করোনাকালে মধ্যবিত্তের অপ্রকাশিত আর্তনাদ

প্রকাশ | ১৫ জুলাই ২০২০, ১৮:২৫ | আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২০, ১৬:১০

জাহিদুল ইসলাম জুয়েল

ঘরে খাবার নেই, মধ্যবিত্তের খাতায় নাম লেখানোর কারণে দাঁড়াতে পারছেন না ত্রাণের লাইনে, আবার আত্মসম্মানবোধের কারণে মুখ ফুটে বলতেও পারছে না অভাবের কথা। এদিকে বাড়ি ভাড়া না দিতে পেরে শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার চিন্তা করছেন অনেকে। না পারছেন নিচে নামতে না পারছেন উপরে উঠতে। এ যেন মধ্যবিত্তের এক অপ্রকাশিত আর্তনাদ।

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) আজ বিশ্বজুড়ে এক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এর প্রভাবে গোটা বিশ্ব আজ অবরুদ্ধ, নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে মানব সমাজ, ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে অর্থনীতির। বলা যায়, কৃষি উৎপাদন ছাড়া পুরো অর্থনীতি আজ স্থবির। সাধারণ কর্মজীবী মানুষ হয়ে পড়েছে কর্মহীন, যার ফলে ব্যাহত হচ্ছে মানুষের সাধারণ জীবনযাপন।

আমরা দেখেছি সরকার ইতিমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষদের মাঝে ত্রাণ বা বিভিন্নভাবে আর্থিক সহায়তা করছে। তাছাড়া সমাজের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা সমাজের দাতা সদস্যরাও নিম্নবিত্তদের মাঝে ত্রাণ বা বিভিন্নভাবে আর্থিক সহায়তা করছে। আমরা দেখেছি, সবাই সমাজের নিম্নবিত্তদের নিয়ে ভাবছে, তাদেরকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। কারণ, এই করোনা পরিস্থিতিতে সমাজের নিম্নবিত্তরা যে কষ্টে আছে তা সবার কাছে স্পষ্ট।

কিন্তু সমাজে আরও একটা শ্রেণি আছে যারা সামান্য বেতনের চাকরি করে সাধারণভাবে জীবনযাপন করে। করোনার কারণে অনেকের এখন সামান্য উপার্জনের পথও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নিম্নবিত্তদের মতো তারাও কষ্টে দিনাপতিপাত করছে। কিন্তু তারা পাচ্ছে না কোনো সহায়তা। সরকার, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা সমাজের দাতা সদস্যরাও ভাবছে না মধ্যেবিত্তদের নিয়ে। এরা কিন্তু সংখ্যায় কম নয়, বরং অধিক। তাহলে এখন কী অবস্থা তাদের?

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার বড় একটা অংশজুড়ে রয়েছে মধ্যবিত্ত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)  সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে রয়েছে, তার ভেতর আবার বড় একটা অংশজুড়ে রয়েছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত। তাদের বড় সমস্যা হলো ‘আত্মসম্মানবোধ’। সম্মান তাদের কাছে বড়। মধ্যবিত্তের খাতায় নাম লেখানোর জন্য ধনীদের মতো আত্মসম্মানবোধ থাকলেও ধনীদের মতো চলতে পারে না। আবার গরিবদের মতো চলতে না পারলেও মাঝে মাঝে কষ্ট সইতে হয় গরিবদের মতো। তারা অন্যের দুঃখে কাঁদেন, অন্যের সঙ্গে ব্যথা ভাগ করে নেন, কিন্তু তারা অন্যের কাছে হাত পাততে চান না। নিজেরা না খেয়ে অন্যেদের খাওয়াতে পছন্দ করেন। কিন্তু নিজেদের দুর্বলতা অন্যের কাছে প্রকাশ করতে চান না। তাই এ সমাজ দেখতে পায় না তাদের দুঃখের উপাখ্যান।

যেহেতু তারা কষ্টের কথা বলতে ইচ্ছুক নন, নিজেদের বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখেন নিজেদের কষ্ট, তাই তারা আজ বঞ্চিত, সমাজ তাদেরকে বঞ্চিত করে, রাষ্ট্র তাদের পাশে থাকে না, হয়তো রাষ্ট্র তাদের কষ্টকে অনুধাবনই করে না। অর্থাৎ, তারা নানা সমস্যার জর্জরিত থকেন, অভাবে কষ্ট পান।

এই যে করোনার কারণে অনেকদিন কাজ নেই, আয় নেই, অনেকের কাছে যা পয়সা ছিল তা শেষ হওয়ার পথে। অনেকে তাদের সঞ্চয় ভেঙে খাওয়া শুরু করেছে। আমরা জানি মধ্যবিত্তদের কিছু সঞ্চয় থাকে। ইতিমধ্যে যাদের সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে তাদের খাবার কষ্ট শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের পোশাক যথেষ্ট গরিব নয় বলে তাদেরকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না।

ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই ব্যাপারে বলেছেন। কিন্তু এরা অনেকেই জানে না কীভাবে, কোথায় যেতে হবে সাহায্যর জন্য। যার ফলে শেষ হয়ে যাচ্ছে তাদের সঞ্চয়, পরিণত হচ্ছে নিম্নবিত্তে। আমরা দেখেছি, ঢাকা শহর হতে অনেক মধ্যেবিত্ত বাড়ি ভাড়া না দিতে পেরে গ্রামে চলে যাচ্ছে। কাউকে বলতেও পারছে না তাদের অভাবের কথা। কারণ, তাদের অবস্থান সমাজের মাঝে।

তাই সরকারকে অনুরোধ করব, এই মহামারিতে শুধু নিম্নবিত্তদের নয় মধ্যবিত্তদের নিয়েও ভাবুন। এই মধ্যবিত্তরা যদি সরকারের মনোযোগ হতে সরে যায়, তাহলে উল্টে যেতে পারে অর্থনীতির সব হিসাব। কারণ এই সমাজ বিনির্মাণ ও অর্থনীতির পুনজ্জীবনে তাদের ভুমিকাও অনিবার্য।

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রথম বর্ষ, সমাজকর্ম বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।