একমাস করোনা জীবনকে অন্যভাবে দেখতে শিখিয়েছে

কুমার তাপস
 | প্রকাশিত : ২০ জুলাই ২০২০, ১৮:৪৩

করোনার বর্তমান সময়টা আমাদের সবার জন্য সত্যিই খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। পরিচিত অনেকেই এখন করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন,মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন। তার উপর আবার যদি পরিবারের সবাই পজিটিভ হয়ে পড়ে, তাহলে তো নিজেদেরকে সামনালোই যেখানে কঠিন হয়ে পড়ে, সেখানে নিজেদেরকে সামলিয়ে কোনো প্রোডাক্টিভ কাজ করা সত্যিই কঠিন।

এ জন্য স্যালুট জানাই সৈয়দা মোমেনা আফসানা আপনাকে। পরিবারের সবাই করোনা পজিটিভ থাকা অবস্থাতেই আপনি পূর্বালি, পারিজাতের মতো অসাধারণ দুটো পিচ্চিকে যেভাবে মানসিকভাবে সাপোর্ট করে যাচ্ছেন, এটা সত্যিই অসাধারণ।

রোবট অলিম্পিয়াডে আমি পূর্বালি ও পারিজাতকে দেখেছি, কোনো একটা নির্দিষ্ট কাজের প্রতি ওদের ভালোবাসাকেও দেখেছি। আবার কোন নির্দিষ্ট কাজে সফলতা না আসলে মন খারাপেরও সাক্ষী হয়েছি বহুবার। সেই সাথে ওদের প্রত্যেকটা কাজে আপনি কিভাবে ওদেরকে মেন্টর করেন, কিভাবে অনুপ্রাণিত করেন - এটাও দেখেছি অনেকবার।

ওদের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা এই কঠিন পরিস্থিতিতে ওরা করোনার সাথে লড়াই করার পাশাপাশি নিজেদেরকে নানারকম প্রোডাক্টিভ কাজে ব্যস্ত রেখেছে।এত কষ্টের মধ্যেও ওরা যেমন শিশু-কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেসে অংশ নিলো। করোনা পজিটিভ থাকা অবস্থায়ই নিজেদের গবেষণার কাজ করেছে এবং সাবমিট করেছে অনলাইনে। কংগ্রেসের সর্বশেষ আয়োজনেও ওদের উপস্থিতি দেখেছি আমি।

করোনার সাথে ওদের পুরো পরিবারের যুদ্ধটা কেমন চলছে ,এটা সবার জন্য একটু শেয়ার করছি। সেই সাথে পূর্বালি ও পারিজাতকে বলি,পৃথিবী আবার শান্ত হবে। সব কিছুই আবার আগের মতোই হবে। অনেক অনেক শুভকামনা।

গত বারোই জুন পুর্বালীকে নিয়ে আইসোলেশনে ঢুকেছিলাম, আজ বারোই জুলাই পারিজাত আর টুশীকে নিয়ে বেরুচ্ছি স্বাভাবিক জীবনে। আলহামদুলিল্লাহ বাচ্চারা সহ সবাই ভালো এখন। শুধু মাঝে কিছু স্মৃতি, যা সাধারণ জীবনে কেউ নাগাল পায় না, এ শুধু করোনাকালেই মেলে। পূর্বালী আমার তের বছরের মেজ মেয়ে, পারিজাত ছোট, ওর বয়স এগারো।

পূর্বালীর জ্বর এলো এগারোই জুন, বৃহস্পতিবার রাতে, আমার ঘরেই ছিলো ও। পরদিন যখন স্বাদ আর গন্ধ চলে গেল, সাথে লুজ মোশন, বুঝলাম এ অন্য কিছু। সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করিনি, ওকে নিয়ে আমি আলাদা হয়ে গেলাম। স্টাফ ক্লিনিকে টেস্টের ব্যবস্থা হলো। ঘর থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস রেখে বাকি সব কিছু বের করে দিলাম। একটা চেয়ার রেখে দিলাম দরজার বাইরে, খাবার দিয়ে যাবার জন্য।

তের তারিখ টেস্ট, ওইদিন আমার আর পারিজাতেরও জ্বর এলো। পারিজাত তখনও ওদের ঘরে। পরদিন সকালে পূর্বালীর রেজাল্ট এলো, পজিটিভ। ও আমাদের পুরোনো ডায়ালগটা বললো, "সেটাই হয় যেটা আল্লাহ ডিসাইড করেন। আর আল্লাহ যেটা ডিসিশন নেন সেটাই ঠিক।" এটা আমাদের মা মেয়ের একটা স্পেশাল কনভারসেশন, কখনো নিরাশার কিছু ঘটলেই বলে থাকি।

সোমবার, পনেরো তারিখ, আমার আর পারিজাতের টেস্ট হলো স্টাফ ক্লিনিকে, ওদের বাবা যেহেতু হাসপাতালে যেতেন, আর আমার দুই ননাশের একজনের হালকা জ্বর ছিল কদিন আগে, এই তিনজনও স্যাম্পল দিলেন ওইদিন ক্রিসেন্টে গিয়ে। বাকিদের জন্যও বুকিং দেয়া হলো, আইসিডিডিআরবিতে তখনও কমার্শিয়াল সার্ভিস শুরু হয় নি।

রাতেই মা মেয়ের রেজাল্ট এলো, পজিটিভ। পারিজাত এবার আমাদের গৃহসঙ্গী। পূর্বালী শক্ত ছিল, কিন্তু পারিজাত সহজে মেনে নিতে পারেনি। প্রচন্ড অসুস্থ শরীর নিয়েও পূর্বালী বোনকে বোঝানোর দায়িত্ব নিলো, সফলভাবে। শুরু হলো একুশ দিনের নির্বাসন। পরদিন জানা গেল পূর্বালীর বাবা এবং বড় আপা পজিটিভ। সে এক বিপর্যয়। আমি এক ঘরে দূই মেয়ে নিয়ে, রিপন আপাকে নিয়ে গেস্ট রুমে, আরেক আপাকে বাচ্চাদের রুমে দেয়া হলো। তিনি বড় আপার কন্টাক্টে ছিলেন জ্বরের সময়েও। আমাদের ক্লাস টেনে পড়া বড়মেয়েটা একা বাইরে। হঠাৎ করেই মেয়ে থেকে মা হয়ে গেলো এলোমেলো, অলস মেয়েটা আমার। পুরো বাড়ী, আর তিন বিড়ালের দায়িত্ব নিয়ে ও ড্রয়িংরুমে আস্তানা গাড়লো।

বুধবার পুরো বাড়ীর টেস্ট হলো, টুশী, যে আমার বাচ্চাদের দেখাশোনা করতো, পজিটিভ, নীচে একজন ড্রাইভার, আর কেয়ারটেকারও। সৌভাগ্যক্রমে আম্মাসহ ভাইয়ার ফ্ল্যাটে সবাই নেগেটিভ, সাথে আমার বড়মেয়ে রুপন্তী, আমার রান্নাঘরের মালকীন নাজমা, আর আমাদের ড্রাইভার ইসলাম।

এবার টুশী যোগ হলো এই ঘরে। বেডরুম আর তার সাথে বারান্দা, আমাদের আইসোলেশন সেল। ড্রইংরুম আর বারান্দার মাঝে বড় একটা জানালা, এপারে দুই বোন, ওপারে তাদের আপ্পা আর তিন বেড়াল। বেড়ালগুলোর আকুতি দেখলে কষ্ট হতো, কোকো আর বনবন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে বহুদিন। রুপন্তী সারারাত বিড়াল সামলেছে, আর সারাদিন আমাদের বিভিন্ন প্রয়োজন। খাবার, চা, স্যুপ, ফলমুল, পানি, যখন যার যা প্রয়োজন। এদিকে কুমু, আমার ভাইয়ের বউটি, অসুস্থ শরীরেও সব খোঁজ নিচ্ছে (ও তখন এ্যানিমিয়ায় আধা শয্যাশায়ী)। মশলা চা থেকে শুরু করে মুরগির স্যুপ, কে খেলো আর কে খায় নি। কুমু আর ভাইয়ার ছটফটানি বুঝতাম, এক ফ্লোর নীচে থেকেও ওদের তখন আসা বারন, আম্মার কথা চিন্তা করে।

এই দিনগুলোতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বাচ্চা দুটির মনোবল বজায় রাখা। পারিজাতকে অনলাইন জুনিয়র সাইন্স ক্যাম্পে এনরোল করে দিয়েছিলাম, সন্ধ্যায় ব্যস্ত থাকলো দুসপ্তাহ। ভিডিও অফ করে শুয়ে বসেই ক্লাস করতো। অনলাইন আরবী ক্লাসও করলো একইভাবে দুই বোন। আর ছিল Roblox, তিনতলায় থেকেও ওদের সর্বক্ষনের সঙ্গী লাইবা (আমার একমাত্র ভাইঝি)।

আইসিডিডিআরবি স্টাফ ক্লিনিক প্রটোকল অনুযায়ী তিন সপ্তাহ শেষে ফলোআপ টেস্ট। তিন জুলাই, শুক্রবারে পূর্বালী; পাঁচ জুলাই আমি, পারিজাত, আর রিপন। এর মধ্যে শনিবারে টুশীরও বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম দুসপ্তাহ শেষ বলে।

শুক্রবার রাতে পূর্বালীর রেজাল্ট এলো, নেগেটিভ, কি আনন্দ। ওর সিদ্ধান্ত পারিজাতসহ একসাথে রবিবারে বের হবে। ওকে জোর করে বের করা হলো। শনিবার রাতে জানলাম টূশী তখনও পজিটিভ, আর রবিবার রাতে স্টাফ ক্লিনিক জানালো পারিজাত, আমি, রিপন, আমরা তিনজনই এখনো পজিটিভ! পাঁচই জুলাই সেটা।

পারিজাত ভেঙে পড়েছিল সেদিন। কিছুতেই সামলানো যাচ্ছিল না ওকে।ওর বুকফাটা আর্তনাদ সারা জীবন আমার কানে বাজবে। কত প্ল্যান করছিলো দুই বোন, সাইন্স কংগ্রেসের পোস্টার তৈরি করতে হবে- তিন দিন সময় আছে হাতে। বিড়ালগুলোকে কচলাবে। লাইবার সাথে খেলবে। একটা ফোনে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেল।

প্রটোকল অনুযায়ী একুশ দিনে পজিটিভ এলে আরো সাতদিন আইসোলেশনে থেকে তারপর স্বাভাবিক জীবন, টেস্ট লাগবে না আর। প্রথম তিন সপ্তাহের চেয়ে শেষের এই এক সপ্তাহই আমার জন্য ছিল বেশি ভারী। পারিজাতের নিঃসঙ্গতার কষ্ট। আমার এই মেয়েটা বাইরে খুব রাগী আর একরোখা হলেও ভেতরে ভেতরে খুবই নরম আর ভীতু।

আজ সেই সাতদিনও ফুরিয়েছে, গতরাতে টুশীরও রিপোর্ট এসেছে, নেগেটিভ। রিপন আর টুশী আবার টেস্ট করিয়েছিল শুক্রবার। রিপন এখনো পজিটিভ। ও র জ্বর এসেছিল প্রথম পজিটিভ আসার সাতদিন পর, সিম্পটম হিসাব করলে একুশদিন পার হয়েছে গত বৃহস্পতিবার, সেই হিসেবে আরো এক সপ্তাহ নির্বাসন। ওই দিকে বড়আপা (আমার ননাশ) গত সপ্তাহেই নেগেটিভ হয়েছেন কেয়ারটেকার আর ড্রাইভারটিও।

এই একমাস করোনা জীবনকে অন্যভাবে দেখতে শিখিয়েছে, আর জেনেছি মানুষকে।

বন্ধুরা, কি না করেছে মনোবল চাঙ্গা রাখতে। এক ভাবী খবর পেয়ে মোটামুটি এক ফ্রিজের সমান খাবার পাঠিয়ে দিলেন। আমাদের নীচতলার ভাড়াটিয়া এই একমাস আমার ড্রাইভারকে খাইয়েছেন (ও নেগেটিভ ছিল)। আমার বাবুর্চি নাজমা দিন রাত এতো গুলো পজিটিভ রোগীর খাবার ও আনুষঙ্গিক সবকিছুর জোগান দিয়ে গেছে হাসিমুখে।এইসব ঋন ভোলার নয়।

আরো একটি ঘটনা বলার আছে। পারিজাত পূর্বালী এবার শিশু কিশোর সাইন্স কংগ্রেসে অংশ নিচ্ছে। যার সব ক্রেডিট ওদের মেন্টরদের, যারা ওদের থামতে দেননি, একরকম বাধ্য করেছেন এগিয়ে যেতে। বারবার ফোন করে বলেছেন, হাল ছাড়তে না, যতটুকু সম্ভব তাই জমা দিতে। অথচ এই ছেলেগুলোর সাথে কোনো পরিচয়ই নেই আমাদের। কৃতজ্ঞতা শব্দটা বড় কম হয়ে যায় ওদের জন্য।

আমার আত্মীয় স্বজনের মধ্যে গুটিকয়েক ছাড়া কাউকে জানাই নি, বিশেষ করে যারা দুরে, তাদের অবশ্যম্ভাবী উদ্বেগ চিন্তা করে। ক্ষমা চাইছি, বড়মামা মামি, ছোটমামা মামী, মেজ খালা- খালু, আমার কাজিন গুষ্ঠির কাছে, সাথে সব স্বজন ও বন্ধু শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে। আপনাদের দোয়া সাথে ছিলো সর্বক্ষন, টেনশনটা চাইনি।

কোনো কষ্টই চিরস্থায়ী নয়, আর আল্লাহ যা কিছু করেন, তার পিছনে কোনো না কোনো কল্যাণ থাকে, একালের বা ওকালের, আমরা বুঝি আর না বুঝি। ভালো থাকুন সবাই, আল্লাহ সবাইকে ভালো রাখুন, সুস্থ্য রাখুন।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, বিপিও সামিট বাংলাদেশ ও প্রগ্রাম এক্সিকিউটিভ, বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি

ঢাকাটাইমস/২০জুলাই/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :