তিন মাসেই বিকল সেই রেলইঞ্জিন, মেরামতের ৩ কোটি নিয়ে প্রশ্ন

বোরহান উদ্দিন, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২০, ২২:৫৮ | প্রকাশিত : ২৮ জুলাই ২০২০, ১৪:১৪

দুর্ঘটনায় পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়া রেলের যে লোকোমোটিভ ইঞ্জিন তিন কোটি খরচে মেরামত করে লাইনে দেওয়া হয়েছিল তিন মাস না যেতেই সেটি একেবারে বিকল হয়ে গেছে। মেরামতের সময় ৪টি ট্রাকশন মোটরের পরিবর্তে দুটি লাগানোর কারণেই ইঞ্জিনটি বিকল হয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর এমন কাজ করতে গিয়ে সেই তিন কোটি টাকার নয়ছয় হয়েছে কি-না তা নিয়েও কানাঘুষা রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতো, ২০১৩ সালে জাপান সরকারের আর্থিক সহায়তায় এমইআই-১৫ শ্রেণির ১১টি ইঞ্জিন আমদানি করা হয়। উন্নতমানের ওই ইঞ্জিনগুলো দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানিতে তৈরি। এসব ইঞ্জিন দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ট্রেন পরিচালনা হচ্ছে।

২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর ঢাকা-সিলেট রুটে আন্তঃনগর পারাবত ট্রেনটিকে ২৯৩৩ নং ইঞ্জিনটি টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। হবিগঞ্জের মাধবপুর নোয়াপাড়া স্টেশনে ওই ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনায় পড়লে ইঞ্জিনটির নিচের অংশের জ্বালানি ট্যাংকে আগুন লেগে সম্পূর্ণ বিকল (ড্যামেজ) হয়ে পড়ে।

পুড়ে যাওয়া ইঞ্জিনটি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ডিজেল শপে পাঠানোর পর সেখানে পুরোপুরি মেরামত সম্ভব না হওয়ায় ২০১৯ সালের ১৫ মে মেরামতের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের ইঞ্জিন মেরামত করার কেন্দ্রীয় লোকমোটিভ কারখানায় (কেলোকা) পাঠানো হয়।

চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রথমবারের মতো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়া রেলের সেই লোকোমোটিভ ইঞ্জিন ৩ কোটি টাকা খরচ করে পুরোপুরি সচল করে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল রেল বিভাগ। এরপর রেলের বহরে যুক্ত করা হয় ২৯৩৩ নম্বর ইঞ্জিনটি। কিন্তু গত তিন মাসে বার বার বিকল হয়ে পড়া ইঞ্জিনটি এখন পড়ে আছে।

অভিযোগ উঠেছে, পুড়ে যাওয়া ইঞ্জিনটিতে মেরামতের সময় নতুন ৪টি ট্রাকশন মোটর দেওয়ার কথা বলা হলেও মূলত দুটি ট্রাকশন মোটর লাগানো হয়েছে। ফলে দ্বিতীয়বার মেরামত করা হলেও ১১ দিন পর নষ্ট হয়ে ১৮ জুলাই ইঞ্জিনটি পার্বতীপুর লোকশেডে বিকল হয়ে পড়ে।

কেলোকার মেরামত কাজের শিডিউল ইনচার্জ গোলাম মোস্তাফা বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, বিকল হয়ে পড়ায় ২১ জুলাই ইঞ্জিনটিকে কেলোকাতে পাঠানো হয়েছে। এবারও ট্রাকশন মোটরের সমস্যা হয়েছে। বর্তমানে ইঞ্জিনটি বিকল হয়ে পার্বতীপুর কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানায় পড়ে আছে।

এদিকে কি কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো তা জানতে রেলের দায়িত্বশীল উর্ধতন কর্মকর্তারা কাজ শুরু করেছেন। প্রকৃত অর্থে কয়টি ট্রাকশন মোটর লাগানো হয়েছে, কোথা থেকে, সেসব কত টাকায় কেনা হয়েছে এসব জানতে তদন্ত কমিটি হচ্ছে বলেও গুঞ্জনও আছে।

মেরামতের পর বার বার বিকল

দীর্ঘ ৮ মাসের পরিশ্রমে দেশে প্রথমবারের মতো পুরোপুরি নষ্ট হওয়া ইঞ্জিনটি সারিয়ে তুলতে সক্ষম হয় কেলোকা। এতে খরচ হয়েছিল ৩ কোটি টাকা। একটি নতুন মিটারগেজ ইঞ্জিন আমদানিতে খরচ হতো ৩৩ কোটি টাকা। ফলে বিকল ইঞ্জিন সচল করে প্রশংসিত হয়েছিল কেলাকো।

কেলোকার শিডিউল ইনচার্জ গোলাম মোস্তফা জানান, ২০১৯ সালের ১৫ মে ২৯৩৩ ইঞ্জিনটি কেন্দ্রীয় লোকমোটিভ কারখানাতে মেরামতের জন্য পাঠানো হয়। চলতি বছরের মার্চ মাসে এটি ঠিক করে রেল বহরে যুক্ত করা হয়। কিন্তু গত ২৮ জুন তিনমাস চলার পর এটি নষ্ট হয়ে যায়।

তিনি বলেন, ‘এটি আবার মেরামতের কেলোকাতে পাঠালে ইঞ্জিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ ট্রাকশন মোটরের ত্রুটি ধরা পড়ে। মেরামত করে এটিকে সারিয়ে তোলা হয়। এরপর ৭ জুলাই আবার ট্রেন পরিচালনায় যুক্ত করা হয়। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেন পরিচালনার কাজে এটি ব্যবহার হয়ে আসছিল। দ্বিতীয়বার মেরামতের ১১ দিন পর আবারও গত ১৮ জুলাই ইঞ্জিনটি পার্বতীপুর লোকশেডে বিকল হয়ে পড়ে।’

লোকশেডের ইনচার্জ কাফিউল ইসলাম জানান, ট্রাকশন মোটরে বড় ধরণের সমস্যা ধরা পড়ায় এখানকার ইলেকট্রিক মেশিন (ইএম) বিভাগের কর্মীরা ইঞ্জিনটি ঠিক করতে ব্যর্থ হয়। পরে এটাকে কেলোকেতে পাঠানো হয়।

২১ জুলাই থেকে ইঞ্জিনটি কেলোকা লোকমোটিভ কারখানায় আছে বলে জানিয়েছেন কেলোকার মেরামত কাজের শিডিউল ইনচার্জ গোলাম মোস্তাফা।

ট্রাকশন লাগানো নিয়ে প্রশ্ন

কেলোকার গোলাম মোস্তফা জানান, একটি ইঞ্জিনে ৪টি ট্রাকশন মোটর থাকে। ২৯৩৩ নম্বর ইঞ্জিনটির সব কটি ট্রাকশন মোটরই অকেজো ছিল তাই চারটিই নতুন ট্রাকশন মোটর কিনে লাগানো হয়। যে কারণেই ইঞ্জিনটি ঠিক হয়ে যায়।

তবে মাত্র তিন মাসের মধ্যে দুইবার কি কারণে বিকল হয়ে পড়লো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মেশিনারিজ যে কোনও সময় ফেইল করতে পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না।’

তবে ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন পার্বতীপুরের কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা কেলোকার তখনকার ট্রাকশন মোটর কাজের ইনচার্জ রফিকুল ইসলাম।

বর্তমানে অবসরে থাকা রফিকুল জানান, প্রথমবার ৪টি নয় মাত্র ২টি ট্রাকশন মোটরের কাজ করা হয়। একটি ট্রাকশন মোটর নতুন দেয়া হয়। আরেকটি সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় একটি পুরাতন ট্রাকশন মোটরকে মেরামত করে ইঞ্জিনটিকে সচল করা হয়। ইঞ্জিনটির ২টি ট্রাকশন তখন ভালো ছিল।

তিনি বলেন, ‘এই রেল ইঞ্জিনের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশটির বেশীরভাগই বহু পুরানো। মেরামত করেই চালানো হয়। প্রথমবার পরিবর্তন করে যে ট্রাকশন মোটরটি লাগানো হয় সেটিও ১৭ বছর আছে ২০০৩ সালের কেনা। পুরানো ট্রাকশন মোটরের কারনে বার বারই ইঞ্জিনটি বিকল হয়ে পড়ছে।’

ট্রাকশন মোটরের কারণে লোকমোটিভটি বিকল হয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ইঞ্জিন মেরামতে রেলওয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশী সক্ষমতা অর্জন করেছে।

শামসুজ্জামান বলেন, ‘অনেক ইঞ্জিনই চলতে চলতে বিকল হয়ে যায়। সেগুলোকে নিয়মিত পরীক্ষা নিরীক্ষার অংশ হিসেবে কেলোকাতে পাঠানো হয়ে থাকে। ২৯৩৩ লোকমোটিভটিকেও কেলোকাতে পাঠানো হয়েছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না।’

(ঢাকাটাইমস/২৮জুলাই/ডিএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :