করোনা ও গ্রামীণ অর্থনীতির সম্ভাবনা

মোহাম্মদ পারভেজ
 | প্রকাশিত : ১৫ জুলাই ২০২০, ১১:৫৬

ইংলিশ কবি Percy Bysshe Shelley (১৭৯২-১৮২২) তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা ‘Ode to the West Wind’-এ G West Wind-কে (আমাদের দেশে আমরা কালবৈশাখী ঝড় উল্লেখ করতে পারি) একই সঙ্গে ‘Destroyer and Preserver’ বলে সম্বোধন করেছেন। অর্থাৎ ঝড়ে গাছের ফল ঝরে পড়া কিংবা পুরো গাছটাই ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে Preserve রূপে দেখানো হয়েছে। আবার ঝরে পড়া ফল থেকে বীজ তৈরি হয়ে নতুন গাছ জন্মে প্রকৃতি আবার নতুনরূপে সজ্জিত হওয়ার ক্ষেত্রে West Wind- Preserver রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।

Wild Spirit, which are moving everywhere;

Destroyer and preserver; hear, oh hear!

বাংলাদেশে করোনা থাবার প্রায় ১২২তম দিন অতিবাহিত হয়েছে। এরই মধ্যে সমাজ তথা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা অর্থনৈতিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে; যা দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা সূচকে আঘাত হানবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার এ থাবা হয়তো আগামী কয়েক মাস কিংবা বছরও চলমান থাকতে পারে।

সম্প্রতি পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, ছোট-বড় অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রমিক-কর্মচারী চাকরিচ্যুত হচ্ছেন। এছাড়া ফুটপাত, বিভিন্ন অলি-গলিতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ বড় বড় হোটেল-মোটেল কিংবা রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরাও গণহারে চাকরি হারাচ্ছেন। চলমান বাস্তবতায় তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা ছাড়া দ্রুত সময়ে তাদের দুর্ভাগ্যের চাকাকে সৌভাগ্যে রূপান্তর করার মতো বাস্তবতা হয়তো স্বয়ং সরকারেরও নেই।

কিন্তু লক্ষ্ করার বিষয় হলো, রাজধানী কিংবা বিভিন্ন বড় শহর থেকে চাকরি হারানো এসব অসহায় লোকজনের মধ্যে বেশির ভাগই তল্পিতল্পাসহ নিজ নিজ গ্রামের দিকে ধাবিত হচ্ছে। চাকরিচ্যুত এসব মানুষের মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিত শ্রমিক, দিনমজুর, তাঁতি, রিকশাচালক, হকার ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছে। আবার রাজধানী ত্যাগ করা এসব মানুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ রয়েছে যারা বিভিন্ন পাবলিক কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষিত যুবক, যাদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা।

সার্বিক পরিস্থিতি হতাশাব্যঞ্জক ও নিরাশাজনক হলেও আমাদের নীতিনির্ধারক মহল কর্তৃক এর মধ্য থেকেই অপেক্ষাকৃত ভালো কিছু খুঁজে বের করতে হবে। কারণ এরূপ পরিস্থিতিতে একটা সঠিক সিদ্ধান্তই পারে আমাদের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে সমুজ্জ্বল করতে।

আমরা জানি যে, দেশের সিংহভাগ উন্নয়নই বড় বড় শহর বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। ফলে রাজধানীতে জীবিকার সন্ধানসহ নানা আধুনিক সুযোগ-সুবিধার সুফল ভোগ করতে এসে খোদ রাজধানীটাই আজ অধিক জনসংখ্যার চাপে ভারী হয়ে গেছে এবং বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে আছে। ফলে সরকারের পরিকল্পিত নগরী গড়ার বেশির ভাগ পরিকল্পনাই ভেস্তে যাচ্ছে।

সংকটময় বর্তমান বাস্তবতায় সরকার গ্রামের দিকে প্রবহমান জনসাধারণকে গ্রামেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুপরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারলে অসহায় মানুষের দুর্ভোগ কাটানোর পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতিটাও ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হবে। একই সাথে দেশের অধিকাংশ মানুষ শহরকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে।

আবার কৃষিতে ৮০ শতাংশের ওপর নির্ভরশীল জনগণের দেশে শিক্ষিত মানুষ যদি কৃষিখাতের উন্নয়নে এগিয়ে আসে, তাহলে দেশে কৃষিজ পণ্যের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অতিরিক্ত অংশ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব।

এ ক্ষেত্রে, কিছু সুপারিশ বিবেচনা করা যেতে পারে।

০১. গ্রামের শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত যুবসমাজকে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর কিংবা সমবায় অধিদপ্তরের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরির জন্য বিনা ফিতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। হতে পারে সেটা হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন, মৎস্য চাষ, গ্রামীণ বিভিন্ন ফল-ফলাদি চাষের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি; যেটা অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে;

০২. প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা;

০৩. সরকারি উদ্যোগে গ্রামে গ্রামে সমবায় তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ করা;

০৪. বেসরকারি বিভিন্ন এনজিওকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাতে হবে;

০৫. উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে সম্ভাব্য বাধাগুলো দূর করার ব্যবস্থা করা। যেমন: স্থানীয় চাঁদাবাজদের লাগাম টেনে ধরা;

০৬. সরকারিভাবে কৃষক থেকে সরাসরি পণ্য কেনার ব্যবস্থা করা যেন মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানো সম্ভব হয়;

০৭. গ্রামের সঙ্গে শহরের যাতায়াত ব্যবস্থা দ্রুতকরণের লক্ষ্যে রাস্তাঘাট সংস্কার ও প্রয়োজনে আধুনিকায়ন করা;

০৮. গ্রামে উৎপাদিত পণ্য সহজে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরে দ্রুত ও স্বল্প সময়ে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করা;

০৯. গ্রামের শিক্ষা, চিকিৎসার সহজলভ্যতার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা।

এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিদপ্তর, পরিদপ্তর কিংবা বিভাগ কর্তৃক সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে।

যথাসময়ে যদি সমুচিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে হয়তো আমরাও একদিন Shelley-র কবিতার সঙ্গে মিলিয়ে বলতে পারব- করোনা (কোভিড-১৯) আমাদের থেকে শুধু নেয়নি; ভালো কিছু দিয়েছেও বটে। সেটা হতে পারে আজ থেকে ৫ কিংবা ১০ বছর পরে।

লেখক: সহকারী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

(ঢাকাটাইমস/১৫/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :