অন্বেষণ, তপস্যা ও সাধনা ছাড়া শিল্প হয় না: মাসুদ হাসান উজ্জ্বল

প্রকাশ | ২৪ জুলাই ২০২০, ০৮:০৯

শেখ সাইফ, ঢাকাটাইমস

নাটক, টেলিছবি, বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণই তার পেশা। চলচ্চিত্র পরিচালনাও করেছেন। তার প্রতিষ্ঠান ‘রেড অক্টোবর’ থেকে ইভেন্টসহ নানা ধরনের কাজ করছেন নিয়মিত। তিনি নির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করা এই নির্মাতা নাটক, চলচ্চিত্রসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা টাইমসের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ সাইফ।

 

শিল্পাঙ্গনে আপনার পদচারণার শুরুর দিকটা জানতে চাই

 

উজ্জ্বল: আমার মনে হয় জন্ম থেকেই আমি একজন শিল্পী। যেমন সাড়ে তিন-চার বছর বয়স থেকে আঁকাআঁকি করি। কারো উৎসাহ, উদ্দীপনা বা অনুপ্রেরণা ছাড়ায় নিজের খেয়ালে আঁকা শুরু করেছি।

এছাড়া আমি যখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি তখন থেকে গান করি। আমার মনে আছে ক্লাস ওয়ানে থাকতে জীবনের প্রথম রবীন্দ্রসংগীত ‘আহা আজই এ বসন্তে...নিজে নিজে হারমোনিয়ামে তুলেছিলাম। ফলে ওই সময় থেকে গান বাজনা ও ছবি আঁকাআঁকি  শুরু।

এরপর ক্লাস সেভেনে যখন পড়ি তখন ‘তারকোভস্কির ডায়েরি’ নামক একটি বই মেজো আপা আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। তারকোভস্কি পড়তে গিয়ে বুঝতে পারি সিনেমা নিছক কোনো বিনোদনের বস্তু নয়। ঠিক সেই সময় থেকে একটু একটু সিনেমার প্রতি  আগ্রহ তৈরি হয়। এরপর উচ্চ মাধ্যমিক শেষ হওয়ার পর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় পেইন্টিংয়ে ভর্তি হই। পেইন্টিংয়ে পড়াশোনার মাঝেই নাটক লেখা শুরু করি। সেটি একদম নিজের খেয়ালে। হঠাৎ মনে হলো আমি নাটক নির্দেশনা দেব। যেহেতু অনেক বছর ধরে মনের মাঝে চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার একটা বাসনা ছিল।  কিন্তু যখন কাজ শুরু করতে গেলাম তখন দেখলাম আমি মিডিয়ার কাউকে চিনি না। তারপর নিজে কিছু টাকা যোগাড় করে একটা নাটক নির্মাণ করলাম। ওটাই ছিল আমার জীবনের শুরু। সেই নাটকের নাম ছিল ‘যান্ত্রিক ফড়িং এক’। এটি প্রথমে টেলিভিশনে প্রচার হয়নি। তখন প্রত্যেক টেলিভিশন চ্যানেল মন্তব্য করেছিল ‘এই নাটক মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এতো ইন্টেলেকচুয়াল কাজ টিভির জন্য না।’ এরপর আমার দ্বিতীয় নির্মিত নাটক যখন ‘মেরিল প্রথম আলো’ নমিনেশন পেল। তারপরে আমার প্রথম নাটকটা আরটিভিতেপ্রচার করা হয়। এভাবেই আমার পথচলা শুরু।

চলচ্চিত্র নির্মাণে কখন এলেন?

 

উজ্জ্বল: টেলিভিশনের জন্য যে কাজগুলো করছিলাম মূলত চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ না পেয়েই করছিলাম। কাজগুলো ফিল্মের ফরমেট ছিল। আসলে টেলিভিশনের এই এক ঘন্টার নাটকের টার্মটা পৃথিবীর কোথাও প্রচলিত নেই। ফলে আমি এক ঘণ্টার নাটক ফিল্ম হিসেবেই নির্মাণ করতাম। তবে ফিচার ফিল্ম হিসেবে টেলিভিশন মিডিয়াতে ১৫ বছর কাজ করার পর, নাটক ও বিজ্ঞাপনের কাজ করার পর, প্রথম নির্মাণ করলাম ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ নামে একটি ফিচার ফ্লিম। এটিই মূলত সিনেমা হিসেবে নির্মাণ করা আমার প্রথম চলচ্চিত্র।

 

ছবিটি দর্শক কবে পেক্ষাগৃহে দেখতে পাবে?

 

‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ চলচ্চিত্রটি মার্চের ১৩ তারিখ পেক্ষাগৃহে আসার কথা ছিল। কিন্তু মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে মুক্তির তিনদিন আগে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর পরেই তো সিনেমা হলগুলো বন্ধ ঘোষণা করে দেওয়া হয়। আমার ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দর্শক রোজকার চেনা জগতের ভেতরে সম্পূর্ণ নতুন কিছু দেখবে, সেটা মোটামুটি নিশ্চিত করে বলতে পারি।’

চলচ্চিত্রে আপনার আদর্শ বা কাকে অনুসরণ করেন?

 

উজ্জ্বল: প্রথমে বলি ছবি আঁকাআঁকিতে আমি কখনো কাউকে অনুকরণ বা অনুসরণ করিনি। চারুকলায় ভর্তি হওয়ার আগে যখন আমি ইন্টারমিডিয়েট পড়ি তখন ‘সালভাডর ডালি’র পেইন্টংয়ের ওপর খুব অনুপ্রাণিত ছিলাম। কিন্তু ডালির মতো করে কখনো ছবি আঁকার চেষ্টা আমি করিনি। আমার গভীর অনুরাগ ছিল পরাবাস্তব ছবির উপর। আমি যখন নাটক-সিনেমা বানাতে শুরু করি তখন পরাবাস্তব বিষয়গুলো নাটক কিংবা সিনেমাতে ব্যবহারের চেষ্টা করি। আর সিনেমার ক্ষেত্রে আমি খুব বড় ভক্ত আন্দ্রেই তারকোভস্কি, আকিরা ক্রুসাওয়া, ওজো। এমন সব চলচ্চিত্র নির্মাতাদের অনেক ছবি দেখে দেখে একটা সিনেমার এস্থেটিক্স, টেকনিক্যাল বিষয় ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করেছি।

 

বর্তমানে নির্মিত নাটক সিনেমা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কেমন?

 

উজ্জ্বল: আমাদের ছোট একটা ইন্ডাস্ট্রি। এই ইন্ডাস্ট্রির তুলনায় নির্মাতার সংখ্যা বেশি। সৃজনশীল পেশায় যে কেউ আসতে পারে। কাউকে আটকিয়ে রাখা সম্ভব না। এই পেশায় সবচেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে সৃজনশীলতা। সেটা যার আছে, সে যখন সৃজনশীল পেশায় থাকবে। তার কাজ নিয়ে সমালোচনা হতে পারে কিন্তু সেটি খুব বেশি ধর্তব্যের মধ্যে পড়বে না। কারণ প্রকৃত সৃজনশীল মানুষ এক সময় তার সৃজনশীলতার পরিচয় ফুটিয়ে তুলবেই। কিন্তু কথা হচ্ছে এই যে এতো এতো কাজ হচ্ছে সেগুলো যে দেখতে পারি না বা দেখার যোগ্য নয়। সমালোচিত হচ্ছে। এর একমাত্র কারণ সৃজনশীলতার অভাব। এরপর শিক্ষার অভাব। এই বিশেষ বিষয়ের উপর শিক্ষিত হওয়া, সাহিত্য-দর্শন চর্চা। এগুলোর চর্চা ছাড়া আসলে চলচ্চিত্র নির্মাতা সেই অর্থে হওয়া যায় না। সুতরাং এগুলোর যথেষ্ট অভাব নিয়ে যখন কেউ নির্মাতা হয় তখন সবই হয় শুধু নির্মাণটা ছাড়া। এই কারণেই আসলে সমালোচনা হয়।

বর্তমান অভিনয়শিল্পীদের কাজ দেখে অনেকের আপত্তি, এটা কেন?

 

উজ্জ্বল: বর্তমান সময়ের অনেক বড় জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী আছে। তারা নিজেই জানে না যে তার অভিনয় হচ্ছে না। সে খুবই কনফিডেন্ট যে তার হচ্ছে। না তাহলে সে জনপ্রিয়তা পেল কীভাবে? আমাদের দেশ এমন একটি রাষ্ট্র। এখানে ঠিকমত না পারাটায় একটা বিনোদনের বিষয় হয়। তার প্রমাণ আমরা জানি। আমাদের এখানে একজনের অভিনয় হচ্ছে না। তার আনাড়িপনাটাকে হাস্যরস ধরে নিয়েই স্টার বানিয়ে দেওয়া হয়। তাকে কি অভিনয়শিল্পী বলা উচিৎ? এরকম অভিনেতাদের আজকাল স্টার বানিয়ে দিচ্ছে পত্র-পত্রিকা। ফলে আমাদের দেশের দর্শক ও দর্শককে অনুসরণ করা কিছু পত্র পত্রিকা সেই অর্থে দায়িত্বশীল নয় অভিনয় পেশার ব্যাপারে। যার অভিনয় হচ্ছে না বা যার নির্মাণ হচ্ছে না, তাকে আমি প্রচারণায় আনব না। সেই দায়িত্বশীলতাটা নেই। তাকেই প্রচারণার যোগ্য মনে করা হচ্ছে। সবাই তখন সেটাই প্রচার করে।

ধরুন আমি একদম ছোটবেলা থেকে শিল্প সাহিত্য চর্চা করে শিখেছি। এটা আমার রক্তে মাংসে মিশে আছে। আমি সেই শিক্ষার আলোকে নির্মাণ করে যখন সেই অর্থে যথাযত সম্মানিত হচ্ছি না বা আলোচনায় আসছি না। আমাকে কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে, অজনপ্রিয় হয়ে থাকছি। আর অপরদিকে একজনের কিছুই হচ্ছে না। সে কোনো সাধনা করেনি। সেই অর্থে কোনো চেষ্টা করেনি। সে যোগাযোগ বা টাকার জোরে যেভাবেই হোক একটা যা তা নির্মাণ করছে। সেই ভাড়ামো দেখে যখন সবাই মজা নিচ্ছে বাহবা দিচ্ছে। মূল্যায়িত হচ্ছে, সুপারস্টার হচ্ছে। সেটা যদি আমার সন্তান দেখে তাহলে কোনটায় আগ্রহী হবে? শিক্ষা না অশিক্ষা। নিশ্চয় অশিক্ষা। সন্তানরা তো সেই সহজ পথই বেঁছে নিবে।

আসলে আমাদের খারাপের দিকে যাওয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়ে গিয়েছে। যেহেতু সঠিক পথে থেকে মূল্যায়ন হচ্ছে না। তাই যে পথ সহজ, লেখাপড়া জানা লাগে না, নির্দিষ্ট বিষয়ে চর্চা করা লাগে না, দক্ষতা থাকা লাগে না। সেই দিক থেকে তারা স্টার হয়ে যাচ্ছে। এখন তো স্যোশাল মিডিয়াতে ঢুকলেই দেখা যায় বিভিন্ন মানুষ ফানি পোস্ট দেয় সারাদিন ভিডিও করে করে। কারণ তারা বুঝে গিয়েছে এইটা করেই এইদেশে সেলিব্রেটি হওয়া যায়। এই ব্যাঙ্গ করে, ভাড়ামো করে কিন্তু আসলেই তারা মানুষের নজরে চলে আসছে। আর যে ছয় মাস ধরে একটা স্ক্রিপ্ট তৈরি করে, আর্টিস্টকে ছয়মাস ধরে রিহার্সেল করে একটা ভালো সিনেমা নির্মাণ করল। ওইটা দেখবেন প্রচারের আলো পেতে জীবন বের হয়ে যায়। এই হচ্ছে এই দেশের সাংস্কৃতিক কাঠামো।

 

একজন শিল্পী হতে গেলে তার কী জানা দরকার?

 

উজ্জ্বল: প্রথমত উপদেশ দিয়ে একজন শিল্পী হয় না। শিল্পী হওয়া এক ধরনের অনিবার্যতা। নিজের ভেতর যদি শিল্পীসত্ত্বা থাকে, তাহলে আপনার শিল্পীসত্ত্বা  আপনাকে দিয়ে শিল্পী সৃষ্টির জন্য যা যা করা দরকার সেটা করিয়ে নেবে। ভেতরে যদি শিল্পীসত্ত্বা না থাকে তাহলে তাড়নাও থাকবে না। তখন সে অন্যের উপর ভর করে বা টাকা পয়সা দিয়ে শিল্পী হয়ে উঠতে যায়।  একজন প্রকৃত শিল্পী তার শিল্পের স্বার্থে চর্চা করে নিবে। সে সাহিত্য, দর্শন পড়বে। এক্ষেত্রে তাকে কোনো উপদেশ দিতে হবে না। তার শিল্পান্বেষণ তাকে শিল্পের সাথে সম্পর্কিত প্রত্যেকটি শাখায় বিচরণ করাবে। শিল্পের তাড়না শিল্পী তার পথ খুঁজে নেয়।

 

আমাদের নাটক সিনেমার অবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে?

 

উজ্জ্বল: আমরাই আমাদের শিল্পকে সুপথে বিস্তার করতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছি। সেটা কেমন? এই যে এখন আলোচনায় আসা এক ব্যাক্তি। তাকে আমরা এক নম্বর আলোচিত ব্যক্তি বানিয়ে দিয়েছি। দর্শক মিডিয়া তাকে সুপারস্টার বানিয়ে দিয়েছে। আমাদের এই কাজের জন্য পাশের দেশও সুযোগ নিয়েছে। কালচারের মধ্যেও কিন্তু রাজনীতি থাকে। একসময় আনন্দবাজার পত্রিকা বাংলাদেশের এক নম্বর সেলিব্রেটি বলেছিল এই ব্যাক্তিকে। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কি হলো? আমরা দেখাতে পারলাম না যে আমাদের দেশে এক নম্বর সেলিব্রেটি শিল্পী ফজলুর রহমান বাবু, জয়া আহসান, মোশারফ করিম বা চঞ্চল চৌধুরী। যদি এইসব শিল্পীরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রিপ্রেজেন্ট করত তাহলে দেশের সম্মান কতটুকু হতো আর এই ব্যাক্তির রিপ্রেজেন্টেশন কোন অবস্থা তুলে ধরে। সুতরাং আন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের দায়িত্বহীনতার বাই প্রোডাক্ট দিয়ে রিপ্রেজেন্ট হয়ে যাচ্ছি।

অনেকে বলতে পারে আপনার কি নির্মাণ করেন যে আপনাদের কাজ আলোচনায় আসে না। আমাদের কাজ আলোচনায় আসবে কেমনে? শুরু থেকেই বলা হয় আমাদের কাজ মাথার উপর দিয়ে যায়। আসলে মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে না। যাচ্ছে মাথার একটু নিচ দিয়ে। আসলে আপনার তো মাথা নেই, আছে আসলে গলা পর্যন্ত। আমরা কাজটা কোন দর্শন থেকে করি তা তো জানি। একটা সামাজিক বার্তা থাকে, সুন্দর করে উপস্থাপনের তাগিদ থাকে। কিন্তু আমাদের কাজের প্রচারণার বেলায় সেই উত্তেজনা নেই। যেটা এই আলোচিত ব্যক্তির বেলায় থাকে।

উদাহরণ হিসেবে বলি, গাজী রাকায়েতের ‘মৃত্তিকা মায়া’র একটা বিশেষ প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলাম যমুনা ফিউচার পার্কে। ওই ছবি দেখতে আমরা উপস্থিত ছিলাম মাত্র আট জন মানুষ। আর কোনার দিকে একটা ছেলে মেয়ে সম্ভবত টিকিট কেটেছিল ছবি দেখার জন্য নয় প্রেম করার জন্য। মোট দশ জন। আর বাকি প্রত্যেকটা হলে টিকিট সংকটে মারামারি শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেটাও একজন আলোচিত ব্যক্তির একটা ছবি। যেটায় বুক ছিড়ে কলিজা বের করে নিয়ে আসে। ওই সিনেমা দেখার জন্য সেই চরম অবস্থা। ছবিটা নির্মাণ করতে যেয়ে যে হাস্যকর একটা ছবি হয়েছে। কিন্তু ওই হাস্যকরটার জন্যই ছবিটা ব্যবসা সফলতা পেয়ে গেছে। কিন্ত যে ‘মৃত্তিকা মায়া’ দেশ-মাটি নিয়ে করা। যেখানে সঠিক অভিনয় আছে, নির্দেশনা আছে সেই ছবির দর্শক সংখ্যা দশ জন। একটা পুরস্কার প্রাপ্ত ছবির এই অবস্থা। এই ছবি দেখতে যাওয়ার দায়িত্বশীলতা দর্শকের নেই। ভালো ছবি বানানো এই দেশে অপরাধ। ভালো ছবি মানুষ দেখে না। আমাদের ছবিকে বলে আমরা নাটক বানাই। তাহলে কলকাতার ছবি কি? এই এক ঘণ্টার  নাটকের কনসেপ্ট শুধু আমাদের দেশে আছে। তারমানে সিনেমাটা টেলিভিশনে তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এখন সমস্যা হচ্ছে এই ফরমেট যখন দর্শক টেলিভিশনে দেখে তখন সিনেমা হলে গিয়ে অদ্ভুদ কিছু আসা করে।

 

কলকাতার মতো চলচ্চিত্র এখানে নির্মাণ হচ্ছে না কেন?

 

উজ্জ্বল: তাদের তো আমাদের দেশের মতো সংকট নেই। কারণ তাদের এক ঘন্টার নাটকের কনসেপ্ট নেই। তারা স্টার জলসা বা জি বাংলায় যেসব সিরিয়াল দেখায় সেটা সিনেমার ফরমেট না। সুতরাং তারা এক ঘন্টা বা দেড় ঘণ্টার জন্য যা নির্মাণ করে সেটাকেই সিনেমা মনে করে। সেটা ওদের দর্শক দেখে সিনেমা হিসেবেই। সেই একই ফরম্যাটে যখন কোনো বাঙালি একটা নির্মাণ করে তখন হলে গিয়ে দেখে বলে, বড় একটা টেলিফিল্ম দেখে আসলাম। আসলে আমাদের দেশের দর্শক অদ্ভূত কিছু একটা আশা করে হলে গিয়ে। কারণ বাঙালি নির্মাতা তো ধরা খেয়েছে টেলিভিশন নাটকের কাছে। ইরানি ফিল্মের যে ধরনের ন্যারেটিভ, কলকাতার অলটারনেটিভ মুভির যে ন্যারেটিভ একই ধরনের ন্যারেটিভ আমাদের টেলিভিশন নাটকেও হচ্ছে।

সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশের দর্শক এখনো হলে এসে আশা করে নায়ক উড়ে এসে ঘুসি মারবে। দুইটা আইটেম সং হবে। জোরে জোরে চিৎকার করে সংলাপ বলবে। তাহলেই মনে করবে সেটি সিনেমা। অথচ বোম্বেতে এই ফরমেটের সিনেমা ফ্লপ করছে। এমনকি হলিউডের স্টাইলও বদলে গিয়েছে। বদলটা কেমন? খোদ একটা হলিউড ছবিকে অস্কার না দিয়ে বিদেশি ভাষার একটা ছবিকে প্রধান অস্কার পুরস্কারের সিনেমা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ কি? কারণ হচ্ছে এখন দুনিয়া প্যরাসাইটের দিকে যাচ্ছে। বাস্তবতা দর্শনের দিকে যাচ্ছে। আমাদের দেশে ১৯৯৯ সালের দিকে এই ফরমেটের নাটক হতো টেলিভিশনে। আমরা টেলিভিশন নাটকে বিশাল অগ্রসরমান ছিলাম। আজ থেকে পনের-বিশ বছর আগে বাঙালি নির্মাতারা যা বানিয়েছে এখন সারা বিশ্বে সেই ধরনের ন্যারেটিভ ফিল্ম বড় বড় উৎসবে যাচ্ছে। সেই ধরনের পুরস্কারও অর্জন করছে।

আমরা আগের সেই নাটকগুলোকে মূল্যায়ন করিনি। সেইভাবে প্রচার করিনি। আসলে এগুলোকে নাটক নাম দিয়ে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আরও একটি সত্য কথা যে এইসব নির্মাতারা কোনোভাবেই এফডিসি কেন্দ্রিক পরিচালনার সুযোগ পাচ্ছিলেন না।  প্রডিউসার নেই, অনুদান নেই, ঢোকার কোনো রাস্তা নেই। আমরা যেমন এফডিসিতে ঢোকার সময় খুব সম্মান পাই। আমি চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে এফডিসিতে যে দাম পেয়েছি তার চেয়ে অধিক সম্মান পেতাম যখন বিজ্ঞাপণ নির্মাতা হিসেবে কাজ করতাম। ফ্লোর ভাড়া করে বড় বড় সেট নিয়ে কাজ করতাম তখন। অনেক বড় বাজেটের কাজ। তখন এফডিসির গেটে দাঁড়ালেই  প্রচুর সালাম পেতাম। কিন্তু দেশের বাইরে বিজ্ঞাপণ নির্মাতাদের সেইভাবে কেউ চেনেই না। সে যত বড়ই বিজ্ঞাপণ নির্মাতা হোক। কিন্তু আমাদের দেশে চলচ্চিত্র পরিচালকের চেয়ে বিজ্ঞাপন নির্মাতার মূল্যায়ন বেশি।

তরুণ নির্মাতা বা অভিনয়শিল্পীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।

 

উজ্জ্বল: অন্বেষণ, তপস্যা ও সাধনা এই তিনটা বিষয় ছাড়া শিল্প হয় না। সুতরাং শিল্পের অন্বেষণ করতে হবে, তপস্যা করতে হবে, শিল্পের সাধনা করতে হবে। সেটা করতে গেলেই শিল্পের শিক্ষাটা ঠিকমত হবে। যখনই শিল্পের শিক্ষা ঠিকমত হবে তখনই শিল্পের প্রয়োগটাও ঠিকমত হবে। সুতরাং নতুন যারা আসবে তাদের এটা মাথায় রেখেই এগিয়ে যাওয়া উচিৎ।

আপনাকে ধন্যবাদ

উজ্জ্বল: ঢাকাটাইমস ও আপনাকেও ধন্যবাদ

ঢাকাটাইমস/২৪জুলাই/এসকেএস