ফিরিয়ে দাও মোরে বাঁচিবার অধিকার!

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার
 | প্রকাশিত : ১৯ জুলাই ২০২০, ০৯:০১

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রকৃতির প্রতিশোধে বলেছেন;

'তৃষ্ণার সলিলরাশি যায় বাষ্প হয়ে।

প্রতিজ্ঞা করিনু শেষে যন্ত্রণায় জ্বলি

এক দিন— এক দিন নেব প্রতিশোধ।

সেই দিন হতে পশি গুহার মাঝারে

সাধিয়াছি মহা হত্যা আঁধারে বসিয়া।

আজ সে প্রতিজ্ঞা মোর হয়েছে সফল।

বধ করিয়াছি তোর স্নেহের সন্তানে', ...

গবেষকরা মনে করেন 'সজীব প্রকৃতি মানে শুধু বৃক্ষ বা অরণ্য নয়। আমরা মানুষেরাও এই প্রকৃতির অংশ, অথবা এর সম্প্রসারণ। সবাই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। একে অপরকে বাঁচতে সাহায্য করি। উদাহরণ হিসেবে ওলেনবেন আমেরিকার বিখ্যাত ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের উল্লেখ করেছেন। এটি একসময় বিশুদ্ধ অরণ্য ছিল। যেদিন থেকে মানুষ সে অরণ্যের ওপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা শুরু করল, তখন থেকেই প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারাতে শুরু করে'।

পৃথিবী নামক গ্রহটি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য প্রকৃতির ভারসাম্য ফিরে পাওয়াই কেবল আশা জাগাতে পারে নতুন মানবিক বিশ্ব সূচনার। চন্দ্র-সূর্য গ্রহ-তারা থেকে শুরু করে পানি, বায়ু, মাটি দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান উদ্ভিদকুল, প্রাণীকুল সবই প্রকৃতির অংশ। এক কথায় বিশ্বস্রষ্টার সমগ্র সৃষ্টিই সামগ্রিক অর্থে আমাদের কাছে প্রকৃতি। মানবকুল স্রষ্টার সৃষ্টিসমূহের মধ্যে অন্যতম হওয়ায় প্রকৃতিও মানুষকে তার শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে লালন-পালন করে আসছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জীবকুল ও অন্যান্য প্রাণীকুলের অধিকাংশই মানুষের জন্য আশীর্বাদ হিসেবেই বিবেচিত তা আমরা আমাদের জীবদ্দশায় অনুভব করতে পেরেছি ইতোমধ্যে।

প্রাকৃতিক সম্পদের অদৃশ্যমান খনিজ সম্পদও মানবকল্যাণে আশির্বাদ হিসেবে পেয়েছি আমরা।

আর উদ্ভিদ, আলো, বায়্‌ পানি যা প্রকৃতির অনন্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত, তা সরাসরি মানুষের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত। এগুলোর কোনোটি ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকাই সম্ভব নয়।

আত্মরক্ষার জন্যে অনেক সময়ই মানুষকে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে সেটা অস্বীকার করছি না, তবে সে যুদ্ধও ছিল মানুষের আত্মরক্ষার কৌশল শেখার জন্য। কিন্তু মানুষ বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় এত বেশি ক্ষতিকর হয়ে উঠল যার অশেষ পরিণাম ভোগ করতে হয়েছে এই প্রকৃতিকেই। এককথায় মনুষ্য অত্যাচারে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্টের পরিণতি হিসেবে অনিবার্য কারণেই মানুষের এই ‘কারাভোগ’ বা গৃহবন্দিত্ব, আর প্রকৃতির অন্যরা সবাই মুক্ত, স্বাধীন।

মহান স্রষ্টার প্রদপ্ত প্রকৃতিই মানুষের রক্ষাকবজ। প্রকৃতিই মানুষের বেঁচে থাকার নিয়ামক। যেমনটা আলো, বাতাস, পানি ও খাদ্য ছাড়া মানুষের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। প্রকৃতির সুস্থতার জন্য যেমনি দূষণমুক্তি কিংবা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়াই একমাত্র সমাধান, তেমনি ভারসাম্যপূর্ণ সুস্থ্ প্রাকৃতিক পরিবেশই পারে মানুষকে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্নতসাধ পূরণ করতে।

কোভিড-১৯ মানুষকে গৃহবন্দি করে প্রকৃতিকে মানুষ কর্তৃক ক্ষতির হাত থেকে নিরাপদ করেছে। সেই সাথে প্রকৃতিও দ্রুত ফিরে পাচ্ছে কাঙ্খিত ভারসাম্য।

ইতোমধ্যে অন্যান্য প্রাণীকূল সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। তাদের অস্তিত্বকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করে স্বাধীন বংশ বিস্তার করে সংখ্যা বাড়াচ্ছে। কলকারখানার বর্জ্যদূষণ থেকে মুক্ত হচ্ছে প্রানি ও উদ্ভিদকুলসহ মানবজীবনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় পানি। কলকারখানার দূষিত ধোঁয়ামুক্ত হয়ে বাতাস তার স্বকীয় অস্তিত্ব ফিরে পাচ্ছে, নির্মলও হচ্ছে। মাটি-পাহাড় শত্রুমুক্ত হয়ে প্রকৃতির অন্যতম আধার হিসেবে নিজস্বতায় পরিপূর্ণ হচ্ছে। জলবায়ু দূষণমুক্ত হয়ে মানবমুক্তির জন্য আবার প্রস্তুত হচ্ছে। এক কথায় খুব দ্রুতই প্রকৃতি তার ভারসাম্য ফিরে পাবার সমস্ত আয়োজন প্রায় চুড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কারণ কিন্তু একটাই- প্রকৃতির এসব উপাদান স্বাভাবিক, সুন্দর ও কার্যকর হলেই কেবল প্রকৃতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তান মানুষকে বাঁচাতে পারবে। আপাতদৃষ্টে প্রকৃতির কাছে মানুষকে সাময়িক গৃহব্নদি করে রাখা ছাড়া হয়তো আর উন্নত কোনো বিকল্প ছিল না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-

'এ কী ক্ষুদ্র ধরা! এ কী বদ্ধ চারিদিকে!

কাছাকাছি ঘেঁষাঘেঁষি গাছপালা গৃহ

চারিদিক হতে যেন আসিছে ঘেরিয়া,

গায়ের উপরে যেন চাপিয়া পড়িবে!

চরণ ফেলিতে যেন হতেছে সংকোচ,

মনে হয় পদে পদে রহিয়াছে বাধা।

এই কি নগর! এই মহা রাজধানী!

চারিদিকে ছোটো ছোটো গৃহগুহাগুলি,

আনাগোনা করিতেছে নরপিপীলিকা।' (প্রকৃতির প্রতিশোধ)

প্রকৃতির ফিরে পাওয়া প্রাণশক্তি হয়তো আবারও হাজার বছরের জন্য নিরাপদ করবে তার ভালোবাসার মানুষকে।

একবার একটু ভাবতে পারি, যে মানুষ এই প্রকৃতির সর্বস্ব ক্ষতি সাধন করেছে, সে মানুষের মুক্তির জন্যই আজ প্রকৃতি মরিয়া হয়ে উঠেছে যেন, সন্তান অবাধ্য দুষ্ট অমানবিক কিংবা কৃতঘ্ন হলেও সে যে সন্তান। মানবসমাজে এমন অনুভূতি একমাত্র মায়ের মধ্যেই আমরা দেখতে পাই। আসলে প্রকৃতিই মানবকুলের শ্রেষ্ঠ মা।

তর্ক-বিতর্ক অনেক করার আছে, যুক্তি-তর্কের বেড়াজালে নানান মতামত থাকবে, সেটি খুব স্বাভাবিক। কেননা বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ আমাদের অনেককেই অন্ধ করে দিয়েছে। করেছে জ্ঞানপাপী। আর সেই সাথে বিজ্ঞানের কল্যাণে শক্তির বহুমুখী উচ্চতর ব্যবহার মানুষকে করেছে আরো বেশি ক্ষমতালোভী, অহংকারী, স্বার্থপর, এক কথায় কৃতঘ্ন। আমরা রীতিসই ভুলেই গিয়েছি বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ কিংবা সাফল্যের গোড়াপত্তন হয়েছে প্রকৃতির এসব উপাদান থেকেই। পৃথিবীখ্যাত বিজ্ঞানীরা কেউ এমনটা অস্বীকার করেছেনে বলে আমার জানা নাই। কিন্তু আমাদের মতো পুটি মাছ ট্যাংরা মাছের মতো বিশ্বচালকেরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করে বরং প্রকৃতির বিরুদ্ধে এমন করে যুদ্ধ চালিয়েছি যেন প্রকৃতিই বড় শত্রু আমাদের। অথচ বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, অস্তিত্ব এই প্রকৃতি মা।

বিশ্বচালকেরা কে কত ক্ষমতাবান কে কত দখলবাজ, অসম অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে প্রকৃতির এসব প্রাণদানকারী সত্তাগুলো ধ্বংস করার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে, এমনকি এ পর্যন্ত আসতে মানুষ হয়ে মানুষকে মেরে হোলিখেলার মতো কুৎসিত চিত্র এ ধরণীতে বারবার প্রদর্শিত হয়েছে। এক কথায় এরা যেন নর নয়, বস্তুত নরপিশাচ, বর্বর। বর্তমান করোনা পরিস্হিতিতে মানুষ হিসেবে প্রকৃতির এমন আচরণে সবাই রুষ্ট ক্ষিপ্ত, কিন্তু কিছু করার নেই। বৃহৎ স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতেই হচ্ছে মানুষকে। আমরা বেশ কিছু প্রাণ হারিয়েছি, স্বজন হারাচ্ছি, নিজেও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন পার করছি, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।

বিজ্ঞান আর অন্যান্য গল্পবাজিতে চলমান সাড়ে তিন মাসেও কোনো কাজ হয়নি, হবার কথাও নয়। ওস্তাদের মার শেষ রাত্রি। গল্পবাজ আর বিজ্ঞানীরা এমনটার সাথে আগে পরিচিত ছিল না বলে সব জল্পনা-কল্পনার যা কিছু তাদের কাছে বিদ্যমান তা দিয়ে করোনা প্রতিরোধ সম্ভব হচ্ছে না, যদিও স্বাস্থ্যবিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে কিন্তু এ পর্যন্ত আসা এখনো সম্ভব হয়নি। আবার বিজ্ঞানের হাত ধরেই এটার সমাধান হবে এ কথাও ঠিক। কোনো ঝাড়-ফুঁক আর কোনো গুজবে এটি রোধ করা যাবে না। গেলে মন্ত্র আর তন্ত্রবাজেরা লেজ গুটিয়ে মাঠ থেকে পালাত না, যদিও গায়ের জোরে শুরুতে কেউ কেউ হুংকার মারার মিথ্যে চেষ্টা করেছিল। পরে মনে পড়েছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের অমোঘ বাণী ‘মরিতে চাহি না সুন্দর ভুবনে মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’। আপাতত রক্ষা হচ্ছে না, অন্তত প্রকৃতি যতক্ষণ না বিজ্ঞানকে উপহার হিসেবে প্রতিষেধক উপাদান দেবে!

পরিশেষে বলব, ক্ষতিকারক হিসেবে প্রকৃতি শুধু মানুষকেই গৃহবন্দি রেখেছে তা নয়, সেখানেও কিন্তু ভালোবাসা বিবর্জিত করেননি; কারণ মানুষ হিসেবে নিজেকে নিরাপদ রাখা এবং অন্যকে নিরাপদ করার ক্ষেত্রে মানুষকে আটক রাখা ছাড়া কোনো উত্তম বিকল্প নাই এ মুহূর্ত পর্যন্ত। ফলে পুনঃক্ষতির আর কোনো সম্ভাবনা না থাকায় অন্যান্য প্রণীকুল ও জীবকুলসহ প্রকৃতির স্ব সম্পদ দ্রুত ভারসাম্য ফিরে পাচ্ছে, আর এখানেই মানুষ হিসেবে নতুন করে বেঁচে থাকার আশার আলো আমরা দেখতে পাচ্ছি।

আশা করি কল্পিত ন্যূনতম প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যেই প্রকৃতি তার ফিরে পাওয়া শক্তি দিয়ে করোনাকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে ফেলবে, সেই সাথে প্রাণ ফিরে পাওয়া সতেজ পরিশুদ্ধ কোনো প্রাকৃতিক উপাদান থেকে দ্রুত নিরাময়ের চিকিৎসা ব্যবস্থা পেয়ে যাবে গবেষকরা। আর এ শিক্ষা থেকে ভবিষ্যতের জন্য মানুষ হিসেবে নিজে বেঁচে থাকা এবং প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ‘প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’ এ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে শুভবুদ্ধির চর্চা শুরু করবে মানুষ, গড়ে তুলবে নতুন মানবিক বিশ্ব। প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা রেখে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করবে মানুষ, শুরু হবে নব পৃথিবীর মানবিক যাত্রা।

লেখক: পুলিশ সুপার। গীতিকবি, প্রাবন্ধিক ও কণ্ঠশিল্পী

(ঢাকাটাইমস/১৯জুলাই/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :