আমরা নিরীহ ভেন্টিলেটর ডায়ালাইজার

আব্দুন নূর তুষার
 | প্রকাশিত : ২১ জুলাই ২০২০, ১১:২৮

আমি একটি ডায়ালিসিস মেশিন। আমার জন্ম চীনদেশে। জন্ম থেকেই আমি আছি অস্তিত্বের সংকটে। আমার নাম ধাম কখনো আমেরিকান কখনো জার্মান। কিন্তু আমার জন্ম চীনের কারখানায়। ফলে আমি ভেতরে ভেতরে চাইনিজ কিন্তু বংশ পরিচয়ে আমেরিকান বা জার্মান শ্বেতাংগ।

আমার জন্য দরকার বিশুদ্ধ পানি। লাগে বিশেষ বিছানা। লাগে হাসপাতাল। আর আমার কাজ হলো মানুষ রোগীদের কিডনী খারাপ হলে রক্তে জমে যাওয়া বর্জ্য পরিষ্কার করা। এককথায় বলতে পারেন আমি রক্তের সুইপার।

আমি বাংলাদেশে আসতে রাজী ছিলাম না। আমার আগে যারা এই দেশে এসেছে তারা বলেছে, প্রবেশের আগে থেকেই নাকি আমাদের নিয়ে চুরি চামারী শুরু হয়। কখনো আমার এইচএসকোড বদল করা হয় । করফাঁকী দেয়ার চেষ্টা করা হয়। কখনো আন্ডার ইনভয়েস করে কর কমানো হয় , কখনো ওভার ইনভয়েস করে মুদ্রাপাচার করা হয়। তাই এই দেশে আসতে আমার মন কখনো চায় নাই। শুধু তাই না অনেক সময় আমার বড়ভাইরা কাস্টমসের গুদামে থাকার নামে এয়ারপোর্টে খোলা আকাশের নীচে থেকে জংধরা রোগে মৃত্যুবরন করেছে বলেও জেনেছি।

যাই হোক আমাকে দাম বাড়িয়ে বহু টাকা লোপাট করার মাধ্যমে মিঠু আবজলদের সিন্ডিকেট মহাখালীর একটি দপ্তরে বিক্রি করে দেয়। এটা অনেকটা ক্রীতদাস বেচাকেনার মতো।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। আমি সেখানে গিয়ে দেখি আমার কিছু চাচাত ভাই ভেন্টিলেটর সেখানে আছে। তারাও অতিরিক্ত দামে বিক্রী হয়েছে। তারা তাদের ভাগ্য নিয়ে চিন্তিত।

এমন সময় জানতে পারি কোন এক বড়কর্তার মৌখিক নির্দেশে আমাকে আমার আরো একজন ডায়ালিসিস মেশিন ভাই ও দুজন ভেন্টিলেটর চাচাতো ভাই সহ উত্তরা পাঠানো হচ্ছে। জায়গাটার নাম রিজেন্ট। সেখানে সাহেদ স্যার নামে একজন নাকি চেয়ারম্যান। তার ক্ষমতা বিরাট। কাগজপত্র ছাড়াই তার সাথে চুক্তি হয়ে যায়। মন্ত্রী স্বয়ং তার চুক্তিস্বাক্ষরে থাকেন। তার পেছনে লাইনে দাড়িয়ে যায় মহাশক্তিধর আমলারা । এমনকি চিকিৎসকদের অবিসংবাদিত নেতাও এক কোনায় জায়গা পেয়ে বর্তে যায়।

আমি রিজেন্টে গিয়ে দেখি আমার থাকার জায়গা নাই। ডায়ালিসিস দুরের কথা, সেখানে অক্সিজেন লাইন মেরামত করে কোনমতে আমার দুজন চাচাতো ভেন্টিলেটর ভাইকে কাজ করানোর চেষ্টা করা হয়। আমাদের অবস্থা দেখে ডা. সাম্মিরুল পত্র দিয়ে সেই রিজেন্ট হতে অফিসিয়ালি দৌড়ে বাঁচেন। তারপর... এই ডাক্তারদেরও আমাদের মতো অবস্থা। বিনামূল্যে সেখানে তাদেরও চালান দেয়া হয়েছে। এর নাম নাকি পিপিপি।

পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ। আমরা দেখলাম পিপিপি মানে পাবলিক প্রাইভেট প্রতারণা। তারপর আমাদের ভাষা নাই বলে বলতে পারি নাই তবে দেখেছি করোনা রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসার কথা থাকলেও রোগীদের কাছ থেকে পয়সা নিতে। দেখেছি জাল রিপোর্ট দিতে। দেখেছি সাহেদ কিছু টেলিভিশনের টক শোতে গিয়ে মিথ্যা কুৎসা ছড়াচ্ছেন ডাক্তারদের নিয়ে । ব্যাটা দুমাস বেতন দেয় না কিন্তু বলে ডাক্তার নাকি দিনে ২০০০০ টাকা চেয়েছে তার কাছে। আবার নুসরাত নামে এক ডাক্তারের প্রশংসা করে। এই লোক সারাক্ষন মিথ্যা বলে।

আমার ভাষা নাই তাই শুনে যাই। কিছু বলতে পারি না। নিরীহ ডায়ালিসিস মেশিন, একদিন দেখি র‌্যাব ভাইরা কালো পোষাকে এসেছেন। সারোয়ার ভাই এসেছেন। আমরা ভাবি আমরা মুক্তি পাবো। এসেছিলাম সরকারী হাসপাতালে কাজ করবো ভেবে , অথচ আটকা পড়েছি মিথ্যুক প্রতারক সাহেদের মানহীন ময়লা নোংরা হাসপাতাল নামের অনুমতিহীন প্রতারণা কেন্দ্র রিজেন্টে।

কিন্তু আমাদের মুক্তি হলো না। আমাদের উদ্ধারের জন্য জ্ঞানী তৈল সিং এর স্রষ্টা , প্রিয় আবু হেনা ভাই পত্র দিলেন। কিন্তু আমরা কোথায় আছি এখন আমরা নিজেরাই জানি না।

কে বা কারা, যে বা যারা নিয়ম ভেঙ্গে আমাদের বেসরকারী প্রতারণা কেন্দ্রে চালান করলেন, তাদের পরিচয় কি? কিভাবে তারা আমাদের সাথে এই অন্যায় করলেন?

আজ এই অন্ধকার থেকে আমরা মুক্তি চাই। আমি ডায়ালিসিস মেশিন , আমার সাথে ভেন্টিলেটর ভাইয়েরা। আমরা বাংলাদেশের গরীব জনগণের সম্পত্তি। আমাদের জীবন ও কাজ নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলেছে, তাদের কি কোন বিচার হবে?

জং ধরে মরে যাওয়ার আগে আমাদের উদ্ধার করুন। সাহেদকে নিয়ে ভেন্টিলেটর উদ্ধার অভিযানে যান। এই ব্যাটা নিজে জং ধরা অস্ত্র কোমরে নিয়ে কাদার মধ্য দিয়ে চকচকে জুতা পরে হাঁটে। এর কোন মায়া দয়া নাই। যে নিজের অস্ত্রে জং ধরায় সে আমাদেরও জং ধরিয়ে মেরে ফেলবে।

এই সাহেদ টিভি টক তারকা। তার ভায়রা টিভি অনুষ্ঠান বানায়। তার শ্বাশুড়ি বাতাবী লেবু টিভির বড়কর্তা ছিলেন। তার জেঠুস টিভিতে উপস্থাপনা করেছেন। তার স্ত্রীও একসময় আনন্দমেলায় ফুল দেয়া নেয়ার সহকারী হয়েছিলেন। সাহেদ টিভিতে মিছা কথার রাজা। ঘন ঘন তৃতীয় মাত্রায় যায়।

ধরা পড়ার পরেও টিভিতে সারাক্ষন তাকে দেখায়। তিনি এক চিরতারকা । তাকে ছাড়া টিভিগুলা কিভাবে টিআরপি পেতো বলেন?

তাকে নিয়ে জংধরা লোহা উদ্ধার অভিযানে না গিয়ে , আমাদের উদ্ধার করেন আমরা নিরীহ ভেন্টিলেটর। নিরীহ ডায়ালাইজার। সাহেদের সহযোগী , অধিদপ্তরের ডিজি ও অন্যান্যদের সাথে নিয়ে আমাদের উদ্ধার করেন। প্লিজ! জং ধরে মরে যাওয়ার আগে আমাদের বাঁচান। পিপিপি এর নামে পাবলিক প্রাইভেট প্রতারণা বন্ধ করেন।

লেখক: চিকিৎসক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

ঢাকাটাইমস/২১জুলাই/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :