ক্ষমা ক‌রো আহ‌মেদ

এস এম মোস্তাক আহমেদ খান
 | প্রকাশিত : ০৫ আগস্ট ২০২০, ১৩:৪৪

২০০৫ সাল। আমি স্কলার‌শিপ নিয়ে লেস্টার ইউ‌নিভা‌র্সি‌টি‌তে পড়‌তে গি‌য়ে‌ছিলাম। অবসরে কাজ করতাম অর্চাড হাউস নামক এক‌টি ফ্রুট ফ্যাক্ট‌রি‌তে। সা‌ড়ে পাঁচ পাউন্ড ঘন্টা হি‌সে‌বে, ১৩০ টাকা পাউন্ড ধ‌রে এক‌দিন কাজ কর‌লে পেতাম ৫২০০ টাকা। বাংলা‌দে‌শে তখন আমার বেতন স্কেল মা‌সিক ৪৩০০ টাকা।

অর্চাড হাউস ছিল মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সারের এক‌টি সিস্টার কনসার্ন। ওভার টাইম কর‌লে পেতাম দৈ‌নিক সাত থে‌কে আট হাজার টাকা। ওই সময় আমি খুব কৃপণ ছিলাম এবং উদ্দেশ্য ছিল টাকা জমান। এতটাই কৃপণ ছিলাম যে ফ্যাক্ট‌রি‌তে দুপু‌রে সব‌চে‌য়ে কম দামি খাবার আমি খেতাম, একটা ‌মি‌নি স্যান্ডউইচ, হাফ পাউন্ড দাম। এক পাউন্ড দাম দে‌খে একটা বার্গার খেতাম না।

অর্চাড হাউজ ফ্যাক্ট‌রি‌তে আমার সা‌থে প‌রি‌চিত হয় লেবা‌নিজ আহ‌মে‌দের। বয়স চল্লি‌শের উপর। রাজনৈ‌তিক আশ্র‌য়ে থে‌কে সি‌টি‌জেন‌শি‌পের জন্য দরখাস্ত ক‌রে‌ছিল হোম অফিসে। আমা‌কে দারুণ ভা‌লোবাসত সে। লেখা‌লে‌খি ক‌রি জে‌নে ভা‌লোবাসা ছিল আরও বে‌শি। আমার কৃপণতা দে‌খে সে ধারণা ক‌রে‌ছিল আমি খুব গরিব। দুপু‌রে ভা‌লো খাবার খাওয়ার টাকা নেই। তাই এক‌দিন আমার জন্য বাসা থে‌কে অনেক ভা‌লো ভা‌লো খাবার নি‌য়ে এসেছিল। আমি খে‌তে চাইনি। ব‌লে‌ছিলাম আমি স্কলার‌শি‌পের টাকা পাই।

আহ‌মেদ আমা‌কে বলল, লেবান‌নে যু‌দ্ধে তার প‌রিবা‌রের সবাই মারা গে‌ছে, আপন বল‌তে কেউ নেই। সে অনেক কষ্ট ক‌রে আমার জন্য সারা রাত ধ‌রে সব‌কিছু রে‌ধে‌ছে (ফ্যাক্ট‌রি‌তে বাসা থে‌কে দুপু‌রের খাবার আনা যেত)। আমি খে‌তে রা‌জি হই। ত‌বে খে‌তে পা‌রি‌নি। খাওয়ার পু‌রোটা সময় আহ‌মেদ শুধু কাঁদ‌ছিল। একসময় সে ব‌লে, তু‌মি ম‌নে কিছু ক‌রো না, আমি আমার দেশ‌কে ভা‌লোবা‌সি, কাঁদ‌ছি আমার দে‌শের জন্য। আমি চেষ্টা ক‌রেও আমার কান্না থামা‌তে পার‌ছি না।

এরপর থে‌কে আহ‌মে‌দের সা‌থে আমার হৃদ‌য়ের সম্পর্ক হ‌য়ে যায়। মূলত আমি দিনমজু‌রের কাজ করতাম অর্চাড হাউ‌জে। আমি না চাই‌লেও সে আমার অনেক কাজ ক‌রে দিত, যেমন, ফ‌লের বাক্স টানা, বা‌ক্সে লেভেল লাগান, ট্র‌লি ঠেলা। আর যে‌দিন সুপারভাইজারের দায়‌‌িত্বে থাকত সে‌দিন আমা‌কে কম ক‌ষ্টের কাজ দিত। ফি‌রে আসার সময় বা‌সে সিটও রাখত আমার জন্য। আমি তার জন্য তেমন কিছু কর‌তে পারতাম না, ক‌য়েকবার খাওয়া‌নোর কথা বল‌লেও খায়‌নি। একবার এক কাপ ক‌ফি খাওয়া‌তে পে‌রে‌ছিলাম শুধু।

অর্চাড হাউ‌সে শেষ কর্ম‌দিব‌সে সে আমার হাত ধ‌রে ব‌লল, আমি‌ তোমার কা‌ছে কখ‌নো কিছু চাই‌নি, আজ একটা জি‌নিস চাইব। আমি অবাক হ‌য়ে তাকালাম। আহ‌মেদ আবদার ক‌রে ভাঙা ভাঙা ইং‌রে‌জি‌তে বলল, ‘তুমি লেখক, এটাই তোমার বড় প‌রিচয়, যদি পা‌রো আমার দেশ লেবানন নি‌য়ে তু‌মি একটা বই লিখ‌বে, যেন পৃ‌থিবীর সবাই জান‌তে পা‌রে আমরা কতটা নির্যা‌তিত, ব‌ঞ্চিত।’

আমি কথা‌ দি‌য়ে‌ছিলাম অর্চাড হাউজ না‌মে এক‌টি বই লিখব যেখা‌নে লেবান‌নের কথা থাক‌বে, থাক‌বে আহ‌মে‌দের কথা। আজ আমি ১০০ বই‌য়ের উপ‌রে লিখ‌লেও অর্চাড হাউজ বইটা লেখা হয়‌নি। লেখা হয়‌নি আহ‌মে‌দের কথা।

লেবান‌নে বি‌স্ফোর‌ণের ধ্বংসযজ্ঞ দে‌খে মনটা খুব খারাপ। আমা‌কে ক্ষমা ক‌রো আহ‌মেদ, তোমার কথা রাখ‌তে পা‌রিনি। ত‌বে কথা দি‌চ্ছি অর্চাড হাউজ বই‌টি আমি লেখব। আজ নিশ্চয় আহ‌মে‌দের বুকটা ক‌ষ্টে ফে‌টে যা‌চ্ছে। তার কষ্ট আমিও অনুভব কর‌ছি। লেবান‌নের জন্য এক বুক ভা‌লোবাসা।

লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা ও লেখক

(ঢাকাটাইমস/০৫আগস্ট/এসকেএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :