ্যাঁ, ভালো। সোহাগ, আপনি রেডি থাকবেন তো। ইমার্জেন্সি কাজ আছে, করোনা নিয়ে। আপনাকে আমি দুই এক দিনের ভিতর কল দেব। খুব বড় কাজ। পুরো বাংলাদেশ ব্যাপী।’

কাজ করিয়ে নিয়ে পরে আরিফুল তার জাত চিনিয়েছেন আরেক ফোনালাপে। পাওনা টাকার জন্য সোহাগ আবার ফোন করলে আরিফ যেন তাকে চিনতেই পারছেন না!

সোহাগ─হ্যালো

আরিফ─জী বলুন। কাকে ফোন করছেন।

সোহাগ─জী আরিফ ভাই আমি সোহাগ বলছি।

আরিফ─কোন সোহাগ?

সোহাগ─আপনার যে করোনার কাজ করলাম... সোহাগ বলছিলাম রাজ ক্রিয়েশন থেকে।

রাজ ক্রিয়েশনের সোহাগের ভাষ্য, ‘আমি যখন কাজের ভেতর তার কাছে (আরিফ) টাকা চাইলাম, যে ভাই বিশ ত্রিশ হাজার করে টাকা দিচ্ছেন। এভাবে এগুতে পারছি না। অনেক মালামাল কিনতে হয়।’

‘আরিফ তখন বলেন, ভাই এটা সাড়ে পাঁচশ কোটি টাকার কাজ। এটা প্রধানমন্ত্রীর কাজ। আপনার টাকার সমস্যা নেই। আপনি কাজ করেন। ঈদের সময়, রোজার ঈদের চার পাঁচদিন আগে ফোন দিলে। উনি ফোন ধরার পরে আমাকে চেনেই না।’

জেকেজি বিভিন্ন নিরাপত্তার যন্ত্রাদি যে প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিয়েছে তাদেরও পাওনা রয়েছে ছয় লাখ টাকার বেশি। টাকা চেয়ে শুনতে হয়েছে আরিফের অকথ্য ভাষণ।

অ্যাকটিভ সল্যুশন নামের ওই আইটি প্রতিষ্ঠানটির সিইও মাহদি হাসান বলেন, ‘আমি ও আমার ম্যানেজার অ্যাসিস্ট্যান্ট দুজনেই গিয়েছিলাম। যাওয়ার পর দেখছিলাম। আরিফ চৌধুরী একটা প্রোগ্রাম করছে। তখন আমাকে বলল আপনি কে? কেন আসছেন এখানে?’

‘আমি তখন বললাম আমি অ্যাকটিভ সল্যুশন থেকে এসেছি। আপনাদের লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়েছি। আমরা পেমেন্ট নেওয়ার জন্য এসেছি। তখন তিনি (আরিফ) বলেন ‘আই সে গেট আউট। আপনি এখনই বের হয়ে যান। আপনাকে এখানে আসতে কে বলছে? আপনি নিচে যান নিচে ওয়েট করেন। আপনি আমার অফিসে আমার কাছে কেন আসছেন? কোন সাহসে আসছেন। উনি যা তা শাউট করা শুরু করলেন।’

এই ঘটনায় আরিফুল হক চৌধুরীসহ চারজনকে আসামী করে পঁচিশ জুন প্রতারণার মামলাও করে অ্যাকটিভ সিকিউরিটিস অ্যান্ড আইটি সলিউশন্স।

এখানেই শেষ নয় আরিফের প্রতারণা। এভাবে করোনা বুথ তৈরি করতে সাউন্ড, লাইট সর্বরাহ করা প্রতিষ্ঠানের পাওনা বাইশ লাখ টাকাও দেননি তিনি। এছাড়া ল্যাপটপ সরবরাহ করা একটি প্রতিষ্ঠান পাওনা রয়েছে ছয় লাখ টাকা।

প্রসঙ্গত, জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার সংক্ষেপে জেকেজির বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে বুকিং বিডি ও হেলথকেয়ার নামে দুটি সাইটের মাধ্যমে টাকা নিচ্ছিল এবং নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া সনদ দিত।

রাজধানীর কল্যাণপুরের একটি বাড়ির কেয়ারটেকারের এমন অভিযোগের সত্যতা পেয়ে গত ২২ জুন জেকেজি হেলথকেয়ারের সাবেক গ্রাফিক ডিজাইনার হুমায়ুন কবীর হিরু ও তার স্ত্রী তানজীন পাটোয়ারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এরপরে জেকেজির সিইও আরিফুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। সবশেষ সোমবার আরিফের চতুর্থ স্ত্রী জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের বরখাস্ত চিকিৎসক ও জেকেজির চেয়ারম্যান সাবরিনা আরিফ চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

(ঢাকাটাইমস/১৪জুলাই/ডিএম)