ব্যক্তির মৃত্যু হয়, প্রতিষ্ঠানের নয়

আবদুল গাফফার চৌধুরী
| আপডেট : ২২ জুলাই ২০২০, ১৫:২৫ | প্রকাশিত : ২২ জুলাই ২০২০, ১৩:৫৫

মানুষ মরণশীল। মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছিলেন ‘জন্মিলে মরিতে হবে/অমর কে কোথা কবে’? কিন্তু কোনো কোনো মৃত্যু মানুষকে অমরত্ব দান করে। সেরকম একজন মানুষ যমুনা গ্রুপ, বিশেষ করে যুগান্তর পত্রিকা এবং যমুনা টেলিভিশনের কর্ণধার নুরুল ইসলাম।

তার এক অনুরাগী লিখেছেন, ‘জীবনের বড় বড় যুদ্ধে তিনি জয়ী হয়েছিলেন, চলে গেলেন করোনাযুদ্ধে পরাজিত হয়ে।’ আমার মতে তিনি করোনাযুদ্ধে পরাজিত হননি। করোনায় মৃত্যু তাকে অমরত্ব দান করেছে। তার মৃত্যুতে দেশের মানুষ কেঁদেছে। তার ৪১টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ৫০ হাজার কর্মী চোখের পানিতে তাকে বিদায় দিয়েছে।

তার লক্ষ্যকে তারা আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে তাদের কর্মে। তার নশ্বর জীবন শেষ হয়েছে। অমর, অবিনশ্বর জীবন শুরু হয়েছে। যে মৃত্যুহীন প্রাণ তিনি সঙ্গে করে এনেছিলেন, তিনি সেটাই তার সহযোগী কর্মীদের, দেশের মানুষকে দান করে গেছেন।

ছোট থেকে বড় হওয়া যায়। কিন্তু কত বড় হওয়া যায় তার প্রমাণ রেখে গেলেন নুরুল ইসলাম। মাত্র ৭৪ বছর বয়সে চলে গেলেন। কিন্তু পেছনে রেখে গেলেন অফুরন্ত কীর্তি। ১৯৭৪ সালে তার ব্যবসায়ী জীবনের শুরু। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র দু’বছর পর তিনি যমুনা গ্রুপ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন।

শূন্যহাতে তার যাত্রা, কিন্তু পূর্ণ করে দিয়েছেন একটি নতুন দেশের শিল্পোন্নয়নকে। একে একে ৪১টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান তিনি গড়েছেন। তার জীবনের মাত্র ৪৬ বছরের মধ্যে তিনি গড়ে তুলেছেন দেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য শিল্প-সাম্রাজ্য। তারপর দেশের সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের মানোন্নয়নে হাত দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন দেশের প্রথম শ্রেণির জাতীয় দৈনিক যুগান্তর এবং প্রথম শ্রেণির টেলিভিশন কেন্দ্র যমুনা টেলিভিশন। সারা দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসায়ী মহলে নুরুল ইসলাম আজ একটি নাম নয়, একটি প্রতিষ্ঠান।

১৩ জুলাই তিনি চলে গেলেন। তাতে তার জন্মস্থান নবাবগঞ্জের মানুষও শুধু কাঁদেনি, সারা দেশের মানুষের মনে শোকের আঘাত লেগেছে। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। করোনায় সারা দেশ এখন বিপর্যস্ত। এ সময় দেশের পুনর্গঠনের জন্য তার মতো দক্ষ ও সংগ্রামী শিল্প-ব্যক্তিত্বের দরকার ছিল। একটাই আশার কথা, তিনি একটি যোগ্য ও দক্ষ পরিবার নিজের পেছনে রেখে গেছেন। তারা তার অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব যোগ্যতার সঙ্গে পালন করবেন। তিনি দেশকে যা দিয়ে গেছেন তার কোনো তুলনা নেই। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং মানুষের কর্মসংস্থান তৈরিতে তার কোনো বিকল্প নেই। এশিয়ার অন্যতম বিগ শপিংমল যমুনা ফিউচার পার্ক তার অবদান।

তার এক অনুরাগী মেজর (অব.) সুধীর সাহা তাকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে দেশের শিল্পোন্নয়নে তার অতুলীয় অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন। তার কিছুটা এখানে উল্লেখ করছি। ‘ইলেকট্রনিক্স, বস্ত্র, নিটওয়্যার এবং ওভেন গার্মেন্টস, মোটরসাইকেল, বেভারেজ, টয়লেট্রিজ, যমুনা ফ্যান, এ্যারোমেটিক সাবান এবং পেগাসাস কেডসের মতো জনপ্রিয় বাংলাদেশি ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন তিনি। হবিগঞ্জে গড়ে তুলেছেন একটি শিল্পাঞ্চল।’

তবে মেজর সাহা তার স্মৃতিচারণায় একটি তথ্য দিয়েছেন তা আংশিক সত্য। সম্পূর্ণ সত্য নয়। তিনি জাতীয় পার্টির টিকিটে নুরুল ইসলাম সাহেবের বিদুষী স্ত্রী সালমা ইসলামের ঢাকা-১ আসনে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কথা লিখেছেন। কিন্তু তার পটভূমি লেখেননি। এই পটভূমি আমার জানা। সালমা ইসলাম নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট চেয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী মহাজোটের শরিক হিসেবে ঢাকা-১ আসনটি তখন ছিল জাতীয় পার্টির।

শেখ হাসিনা বলেছেন, সালমা আপনি জাতীয় পার্টির টিকিটে ওই আসনে জয়ী হয়ে আসুন। এখন তো আমরা জাতীয় পার্টির সঙ্গে একই জোটে আছি।’ সালমা ইসলাম তখন জাতীয় পার্টির টিকিটে নির্বাচন করেন এবং জয়ী হয়ে হাসিনা মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। তিনি একজন সফল আইনজীবী। যুগান্তর পত্রিকা পরিচালনায় যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

যুগান্তরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক পত্রিকাটির প্রথম প্রকাশের দিন থেকে। আজ পর্যন্ত যুগান্তরের সঙ্গে আছি। সালমা ইসলাম আমাকে যুগান্তর অফিসে আমন্ত্রণ জানান এবং তার স্বামী নুরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তারা দু’জনে মিলে আমাকে নিয়ে যান যমুনা টেলিভিশন কেন্দ্রে। কেন্দ্রটি তখনও চালু হয়নি। কিন্তু সেই অত্যাধুনিক বিশাল টেলিভিশন কেন্দ্র দেখে অবাক হই। এখন তো দেশের একটি জনপ্রিয় টেলিভিশন কেন্দ্র যমুনা টেলিভিশন।

তারপরও সালমা ইসলাম ও নুরুল ইসলামের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। ঘনিষ্ঠতা প্রায় আত্মীয়তায় পরিণত হয়েছে। যতবার ঢাকায় গেছি যুগান্তর অফিসে আমন্ত্রিত হয়ে যেতে হয়েছে। যুগান্তরের সাংবাদিক ও কর্মীরা আমাকে আত্মীয়ের মতো বরণ করেছেন। দেখা হলেই নুরুল ইসলাম এমন ব্যবহার করতেন, যেন তিনি যুগান্তরের মালিক নন, একজন কর্মী।

তিনি কি রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন? আমার জানা নেই। কিন্তু বিএনপি আমলে তিনি রাজনৈতিক কারণে কারা-নির্যাতিত হয়েছেন, এতটুকু আমি জানি। সঠিক সংবাদ প্রকাশে কোনো বাধা তিনি গ্রাহ্য করেননি। মন্ত্রী ও এমপি হিসেবে সালমা ইসলাম যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। স্ত্রীকে মন্ত্রী ও এমপি হিসেবে বিভিন্ন জনহিতকর কাজে তিনি উৎসাহ ও সাহায্য জুগিয়েছেন।

যুগান্তর আজ দেশের একটি জনপ্রিয় জাতীয় পত্রিকা। এই পত্রিকা আর কিছু নয়, নুরুল ইসলাম-সালমা ইসলাম দম্পতির ব্যক্তিত্বের সম্প্রসারণ। যুগান্তরের মধ্যেই বেঁচে থাকবে নুরুল ইসলাম নামের এক অপরাজেয় মানুষের অমর ব্যক্তিত্ব। তাকে বাংলাদেশের একজন মুঘল-মিডিয়াও বলা চলে। তার মৃত্যুতে শোকাহত হয়েছি। কিন্তু একথা ভেবে সান্ত্বনা পেয়েছি যে, তিনি তার কীর্তির মধ্যে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। তাকে আমরা হারাইনি।

লন্ডন, ২০ জুলাই, সোমবার, ২০২০

সৌজন্যে: দৈনিক যুগান্তর

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :