দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা

সাহাদাত পারভেজ
 | প্রকাশিত : ২০ জুলাই ২০২০, ১২:১৩

ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগের সামনের একটি সেডের নিচে অনাদরে অবহেলায় পড়ে আছেন মো. হালিম চাকলাদার নামের এক যক্ষা আক্রান্ত রোগী। বয়স ষাটের একটু বেশি। কিন্তু যক্ষা কাবু করে ফেলায় তাকে অতিশয় বৃদ্ধ দেখাচ্ছে। ৫ জুলাই সকালে তার ছেলেমেয়েরা তাকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে আসেন। সারা দিন চেষ্টার পর ভর্তি করাতে না পেরে শেষে তাকে হাসপাতালের সামনে ফেলে রেখে চলে যায় তারা।

১২ দিন ধরে সেখানেই পড়েছিলেন হালিম চাকলাদার। ছেলে মেয়েরা তার খোঁজ নিতে আসে নি। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকজন, দেখে মায়া লাগে যাদের; তারা দূর থেকে যে খাবার ছুড়ে দেয়, সেগুলো খেয়েই তিনি এত দিন বেঁচে ছিলেন।

১৭ জুলাই দুপুরে তাকে দেখতে পায় দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্রী মাহবুবুর রহমান। অবহেলায় পড়ে থাকা হালিম চাকলাদারের দুর্দশার চিত্রটি সে ক্যামেরায় ধারণ করে। কয়েক দিন খেতে না পেরে শরীর থেকে হাড়গুলো যেন বেড়িয়ে আসছিল তার। বিকেলে অফিসের সার্ভাওে ৩টি ছবি পাঠায় মহুবার।

এর একটি ছবি ছাপা হয় আজকের দেশ রূপান্তরের তৃতীয় পৃষ্ঠায়। ছবিটি দেশ রূপান্তরের প্রকাশক ও রূপায়ণ গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মাহির আলী খাঁন রাতুলের চোখে পড়ে। সকাল ১১টার দিকে মহুবারের সঙ্গে মাহির আলী খান রাতুলের কথা হয়। তিনি লোকটার পাশে দাঁড়াতে চান। চিকিৎসার সবটুকু দায়িত্ব নিতে চান।

মহুবার তখন ঢাকা মেডিক্যালেই ছিল। হালিম চাকলাদারের মাথার নিচ থেকে চিকিৎসার ফাইল নিয়ে মহুবার সরাসরি চলে যায় ঢাকা মেডিক্যালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিনের রুমে। পত্রিকার ছবি দেখিয়ে পরিচালককে বিস্তারিত বলে।

পরিচালক সঙ্গে সঙ্গে লোক পাঠিয়ে হালিম চাকলাদারকে বর্হি:বিভাগে নিয়ে আসেন। দায়িত্বরত চিকিৎসক দেখেশুনে তাকে জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে রেফার করেন। ব্রিগেডিয়ার নাসির বক্ষব্যাধির পরিচালককে একটি চিঠি লিখেন। অ্যাম্বুলেন্স দেন। সঙ্গে একজন লোকও।

মহুবার মোটর বাইকে করে অ্যাম্বুলেসের পেছন পেছন ছুটে। দুপুর ১টার দিকে অ্যাম্বুলেন্স গিয়ে পৌছায় বক্ষব্যাধির সামনে। হালিম চাকলাদারকে অ্যাম্বুলেন্সে রেখেই মহুবার কাগজপত্র নিয়ে দৌড়াতে থাকে বক্ষব্যাধির পরিচালকের কক্ষের দিকে। সব দেখে পরিচালক তাকে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। ঢাকা মেডিক্যালের সামনে পড়ে থাকা হালিম চাকলাদারের জায়গা হয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের ১৬-১৭ ওয়ার্ডের ৩৫ নম্বর বিছানায়।

রোগীর জন্য রূপায়ণের প্রধান কার্যালয়ে হালিম চাকলাদারের জন্য দশ হাজার টাকা রাখা হয়।

মহুবার সেই টাকা নিয়ে ছুটে আসে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে। অনাহারে থাকা হালিমের কাছে সে জানতে চায়, এখন কি খেতে ইচ্ছে করছে? হালিম জানান, তার দুধ খেতে খুব মন চাচ্ছে। মহুবার এক দৌড়ে গিয়ে কিনে নিয়ে আসে দুধ, কলা, রুটি, মালটা, কমলা, খাবার পানি ও গোসলের সাবান।

হালিমের বন্ধ হয়ে যাওয়া মোবাইলের সিম খুলে তার ফোনে ঢুকান। শাকিল নামের এক দু:সম্পর্কের নাতি আছে হালিম চাকলাদারের। মহুবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। কয়েক দিন ঠিকমতো না খাওয়া কঙ্কালসাড় হালিমের হাতে কিছু টাকা দিয়ে মহুবার বিকাল ৫টার দিকে বাসায় ফেরে। আর পাশের বেডের রোগীর কাছে দিয়ে আসে তার ফোন নম্বর। রাতে জরুরি প্রয়োজন হলে তাকে ফোন করতে বলে।

বিকাল ৬টার দিকে মহুবার আমাকে ফোন করে জানায়, ‘ভাইয়া, আগামি কাল ছাপার মতো কোনো ছবি আমার হাতে নাই। সারা দিনে আমি কোনো ছবি তুলতে পারি নাই। কেনো পারো নাই জানতে চাইলে মহুবার আমাকে সব ঘটনা খুলে বলে। শুনে আমার চোখে নোনা জমে। ফটোসাংবাদিকতা আজকাল শুধু ছবি তোলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না। ফটোসাংবাদিকদের কোনো একটা প্রচেষ্টা কিংবা কোনো একটা উদ্যোগ যদি ঘটনার মোড় ঘুড়িয়ে দিতে পারে; তাহলে ছবি তোলা বাদ দিয়ে সেই কাজটির দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। শুধু ছবি তোলার কারণে মানবতার সেবায় ছুটে যেতে না পারলে সেটাকে কী সাংবাদিকতা বলা যায়! মহুবারের মতো এমন দায়িত্বশীল সংবাদচিত্রী আমার সহকর্মী ভাবতেই বুকটা ভালো লাগায় ভরে ওঠে।

লেখক: সংবাদচিত্রী ও শিক্ষক

ঢাকাটাইমস/২০জুলাই/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :