সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ঠিক আছে তো?

প্রকাশ | ২৮ জুলাই ২০২০, ১৬:২৭ | আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২০, ১৬:৩৪

সুব্রত বিশ্বাস (শুভ্র)

ম্যানগ্রোভ এক বিশেষ ধরনের শ্বাসমূলীয় উদ্ভিদ যা সাধারণত সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের নোনা পানিতে জন্মায়। জোয়ারের সময় শ্বাসমূলের সাহায্যে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ শ্বসন কাজ চালায়। এদের মূল থেকে একটা ডালের মতো চিকন অংশ মাটি ভেদ করে উপরে উঠে আসে। জোয়ারের সময় যখন মাটির উপরে পানি জমে যায়, তখন এই শ্বাসমূলগুলো পানির উপরে ভেসে থাকে। এই শ্বাসমূলগুলোর মাথায় এক ধরনের শ্বাসছিদ্র থাকে, যাদের বলে নিউমাটাপো। এদের সাহায্যেই ম্যানগ্রোভ গাছেরা শ্বাস নেয়।

ম্যানগ্রোভ বা বাদাবনের জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং এর প্রতিবেশ সুরক্ষার আহবান জানিয়ে প্রতি বছর আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস পালিত হয়। গত রবিবার, ২৬ জুলাই  ছিল আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস।

ইকুয়েডরে ম্যানগ্রোভ বন কেটে চিংড়ি চাষ করার প্রতিবাদে ১৯৯৮ সালের ২৬ জুলাই আয়োজিত সমাবেশে একজন অংশগ্রহণকারীর মৃত্যু হয়। সেই থেকে তার স্মরণে এই দিনটিতে আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘও দিবসটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

পৃথিবীতে ১০২টি দেশে ম্যানগ্রোভ বনের অস্তিত্ব থাকলেও কেবল ১০টি দেশে ৫০০০ বর্গ কিলোমিটারের বেশি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রয়েছে। পৃথিবীর সমগ্র ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ৪৩% ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া এবং নাইজারে  অবস্থিত এবং এদের প্রত্যেকটি দেশে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ২৫% হতে ৬০% ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থিত ম্যানগ্রোভ বন (সুন্দরবন) পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ১০,২৩০ বর্গ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে এ বন বিস্তৃত। বাংলাদেশ অংশের আয়তন প্রায় ৬,০৩০ বর্গ কিলোমিটার।

বাংলাদেশের সমুদ্রোপকূলে বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবন প্রধান। কক্সবাজারে মাতামুহুরী নদীর মোহনায় ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে যা ‘চকোরিয়া সুন্দরবন’ নামে পরিচিত। এছাড়া আরো বেশ কয়েকটি ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে বাংলাদেশে।

সুন্দরবন বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। অভ্যন্তরীণ নদী ও খালসহ এ বনের আয়তন প্রায় ৬৪৭৪ বর্গ কিলোমিটার। বাংলাদেশের মোট বনভূমির ৪৭ ভাগই সুন্দরবন। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলার অংশবিশেষ নিয়ে এ ম্যানগ্রোভ বন গড়ে উঠেছে। এ বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী ছাড়াও অন্যান্য বৃক্ষের মধ্যে গেওয়া, পশুর, ধুন্দল, কেওড়া, বাইন ও গোলপাতা অন্যতম।

সুন্দরবনের ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য খাল ও নদী। এসব নদীতে কুমির, ভোদর, ডলফিন, কাঁকড়া এবং চিংড়িসহ প্রায় ১২০ প্রজাতির মাছ রয়েছে।

সুন্দরবনের প্রাণী বৈচিত্র্যের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো- ডোরাকাটা দাগবিশিষ্ট রয়েল বেঙ্গল টাইগার। পৃথিবীর অন্য কোথাও এই প্রাণী আর দেখা যায় না। অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে রয়েছে হরিণ, বন্য শূকর, বন-বিড়াল, বানর, সাপ, মৌমাছি এবং ২৭০ প্রজাতির পাখি।

বর্তমানে সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যগুলোর একটি। বনবিভাগের রাজস্ব আয়ের অধিকাংশ আসে সুন্দরবনের কাঠ, জ্বালানি, গোলপাতা, মধু, মোম ও নদীর মাছ থেকে।

কক্সবাজার জেলায় মাতামুহুরী নদীর মোহনায় অবস্থিত ম্যানগ্রোভ বনের  নাম ‘চকোরিয়া সুন্দরবন।’ এ বনের প্রধান উদ্ভিদ হলো- বাইন, ওরা, কেওড়া, গরান, হিন্তাল, গোলপাতা ইত্যাদি।

টেকনাফের কাছাকাছি নাফ নদীর তীরেও একটি ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে। এ বনের বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে সাপ, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও মাছ রয়েছে।

টেকনাফ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের অভ্যন্তরে অবস্থিত সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণাংশে একটি ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে। এ বনের উদ্ভিদের মধ্যে ক্রিপা, খলশি ও ভোলা অন্যতম। এ বনের প্রাণীর মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক মাছ, কচ্ছপ ও কাঁকড়া।

উপকূলের প্রতিকূল ও  লবণাক্ত মাটিতে গরান, বাইন ও কেওড়া গাছ ভালো জন্মে। তাই বর্তমানে এ অঞ্চলে এসকল গাছের চারা রোপণ করে কৃত্রিমভাবে ম্যানগ্রোভ বন সৃষ্টি করা হয়েছে।

তথ্যমতে, পৃথিবীতে ১ লাখ ৮১ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বিস্তৃত ছিল। কিন্তু অতি সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এ বনাঞ্চলের আয়তন ১ লাখ ৫০ হাইয়ার বর্গ কিলোমিটারের নিচে নেমে এসেছে। সমগ্র পৃথিবীর উপকূলীয় আবাসস্থল অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল হতে অতিরিক্ত কাঠ ও মাছ আহরণের ফলে এবং উপকূলীয় ভূমিকে বিকল্প ব্যবহারযোগ্য ভূমি হিসেবে ব্যবহারের ফলে এ বনাঞ্চল হুমকির সম্মুখীন। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো অনেক প্রজাতিই এ বনকে তাদের জীবনচক্রের কোনো না কোনো সময় ব্যবহার করে।

পুরো পৃথিবীতে প্রায় ৫০ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ রয়েছে। যার ৩৫ প্রজাতি রয়েছে সুন্দরবনে। লবণের তারতম্যের ভিত্তিতে বনের বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন উদ্ভিদের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। প্রায় ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩২০ প্রজাতির পাখি, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং ৪০০ প্রজাতির মাছের আবাসস্থল সুন্দরবনে।

বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড়ের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই সুন্দরবন। বায়ুমণ্ডল থেকে প্রচুর পরিমানণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড টেনে নেয়। এতে পরিবেশের দূষণ কমে। কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে খাদ্যে রূপান্তরিত করে সুন্দরবনের নোনা পানির উদ্ভিদরাজি বেড়ে ওঠে। কেওড়া গাছ সর্বাধিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড তার শিকড়, কাণ্ড, ডালপালা ও পাতায় আটকে রাখতে পারে। এক হেক্টর কেওড়া বন বছরে ১৭০ টন পর্যন্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড আটকে রাখতে সক্ষম। বাইনের ক্ষেত্রে তা ১১৫ টন, গেওয়ায় ২৩ টন। গাছের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই ক্ষমতা হ্রাস পায়।

সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে ৬৬২ কোটি টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড সঞ্চিত। এর সঙ্গে প্রতি বছর যোগ হচ্ছে আরো ৩৮ লাখ টন।

জীববৈচিত্র্যের এমন প্রাচুর্যতার জন্য সুন্দরবন ১৯৯২ সালের ২১ মে রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কো সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে। আর এ জন্য সুন্দরবনের সৌন্দর্য রক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশে ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় সুন্দরবন দিবস।

এই বনাঞ্চলে বাংলাদেশ অংশের অন্যতম প্রধান দুটি নদী শিবসা ও পশুর। অত্যধিক পলি জমার কারণে এক সময়কার গভীর ও ভয়ংকর শিবসা বর্তমানে শুকিয়ে যাচ্ছে। আবার বাংলাদেশ-ভারত নৌ প্রটোকলের আত্ততায় নৌ রুটও এই সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে। মোংলা বন্দরের প্রধান চ্যানেলটি পশুর নদের মধ্য দিয়ে। আবার পশুর-শ্যালা নদী পথেই নৌ প্রটোকলসহ দেশের অভ্যন্তরের পণ্যগুলো চলাচল করে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকার ফেটে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় তেল বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া একই পথে একাধিকবার সিমেন্টবাহী জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে। মোংলা পারেই গড়ে উঠেছে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এসব কারণে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

মানুষ কৃষিকাজ ও খাদ্যের জন্য প্রায় সাত হাজার উদ্ভিদ ও কয়েক হাজার প্রাণীর উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। মানুষের জীবন ধারণের জন্য জীববৈচিত্র্যের প্রয়োজনের কোনো শেষ নেই। এদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। তাই এ বনের রক্ষণাবেক্ষণ করা আমাদের সকলেরই দায়িত্ব।

লেখকঃ কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ, বিএসএমএমইউ।

(ঢাকাটাইমস/২৮জুলাই/মোআ)