দৃষ্টিহীন কবিরের আলোকিত পৃথিবী

আতিক ওয়া খান
 | প্রকাশিত : ২৪ জুলাই ২০২০, ১৮:০৪

মসজিদের দোতলায় নামাজের নিয়ত বাঁধতে যাব, হঠাৎ খেয়াল করলাম, একটা ব্লাইন্ড স্টিক ভাঁজ করে মেঝেতে রেখে কেউ একজন পাশে এসে দাঁড়ালো। নামাজে মনোযোগ দেওয়া একটু কঠিন হয়ে গেল। নামাজ শেষে লোকটার জন্য অপেক্ষা করলাম। সে তার স্টিক খুলে নিয়ে সুন্দর করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো। নিচে নেমে লোকটা মিনিট দশেক সাহায্যের জন্য দাঁড়ালো। লোকটা সম্পর্কে জানতে ভীষণ কৌতূহল পেয়ে বসল।

দুই চারজন পাশ কেটে যাবার সময় অর্থ সাহায্য দিচ্ছিল। লোকটা দিব্যি নোটগুলো ধরে বলে দিচ্ছিল কত টাকার নোট। টাকার লেনদেন দেখে বুঝার উপায় নেই লোকটা অন্ধ। আল্লাহ যখন কাউকে কোনদিক দিয়ে দুর্বলতা দেন, অন্যদিক থেকে অনেক সময় কিছু ইন্দ্রিয় ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেন।

জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম কি? একটু থতমত খেয়ে বলল, কবির হোসেন। কেউ আসলে নাম জিজ্ঞেস করে না, তাই অবাক হইছি। বললাম, চলুন হাঁটি। অনেক কিছু জানলাম, সংক্ষেপে বলি।

ছোটকালে ২-৩ বছর বয়সেই টাইফয়েডে অন্ধ হয়ে যায় কবির হোসেন। গ্রামে ঠিকমত চিকিৎসা পায়নি বেচারা। গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে এরপরই মা মারা যায়। অন্ধ ছোট্ট কবিরকে নিয়ে মায়ের আফসোসের সীমা ছিল না। অনেক কষ্ট নিয়ে বিদায় নেন মা। বাবা আরেকটা বিয়ে করায় অন্ধ বাচ্চাটার দায়িত্ব তুলে নেন ওর ফুফু। আর ৩ জন ফুফাত ভাই বোনের সাথে বড় হতে থাকে কবির। ফুফু দুঃখ করে বলতেন, আমি দুনিয়া ছেড়ে গেলে তোর কি হবে রে কবির? তোকে যে কোনোভাবে নিজ পায়ে দাঁড়াতে হবে।

ফুফু উনার এক ছেলের সাথে প্রতিদিন কবিরকে বাজারে পাঠাতেন লাঠি হাতে। সেই থেকে পথ চিনতে শিখা। এভাবে চলতে চলতে পথের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠল। ব্রেইল পদ্ধতির সাথে পরিচয় না থাকায় পড়ালেখা শিখা হয়নি কবিরের। একটা দরিদ্র পরিবারের অসহায় মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে ফুফু মারা যান। মেয়ের পরিবার কয়েক জায়গায় ধাক্কা খেয়ে বুঝেছিল চোখ আছে এমন অনেকের চাইতে কবির অনেক বেশি বিশ্বস্ত ও ভাল স্বামী হবে। ভিক্ষা করেই ওর জীবন চলে যাচ্ছে। ও নিজেই ওর টাকা পয়সা সামলায়। ওর বউ অবশ্য নানা রকম কাজ করে সাহায্য করেছে দরকারে।

বললাম, তুমি যে দেখতে পাওনা, আফসোস হয়না?

জি না। যেইসব ঘটনা শুনি চারিদিকে, মনে হয় - না দেইখাই ভাল আছি। যারা দেখে তারাও তো কতরকম কষ্টে আছে। আমি তো সেই তুলনায় ভাল আছি।

তুমি না দেখে কখনো বিপদে পড় নাই? লাঠি নিয়ে হেঁটে বেড়াও?

জি না। ২০ বছর চট্টগ্রাম শহরে ঘুরে বেড়াই। বিপদে পড়ি নাই। একবার শুধু ম্যানহোলে পইড়া গেছিলাম। কেউ উঠায় নাই। নিজে নিজেই লাফাইতে লাফাইতে কাছা ধরছি, তারপর উইঠা পড়ছি।

অবাক হলাম। একটা অন্ধ লোক এত বছর কারো সাহায্য ছাড়াই চলছে। আর আমরা অনেকে সব কিছু থাকার পর ও কিছু করি না, করতে ভয় পাই, সাহায্যের জন্য বসে থাকি।

বাসার সামনে এসে পড়েছি। কিছু সাহায্য এনে দিলাম। কবির আবেগাক্রান্ত হয়ে বলল, ভাইজান, টাকা পয়সা অনেকেই দেয়। কিন্তু কেউ ২ মিনিট সময় দেয় না। আমাকে কথা বলার যোগ্য মনে করে না। আমার খুব বেশি ভাল লাগতেছে, আপনি এতক্ষণ আমার সাথে কথা বলতেছেন।

মনটা হটাত খুব ভাল হয়ে গেল। পাপী জীবনে অল্প ২/১ টা যদি পূণ্য করে থাকি মনে হল, এটা তার একটা।

দুটো সুখবর দিয়ে শেষ করি, অন্ধ কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে ছোট্ট এক টুকরো জমি পেয়েছে কবির, যেখানে ছোট্ট একটা ঘর তুলে থাকতে পারবে, ঘর তোলার টাকা জমছে ধীরে ধীরে আর ফুটফুটে ২ টা ছেলেমেয়ে আছে কবিরের, সম্পূর্ণ সুস্থ। ওরা স্কুলে লেখাপড়া ও করে!

লেখক: মেরিন অফিসার

ঢাকাটাইমস/২৪জুলাই/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :