বিচারপ্রার্থীর মনমাঝি হতে চাই

শেখ মফিজুর রহমান
 | প্রকাশিত : ২২ জুলাই ২০২০, ১৩:৩৯

সম্প্রতি বাংলাদেশ বিচার বিভাগের অধঃস্তন আদালতের সর্বোচ্চ স্কেলভুক্ত পদে তথা বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বোচ্চ স্কেলে অর্থাৎ সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে পদায়িত হলাম। অন্যদিকে প্রায় একই সময় আমার সহকর্মীরা অনানুষ্ঠানিক, অনাড়ম্বর কিন্তু আন্তরিক পরিবেশে আমার জন্মদিন পালন করলেন। ফেসবুকের কল্যাণে উভয় ঘটনায় আমার সহকর্মী, বন্ধু ও আত্মীয়স্বজন ভীষণ আমুদে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কিছুটা আবেগবিহ্বল হয়েই এই লেখা। একটি সরল আত্ম-উপলব্ধি।

১৯১১ সাল। ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ দিল্লি এলেন বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করতে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতা গোখলেকে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘আমরা তোমাদের রেলপথ-রাস্তাঘাট বানিয়ে দিচ্ছি, তোমরা শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত হচ্ছো, তবু স্বাধীনতা চাও কেন?’ কালবিলম্ব না করে গোখলে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমাদের আত্মমর্যাদা আছে বলেই স্বাধীন হতে চাই।’

বিচার বিভাগের এই আত্মমর্যাদা আছে বলেই আমরা স্বতন্ত্র, অন্যদের থেকে আলাদা।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি পৃথিবীতে এসেছে অস্ত্র ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে। একাত্তরের আদর্শ ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগালে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার জন্য সমান অধিকার এদেশে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

আমাদের দেশটাকে ফুলের বাগানের মতো গড়ে তুলতে চাই। ফুলের বাগানে যেমন নানা রঙের ফুল থাকে, এ দেশটাও তা-ই। এখানে আছে নানা ধর্মের মানুষ, আছে সমতল ও পাহাড়ের মানুষ। আমরা একসাথে সুন্দরভাবে থাকতে চাই। সেজন্য একটি উদারনৈতিক পরিবেশে আমাদের প্রত্যেকটি প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে।

একজন বিচারকের ব্যক্তিগত উন্নতির পাশাপাশি প্রত্যেকের রয়েছে সামাজিক দায়বদ্ধতা; যেমন- একজন কবি শুধু বিনোদনের জন্য কবিতা লেখেন না, সমাজের বিকাশেও তার কিছু করণীয় আছে। বড় কিছু করতে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়। যারা বড় কাজ করেছেন, সবাই কোনো না কোনো ঝুঁকি নিয়েছেন। সবকিছু নিরাপদ নির্বিঘ্ন থাকবে, তারপর আমি একটা মহৎ কাজ করব, এটা হয় না। আপনি কঠিন সময়ে ভেঙে পড়েন, নাকি দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন, প্রয়োজনে চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন কি না সেটাই মুখ্য বিষয়। সবাইকে সত্যের ওপর দাঁড়াতে হবে, দাঁড়াতে হবে ইতিহাসের সঠিক রাস্তায়। বিচারককে হতে হবে বিচারপ্রার্থীর মনমাঝি। আসলে কর্মই ধর্ম, কর্মই জীবন, কর্মই ইবাদত। তাই যে মানুষ কর্মবীর হয়, রোগ তাকে সহজে স্পর্শ করতে পারে না।

আশাবাদ, ইতিবাচকতা আর কর্মের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার জোর উদ্দীপনা খুঁজে পায় মানুষ, খুঁজে পায় জীবনের লক্ষ্য- সর্বোতভাবে যা তাকে উদ্বুদ্ধ করে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যেতে।

ফেসবুকের জগতে শুধু সামাজিক যোগাযোগ নয়, দরকার প্রত্যক্ষ মানবিক যোগাযোগ। এজন্য ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে বাড়াতে হবে নৈতিক মূল্যবোধগুলোর চর্চা। এর পাশাপাশি চাই সংঘবদ্ধ উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা। কারণ ব্যক্তি প্রধানত শক্তিহীন, যদি না সে যুক্ত হয় সমষ্টির সাথে।

এ জন্য এখন যা দরকার আমাদের, সেটা হলো নিরন্তর কাজ করে যাওয়া। শেষ পর্যন্ত কাজটাই মানুষকে জয়ী করে। কাজ হলো অথৈ সমুদ্রে একটা শক্ত ভেলার মতো, যা মানুষকে ভাসিয়ে রাখে। কাজ না করলে মানুষ ডুবে যায়, সমুদ্রে হারিয়ে যায়।

আমাদের একটাই কর্তব্য- এই জীবনকে তার সর্বোচ্চ মহিমা দান করা। একটা আনন্দময় ও কল্যাণকর জীবন পার করে এই পৃথিবী থেকে চলে যাব, সেটাই আমাদের কাম্য। মানুষের মধ্যে ভিন্নতা সত্ত্বেও খুঁজে নিতে হবে ভেদের মধ্যে অভেদ, অনাত্মীয়ের মধ্যে আত্মীয়তা। সত্য-নিষ্ঠাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনোকিছুর জন্যই সত্যকে ত্যাগ করা যায় না।

ফুল সৌন্দর্যের প্রতীক। ফুলের কাছে মৌমাছির মধুভিক্ষার কাতরতায় ফুল মুগ্ধ হয়। নিজেকে মেলে ধরে মৌমাছির কাছে। এভাবে দুজন দুজনের প্রয়োজন মেটায়। প্রকৃতিতে এই যে দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক, এ এক ধরনের মিথস্ক্রিয়া। বিজ্ঞানের ভাষায় একেই বলা হয় সিমবায়োটিক রিলেশনশিপ (Symbiotic Relationship)। ন্যায়বিচার প্রদানের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীদের সাথে বিচারকদেরও এই দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক মজবুত করতে হবে। তবেই বিচার বিভাগ ও জনগণের মধ্যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও সেতুবন্ধ গড়ে উঠবে।

১৯৩২ সালে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের চিঠির জবাবে মনোবিজ্ঞাবী ফ্রয়েড লিখেছিলেন, "মোটা দাগে কাউকে ভালো বা মন্দ বলা যাবে না। সব মানুষের মধ্যেই ঝগড়াটে স্বভাব ও সৌহার্দ্যবোধ সমভাবে ক্রিয়াশীল।" মানুষের সৌহার্দ্যবোধকে দৃঢ় করার জন্য তাই প্রয়োজন সুশিক্ষা ও সুস্থ-সংস্কৃতির বিকাশ। শিক্ষা মানুষেরই দরকার, কারণ মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। একটি গরুর বাচ্চা জন্মের পরপরই লেজ উঁচিয়ে লাফাতে থাকে। আবার যে মানবশিশু জন্মের পর সবচেয়ে অসহায় প্রাণী, সে-ই একসময় হয়ে উঠতে পারে বিশ্বখ্যাত কেউ। আবার ঠিকপথে পরিচালিত না হলে সে হয় কুখ্যাত অপরাধী। অর্থাৎ মনুষ্যত্ব অর্জনের জন্য সুশিক্ষার পথে এগিয়ে গেলে নর হতে পারে নারায়ণ। উল্টো পথে চললে নরাধম।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ভোরের শপথ করেছেন। অর্থাৎ নিজের সৃষ্টিতে তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছেন- ভেবেছেন এর নামেও শপথ করা যায়। আমরা আমাদের কাজকে, সৃষ্টিকে সেই পর্যায়ে নিতে চাই যেন এটা শিল্পে পরিণত হয়।

জুডিশিয়াল এক্টিভিজম কীভাবে আরো বাড়ানো যায় সেই চেষ্টা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। তবে মানুষের জন্য মুগ্ধতা খুব ভালো কিছু নয়। মুগ্ধ হলেই প্রশ্ন থেমে যায়। নতুন উদ্যমের উৎসাহ থাকে না। মানুষ বিবশ হয়ে যায়। সক্রেটিস বলতেন, প্রশ্নের মধ্য দিয়ে তুমি তোমার উত্তর পাবে। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই রয়েছে এক অসীম শক্তির আধার। একে জাগ্রত করলেই আমি আমার জিজ্ঞাসার উত্তর পাব।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন যেখানেই যেতেন, তার হাতে থাকত একটি বাক্স যাতে থাকত একটি বাদ্যযন্ত্র- বেহালা। তার মতো জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানীর যদি বেহালা বাজানোর সময় থাকে, আমরা কেন নিজের বিচারকর্মের পাশাপাশি শিল্পসাহিত্য চর্চাসহ দেশ ও সমাজের জন্য সুশীল চিন্তা করতে পারব না? আমরা দানবের সমাজ গড়তে চাই না, একটি মানবিক মহাসমাজ গড়তে চাই।

জ্ঞান ও শিক্ষা এক নয়। প্রচলিত শিক্ষা না পেয়েও একজন মানুষ জ্ঞানী হতে পারেন। আত্মনিমগ্নতা ও আত্মবিশ্লেষণের পথ ধরেই মুণি-ঋষি, সুফিসাধক ও সন্ন্যাসীরা জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। সে কারণে প্রকৃত জ্ঞানী হওয়ার জন্য আমাদের প্রয়োজন আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মনিমগ্নতা।

আমার প্রতিটি কাজের মধ্য দিয়ে যদি আমার ভেতরের ভালোত্বটা প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তাহলে আমি যে ‘মানুষ’ হিসেবে জন্ম নিয়েছি, সে ঋণটা শোধ হয়। চাওয়া আমারও আছে, কিন্তু তা আমাকে লোভী করে না। লোভ থাকলে প্রতিমুহূর্তেই মনে হতো আমি যা করছি তা উপার্জনের জন্য যথেষ্ট নয়। আমি দাবি করতে পারি, আমি ভালো আছি। আমার কাছে জীবনের প্রতিটা দিনই তাই গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয়।

সব ধরনের অহংবোধ থেকে বিচারকরা নিবৃত্ত থাকবেন এটাই প্রত্যাশিত। যেমনটি রবীন্দ্রনাথ স্রষ্টার কাছে মিনতি করেছেন এই বলে- "আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার তলে। সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে। নিজেরে করিতে গৌরবদান, নিজেরে কেবলই করি অপমান...।"

বিচারক জীবনের প্রারম্ভে চাকরিতে তেমন আগ্রহ পাইনি। অন্যত্র চেষ্টা করেছিলাম। প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি পেয়েও যাই। কিন্তু তত দিনে বিচারপ্রার্থীদের সংস্পর্শে এসে গিয়েছিলাম। তখন থেকেই আর কোনো দ্বিধা কাজ করেনি। বিচারপ্রার্থী মানুষের অসহায়ত্ব দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম, এদের জন্য আমাদের কিছু করতে হবে। আজ জীবনের এই প্রান্তে এসে মা-বাবার প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা বোধ করছি। তারা যদি আমাকে উৎসাহ না দিতেন, তাহলে হয়তো অন্য কোনো পেশায় চলে যেতাম। বিচারপ্রার্থীদের জন্য যা কিছু করেছি, তাদের অনুপ্রেরণাকে পাথেয় মনে করে করেছি। অভিভাবকদের সিদ্ধান্তগুলো কখনো কখনো সন্তানদের ভালো লাগে না। কিন্তু তারা যে উপদেশ দেন বা কথাগুলো বলেন তা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলেন।

মস্তিষ্ক মানুষকে মানুষ বানায়নি। হৃদয় মানুষকে মানুষ বানিয়েছে। বিশ্বজনীন মমতার নিবাস হচ্ছে হৃদয়। এ জীবনে যদি কিছু দিয়ে যেতে পারি, তা আমার মাতৃভূমিকেই দেব। মানুষ হিসেবে আমার জীবন একটাই। জীবনটা যেন অর্থবহ হয়, এটাই আমার ধ্যান-জ্ঞান। স্বপ্নে, কর্মে, উদ্যমে বিচার বিভাগ আরো বিকশিত হোক-এটাই নিরন্তর কামনা।

ব্যথাক্লিষ্ট, দুর্দশাগ্রস্ত মানুষেরা যখন আদালতে আসেন, তখন তারা চরম হতাশাগ্রস্ত। ন্যায়বিচার পেয়ে যখন তারা বাড়ি ফিরে যান, তাদের এই রূপান্তর দেখাটা স্বর্গীয় আনন্দের। বারবার এই আনন্দের দেখা পেতে আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি। সৃষ্টিকর্তা যদি আবার জন্ম দেন (হয়তো দেবেন না), তাহলে বাংলাদেশের মাটিতেই কাজ করতে চাই, বিচার বিভাগেই কাজ করতে চাই।

লেখক: সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ, সাতক্ষীরা

(ঢাকাটাইমস/২২জুলাই/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :