মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় ও উত্তরণ ভাবনা!

প্রকাশ | ২৪ জুলাই ২০২০, ১২:২৫

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার

করোনার সাথে স্বল্প মেয়াদে বসবাসের অপ্রত্যাশিতভাবে সিদ্ধান্ত পৃথিবী ইতোমধ্যে নিয়ে ফেলছে। ক্ষমতাধরদের ক্ষমতা ম্রিয়মাণ হয়ে যাবে ভেবে কোনো বিশ্বনেতা এটা মুখে না বললেও বিশ্বের সব প্রান্তের আমজনতা তা বুঝতে শিখেছে। খুব সহজে স্বল্পতম সময়ে আমাদের মুক্তির কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। করোনা মোকাবিলায় ভ্যাকসিন সহজলভ্য হবার আগ পর্যন্ত যতটা শারীরিকভাবে প্রতিরোধের লক্ষ্যে ইমিউন সিস্টেম বাড়ানোর প্রতি সবাইকে গুরুত্ব দিতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, তা ভালো পরামর্শ নিঃসন্দেহে। সেই সাথে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ- ভাবনাটিতে আমরা ভাসা ভাসা আলাপ রাখছি সবাই, কিন্তু যতটুকু গুরুত্ব দিয়ে ভাবা প্রয়োজন তা করছি বলে সরকারি- বেসরকারীভাবে খুব একটা দৃশ্যমান চেষ্টার নজির আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

আমাদের স্বভাব হলো বিপদের মুখে না পড়া পর্যন্ত আমরা কোনো কিছুকেই গুরুত্ব সহকারে আমলে নিতে অভ্যস্ত নই। আবার কারো কারো কাছে ভার্চুয়াল ইনটেলেকচুয়ালকে অলিক বা কাল্পনিক বলে হেয়প্রতিপন্ন করবার মনোভাব আমাদের দেশে খুব লক্ষণীয়। কারণ সবকিছুতেই আমরা নিজেদের চেষ্টাকে অব্যাহত রেখে ভাগ্যবিধাতাকে স্মরণ করা আর তার সাহায্য চাওয়ার চেয়ে নানা রকমভাবে সেটা শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার ওপর ছেড়ে দিতে খুব গর্ব অনুভব করি। অথচ ধর্মমতেও আমরা জানি, যে জাতি তার নিজের ভাগ্য পরিবর্তনে চেষ্টা করে না স্বয়ং  মহান সৃষ্টিকর্তাও তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে এগিয়ে আসেন না। যেকোনো সংকটে কিছু মানুষ মনুষ্যচেষ্টাকে রীতিমতো নিরুৎসাহিত করে কিছু ধর্মভীরু সরল মানুষকে তাদের সমর্থনের পুঁজি বা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। মানুষের কোনো চেষ্টা দ্বারা সংকটমুক্তি সম্ভব নয়, এটা বিজাতীয়দের ওপর গজব- এ রকম নানা ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে কর্মচেষ্টায় ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা চালায়।

কী দুর্ভাগ্য আমাদের, একজন মানুষের সফলতা যা সৃষ্টিকর্তার বিশেষ আশীর্বাদ ও অমূল্য দান, যা কেবলমাত্র তার ধর্মমতের মানুষের হাত ধরে আসেনি বলে তাকে অধর্ম বলে ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করায় কি ধর্মীয় প্রশান্তি লাভ করা যা্‌ তা আমার এই ক্ষুদ্রজ্ঞানে জানা নেই। যেখানে সৃষ্টিকর্তা নিজে কোনো জাতি-গোষ্ঠির কাতারে তাকে কখনই একীভূত করেননি, বরং তিনি সকলের এবং কোনো খণ্ডের না সমগ্র বিশ্ব-ভ্রম্মাণ্ডের শ্রষ্টা। আর কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকেও তিনি সৃষ্টির সেরা জীব ঘোষণা না করে বরং সমগ্র মানবজাতিকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

দুই থেকে পাঁচ বছর সময়ের মধ্যে অনিবার্যভাবে যদি আমাদের করোনার সাথে বাস করতেই হয়, সেক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভাবনাটিতে বিশ্বের সব মানুষকেই একমতে পৌছাতে হবে- আমরা মানসিক রোগী হয়ে বেঁচে থাকতে চাই কি না? কিংবা জনসংখ্যার একটি বড় অংশ যারা ক্ষুধা-দরিদ্রতা, বিষাদ-অবসা্‌ অপুষ্টির শিকার হয়ে চিত্তে বিকারগ্রস্ত হবেন, তাদে্র নিয়ে একসাথে পরবর্তী পথ চলতে চাই কি না? আসলে আমরা কেউই এটা চাই না।

দিনের পর দিন মাসের পর মাস কিংবা বছর জুড়ে যদি এভাবে বাস করতেই হয়, তাহলে এ শঙ্কা উড়িয়ে না দিয়ে বরং বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে শারীরিক ইমিউন সিস্টেম বাড়ানোর পাশাপাশি মনস্তত্ত্ব বিকাশে করণীয় ঠিক করতে হবে এবং বাস্তবায়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা নিতে হবে।

কাজটি সহজ নয়  বলেই একটু অগ্রিম ভাবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। চিত্ত সুন্দর-সরল, সুস্থ্-সবল ও অধিক কার্যকর রাখার জন্য করণীয় ঠিক করে কাজ শুরু করতে হবে। খাবার-দাবার বেশ খানিকটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এ ক্ষেত্রেও, তবে কেবল খাওয়া-দাওয়া পুষ্টিকর করাটাই যথেষ্ট নয়, সেই সাথে প্রয়োজন- পরিবারচর্চায় আমাদের উচিত হবে কেউ যেন কাউকে ছোট করে না দেখি, মনে কষ্ট পায় এমন আচরণ সম্পূর্ণভাবে পরিহার করতে হবে। নিজের চেয়ে অন্য সদস্যদের গুরুত্বকে প্রাধান্য দিতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে খুব সতকর্তার সাথে তাদের মন-মেজাজ বুঝে আচরণ করতে হবে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখার ক্ষেত্রে কোনো রকম ভীতিকর  পরিবেশ, আচরণ না করে সুন্দর আচরণ দিয়ে ছাত্র-শিক্ষক প্রকৃত বন্ধু হতে হবে। এটি অনিবার্য ও অবিকল্প। প্রত্যেককে শ্রেণিশিক্ষার মধ্য দিয়ে সুন্দর সুস্থ স্বাভাবিক মানবিক  মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে হবে।

সমাজচরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। অমূলক অন্যায্য সবকিছুকে পরিত্যাজ্য করতে হবে। সমাজ শাসনে বর্তমান চিত্র পরিবর্তন করে ভালো মানুষের হাতে সমাজকে তুলে দিয়ে তাদের দায়িত্বপালনে দল-মতনির্বিশেষে সব নাগরিককে একাত্ম হয়ে সহায়তা করতে হবে। অশিক্ষিত, বর্ব্‌র, অযোগ্য,  সন্ত্রাসী, সাম্প্রদায়িক চরিত্রের মানুষের কাছ থেকে সমাজকে মুক্ত করে নতুন দিগন্ত উন্মোচন বড়ই প্রয়োজন।

এভাবে রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গে ব্যাপক পরিবর্তনের কথা ভাবা দরকার। এমন নীতিমালা তৈরি করা দরকার  যাতে অযোগ্য লোক দ্বারা যোগ্য নাগরিক সেবার প্রত্যাশা করার প্রয়োজন না হয়। যারা জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করবেন, সেটি যে স্তরেই হো্ক‌ সেটার নীতিমালা এমন হওয়া দরকার যেন অসম্মানীয় লোক দ্বারা সম্মানীত ও সাধারণ নাগরিকের কোনো সেবা গ্রহণের প্রয়োজন না হয়।

শুধু দুর্ব্যবহার করার যথাযথ শাস্তির আইনগত ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে,  যাতে করে মানুষ খারাপ আচরণ করতে গেলেও উপযুক্ত শাস্তি, জরিমানা গুনতে হয় বা জেল খাটার প্রয়োজন হয়।

আইন মানার প্রতি সবাইকে উৎসাহিত করতে হবে, সব নাগরিকের কাছে এটি একটি পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে মানুষের মধ্যে নৈতিক বোধের জন্ম দিতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের চেতনায়ও ব্যাপক পরিবর্তন আনতে যা যা করণীয় তা করতে হবে। তারা যেন নাগরিকদের সাথে চমৎকার আচরণ করতে বাধ্য থাকেন। এ রকম একটি সংস্কৃতি নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে POLICE  শব্দটির বিশেষণগুলো আয়ত্ত করে দ্রুত সেটি কার্যকর করা গেলেই ভালো। কারণ পরবর্তী সময়টাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো বেশি জটিল পরিস্থিতিতে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে।

মালিক-কর্মচারী তথা শিল্পক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাগুলো খুব নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে সেখানেও আর্থিক ও ব্যবহারিক আচরণকে খুব বেশি মানবিক করার প্রয়োজন হবে।

শ্রম খাতের সব স্তরে বিশেষ করে যেসব সেক্টরে অশিক্ষিতি বা স্বল্প শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বেশি, সেখানেও ব্যবহারিক আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন অনিবার্য্য। যেমন পরিবহন সেকটর।

সেই সাথে পুরো মানব সমাজের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন আনয়নের লক্ষ্যে সংস্কৃতিকর্মীদের খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার প্রয়োজন  বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত কার্যক পদক্ষেপের আশু প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে ইতোমধ্যেই।

ভুলে গেলে চলবে না, এ রকম অংশদারত্ব যাদের আছে, সবাই কম-বেশি নাগরিক দায়িত্ব মাথায় রেখেই এগুতে হবে। নাগরিক দায়িত্ব নিয়ে উন্নত বিশ্বে গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে হাঁটতে যে শাখাটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারে তা হলো একটি দেশের সামাজিক সাংস্কৃতিক অঙ্গ।

আজকের শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যারা দেশের জন্য নিবেদিত, তাদের উচিত হবে খুব শিগগির বাংলা নিজস্ব সংস্কৃতি ২০৪০ সালে গিয়ে কেমনভাবে উপস্থাপিত হবে বিশ্বদরবারে, সে লক্ষ্যে সরকারের সাথে এমনকি সরকারের বাইরেও যারা কাজ করছে, অর্থাৎ যারা নাগরিক তৈরিতে এবং কল্যাণমুখী সমাজ গঠনে প্রকৃত অর্থে কাজ করছেন,  তাদের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ২০২০-৩০ পর্যন্ত সংস্কৃতিকর্মিরা কোন্ পরিকল্পনা অনুযায়ী কীভাবে এ পথ পরিক্রমা বিচরণ করে কাঙ্খিত একটা সাফল্যে পৌঁছুবে,  আবার ত্রিশে গিয়ে সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব কষে পরবর্তী ১০ বছরে যেন কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে সে রকম একটা খসড়া রুপরেখা তৈরি করা। সে অনুযায়ী  যদি দেশের সকল সাংস্কৃতিক কর্মীকে অবগত করা যায় তাহলে সকলের প্রচেষ্টায় একটি কাঙ্খিত সাংস্কৃতিক চেতনায় উদ্দীপ্ত নাগরিক সমাজ উপহার দেয়া যেতে পারে; উন্নত বিশ্ব  যাতে সাংস্কৃতিক সুবোধ সম্পন্ন সুন্দর নাগরিক সমাজ উপহার পায়।

চরম বাস্তবতায় সরকারি ব্যবস্হাপনায় কিছু শক্ত সিদ্ধান্ত নেবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে এবং তার সম্ভাবনাও রয়েছে।  নতুন ও সুন্দর আগাম দিনের কল্যাণে আমাদের সহনশীল থেকে সরকারকে সাধুবাদ জানিয়ে তা সবার মঙ্গলে প্রতিটি নাগরিককে কায়মনোবাক্যে সহযোগিতা করতে হবে। কেননা করোনা  শিক্ষায় যেকোনো একজন নাগরিকের অবহেলাই যথেষ্ট নতুন করে সবার প্রতি আঘাত করা।

সম্ভাব্য যা চিন্তা করা যেতে পারে-

নতুন করে জন্মনিয়ন্ত্রণে সাময়িক আদেশনামা জারি। যৌতুক শব্দই নতুন সংস্কৃতিতে থাকবে না। বয়স্ক বাবা-মায়ের জন্য ছেলের বেতনের একটা অংশ সরাসরি বাবা-মায়ের তহবিলে চলে যাবে সরকারিভাবে। শিক্ষাব্যবস্হা ভীতিকর না হয়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্য মানসিক উৎকর্ষ বিকাশে একটু গুরুত্ব বেশি রেখে সিলেবাস তৈরি এবং তা বন্ধুবৎসল পরিবেশে সুখকর পাঠদানের ব্যবস্হা করা।

এ রকম বেশ কিছু সিদ্ধান্ত আংশিক হলেও নতুন করে ভাবা যেতেই পারে; কারণ করোনা-পরবর্তী পথচলার ক্ষেত্রে সব ভাবনা কেবল মানুষের কল্যাণ মাথায় রেখেই ভাবতে হবে।

ধর্মকর্ম পরিপালনেও কিছু দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা জরুরি। যারা এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবেন তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতি মাথায় নিয়ে নতুন করে সবার কল্যাণ সাধিত হয় এমন বিষয়গুলো বিশেষভাবে গুরুত্ব দেবেন। মাইনাসে মাইনাসে প্লাস বাদ দিয়ে কেবল প্লাসে প্লাসে প্লাসকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে  চর্চা করাটাই বেশি যুক্তিসংগত হতে পারে। কোনোভাবেই ধর্মের নামে কোনো অধর্ম সমর্থন করার চিন্তাও করা যাবে না। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও সুন্দর মনস্তত্ত্ব গঠনে ধর্মীয় অমিয় বাণী অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ এটি মানুষের বিশ্বাসের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।

পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্রছাত্রী বা সন্তানদের কাদামাটির আদলে পায় বলে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে  অবিভাবক ও শিক্ষকরা বাচ্চাদের  সম্ভাবনা ও প্রতিভার বিচারে এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজন বিবেচনা করে যে অঙ্গনে যা লাগবে সেভাবে পরিকল্পিত সুনাগরিক গড়ে তোলার কাজটি নিজের পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে নিতে হবে।

সাংস্কৃতিক কর্মীরা সুনাগরিক এবং সুস্থ ও সুন্দর মানসিক উৎকর্ষ সহায়ক আধারগুলো একটু বেশি বিবেচনায় নিয়ে তাদের কর্মকাণ্ডকে প্রজন্মের চলার পথের দিশারি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে উপস্থাপন করবেন সেটা খুবই কার্যকরি হবে। সর্বোপরি সম্প্রীতির উৎকর্ষ সাধনে জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে সবাইকে একাত্ম হয়ে অনুসরণ করার মতো উদাহরণ তৈরি করতে হবে। সবার সমবেত ও স্বতঃস্ফূর্ত এগিয়ে আসার চেষ্টা দিয়ে সুস্থ মানুষের আগামী দিন নিশ্চিত করতে হবে- তেমন প্রত্যাশা ও নিবেদন রাখছি।

 লেখকঃ পুলিশ সুপার। গীতিকবি, প্রাবন্ধিক ও কণ্ঠশিল্পী

(ঢাকাটাইমস/২৪জুলাই/মোআ)