ন্যায়বিচার দিবস

প্রকাশ | ১৭ জুলাই ২০২০, ১৪:২৮

সুব্রত বিশ্বাস (শুভ্র)

অপরাধ সেটা যেখানেই হোক, আর যে দেশেই হোক, মানুষ যেন বিচার প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিতে পারে সেই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে পালন করা হয় আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার দিবস। আজ ১৭ জুলাই, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার দিবস। মানবতাবিরোধী অপরাধসহ যেকোনো ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে দেশে দেশে দিবসটি পালিত হয়।

একটি স্বাধীন দেশের জন্য ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হওয়া আবশ্যক। দেশের প্রতিটি মানুষের ন্যায় বিচার পাওয়া তার নাগরিক অধিকার। এই ন্যায়বিচারের অধিকার নিশ্চিত করাই এই দিবস পালনের উদ্দেশ্য। বিশ্বের নানা স্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোকে যেন বিচার প্রক্রিয়ায় সম্মুখীন করা যায়। সে জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এই বিশেষ আদালতটির সদর দপ্তর নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে। তবে যেকোন দেশেই এই আদালতের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে।

বিশ্বব্যাপী সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর বিচার প্রক্রিয়া সুনিশ্চিত করতে বিশ্বের অনেক দেশেই বিচ্ছিন্নভাবে নানা রকমের আন্দোলন হয়েছে। তবে এ ধরনের বিচার প্রক্রিয়ার আন্তর্জাতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা মোটেই সহজ ছিল না। এর ধারণা আর প্রেক্ষাপটটিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত এ রকম একটি আদালত প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে।

১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের জেনোসাইড কনভেনশন স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তী সময়ে নুরেমবার্গ ও টোকিওতে সংঘটিত হওয়া অপরাধের বিচার কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। এসব ঐতিহাসিক ঘটনা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ন্যায়বিচার পাবার গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। গণমানুষের প্রত্যাশাকে আশার আলো দেখিয়ে দিতে সাহায্য করে। এসব ঘটনা ও সাফল্য ‘রোম সংবিধি’-এর মতো চুক্তি প্রতিষ্ঠার পটভূমি তৈরি করতে সাহায্য করে।

শুরুতে ১২০টি দেশ ভোটের মাধ্যমে ‘রোম সংবিধি’ অনুমোদন করে। প্রক্রিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ এই চুক্তির সঙ্গে একাত্ম হয়েছে। তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ১৯৯৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রোম সংবিধির সাথে একাত্ম হয়। এই চুক্তি বাংলাদেশের জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী। কা্ণ ‘রোম সংবিধি’র উপর ভিত্তি করেই আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। একাত্তরের গণহত্যা ও মানবতা বিরোধী অপরাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া এই চুক্তির সাথে সম্পর্কিত।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহের বিচারের জন্য গঠিত হয় মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধীর বিচার সম্পন্ন যার উদ্দেশ্য। স্বাধীনতা লাভের ৩৯ বছর পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য ২০১০ সালে ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়। এর আওতায় ইতিমধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে যারা অপরাধ সংগঠনের মাধ্যমে দেশের অপূর্ণীয় ক্ষতি করেছে, তাদের বিচার করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশ।

ন্যায়বিচারের একটা বড় উদাহরণ হচ্ছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার ও বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সমুদ্রসীমা বিরোধের রায়। নেদারল্যান্ডসের হেগের সালিশি আদালতের রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমার ও ভারতের সংগে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়। এই রায়ে বাংলাদেশ ন্যায্য পাওনা বুঝে পায়। এই রায়ের মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল বাংলাদেশ।

আসলে ন্যায়বিচার একটি আপেক্ষিক বিষয়। দেশ, কাল হিসেবে ন্যায়বিচার ভিন্ন। এমনকি অনেক সময় বিচার করলেও তা কার্যকর করা যায় না। সেক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলা যায় না।

ন্যায়বিচার হতে পারে পানির জন্য, শিক্ষার জন্য, সমঅধিকারের জন্য কিংবা অন্য যেকোন বিষয়ে। এ ক্ষেত্রে প্লেটোর রিপাবলিক বইয়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্লেটো সেখানে বলেছেন সমাজ তৈরি হয় ন্যায়ের মধ্য দিয়ে। ঘরের মধ্যে, সমাজের মধ্যে ন্যায়বিচার হচ্ছে কি না, ধনী দেশের সংগে সম্পর্কে গরীবের ন্যায়বিচার হচ্ছে কি না তা দেখতে হবে। সেই বিচারের মধ্য দিয়েই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পায়।

দৃশ্যমান বিচারের বাইরেও একটা বিচার আছে। সেখানে মৌলিক ন্যায়বিচার করতে পারছেন কি না সেটি বিবেচনায় নিতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য ন্যায়বিচার করা সম্ভব না হলে সিস্টেম বদলাতে হবে।

লেখকঃ কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভা্‌ বিএসএমএমইউ, ঢাকা

(ঢাকাটাইমস/১৭জুলাই/মোআ)