ঘেটুপুত্র কমলার হরিপুর জমিদার বাড়ি

শেখ সাইফ, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২০, ১৯:১৫ | প্রকাশিত : ০৬ আগস্ট ২০২০, ১৬:১৫

বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা ও ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ চলচ্চিত্রে প্রথম দেখেছিলাম হরিপুর জমিদার বাড়ি। যতদূর চোখ যায় শুধু থৈ থৈ পানি। বর্ষার মৌসুমে এমন চিত্র। আবার তিন-চার মাস পর শুকনো মাঠ। তারপর ফসলের ক্ষেতে সবুজের দোল খাওয়া। এখানেই প্রতি বছর নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা হয়। তিতাস নদীর পূর্বপাশে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর গ্রামের এই হরিপুর জমিদার বাড়ি।

কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় যাওয়া। বন্ধু তানভীর আহমেদ সোহাগকে বললাম, এখানে কাছে কিনারে দর্শনীয় কোনও স্থান থাকলে আমি দেখব। ও বলল হরিপুরের এই জমিদার বাড়ির কথা। কালবিলম্ব না করে দুই বন্ধু অটোরিকশায় চড়ে ছুটে গেলাম জমিদার বাড়িতে। এ বাড়িটিকে কেউ বলে রাজবাড়ি, বড়বাড়ি আবার কেউ বলে জমিদার বাড়ি। বর্তমানে এটা সরকারি সম্পত্তি। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শত শত দর্শনার্থী গিয়ে ভিড় জমান বাড়িটি দেখতে।

অটোরিকশা থেকে নামতেই চোখে পড়ল দুই গম্বুজের তিনতলা সুবিশাল বাড়িটি। নদীর পাড় ঘিরে বড় প্রাচীরে ঘেরা জমিদার বাড়িটি সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেছে তিতাসের বুকে। নৌকার উপর থেকে দেখলে জমিদার বাড়িটি এক নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা করে। নদী থেকে সিঁড়ি বেয়ে উঠলেই সুবিশাল চত্তর। এই বড় বারান্দা ডিঙিয়ে মূল বাড়িতে ঢুকতে হবে। নান্দনিক স্থাপত্যশৈলিতে নির্মিত বাড়িটিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সেটির বাইরের অবয়বটি অবিকল রযে গেছে। কারুকাজ খচিত দেয়াল, স্তম্ভ ও কার্নিশ।

ভেতরে ঢুকতেই একটা গা ঠান্ডা ভাব। মোটা মোটা দেয়াল। একটু অন্ধকার অন্ধকার ভাব। অনেকগুলো ঘরের সারি। কোথাও কোথাও একটু ভেঙ্গে গেছে। চুন সুরকির দেয়াল খসে পড়েছে। বহুদিন ধরে বৃষ্টির পানিতে ভিজে শ্যাওলা জমে কিছুটা স্যাঁতসেঁতে ভাব হয়ে আছে।

বাড়িটিতে বসবাসকারীদের থেকে জানা যায়, বর্তমানে এই জমিদার বাড়িটি সরকার অধিকরণ করলেও এখানে প্রায় ১৪০ ঘর উদ্বাস্তু হিন্দু-মুসলিমের বসবাস। কেউ কেউ এখানে জন্মগ্রহণ করেছেন। আবার কেউ পাকিস্তান আমল থেকে বসবাস করছেন। অনেকে নিজেদের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছেন। তবে এখনো বাড়ির ভেতরের অংশে অনেকটাই গোছালো পরিবেশ বিরাজ করছে।

বাড়িটির ছাদে উঠতেই মনে পড়ে গেল ঘেটুপুত্র কমলার শিশুশিল্পী মামুনের দুহাত মেলে ছাঁদের কার্নিশে হাটার দৃশ্য। ছাদে আজানের দৃশ্য। কমলাকে (মামুন) ধাক্কা দিয়ে উপর থেকে ফেলে দেয়ার দৃশ্য। উপর থেকে নদীর দিকে তাকাতেই মনে পড়ল কমলার মায়ের (তমালিকা কর্মকার) নৌকায় করে আসার দৃশ্য। এ যেন এক নস্টালজিয়া। এখানেই হুমায়ূন আহমেদ কত দৃশ্যের রোল, কাট, অ্যাকশন বলেছেন। আনন্দ আয়োজনের মধ্য দিয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন ‘ঘেটুপুত্র কমলা’।

জানা যায়, প্রায় ২০০ বছর আগে জমিদার গৌরী প্রসাদ রায় চৌধুরী ও কৃষ্ণ প্রসাদ রায় চৌধুরী বাড়িটি নিমার্ণ করেছিলেন। বৃটিশ আমলে নির্মিত বাড়িটির নিমার্ণশৈলী বড়ই মনোরম। বাংলা সাল ১৩৪৩ এর ১২ চৈত্র (দোল পূর্ণিমা) তারিখে কৃষ্ণ প্রসাদ রায় চৌধুরীর মূত্যুর পর পর্যায়ক্রমে বাড়িটির উত্তরাধিকার হন হরিপদ রায় চৌধুরী ও শান্তি রায় চৌধুরী। তাদের কাছ থেকে বাড়ির মালিকানা ও জমিদারি আসে উপেন্দ্র রায় চৌধুরী ও হরেন্দ্র রায় চৌধুরীর কাছে। কালক্রমে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে তারা বাড়িটি ফেলে কলকাতায় চলে যান। তারা রেখে যান পুরোহিতদের । এখনও জরাজীর্ণ জমিদার বাড়িতে পুরোহিতদের বংশধররা বসবাস করছেন।

ভবনের ভেতরে দেখা যায় মন্দির, পূজা-অর্চনা করার ছোট ছোট দেব-দেবীর মূর্তি, মাটির চুলা। যেখানে সেখানে বাঁশ দড়ি বাঁধা। কাপড় চোপড় ঝোলানো। রান্না করে কোথাও কোথাও কালো করে ফেলা হয়েছে। কোথাও কোথাও ছাদের টালি খসে পড়েছে। ভেতরে স্থানীয়রা টিউবওয়েল বসিয়েছে। এভাবেই তারা জমিদার বাড়ির পরিবেশের কিছুটা ক্ষতি করছে।

প্রায় ৪৮০ শতাংশ জমির উপর প্রতিষ্ঠিত তিনতলা জমিদার বাড়িটিতে প্রায় ৬০টি কক্ষ, রংমহল, দরবার হল, ধানের গোলা, গোয়ালঘর, রান্নাঘর, নাচ ঘর, মল পুকুর, খেলার মাঠ, মন্দির ও সীমানা প্রাচীর রয়েছে। বিশাল আয়তনের বাড়িটির পুরো ভবনের কোথাও কোনো রডের গাঁথুনি নেই। লাল ইট সুরকির গাঁথুনি দিয়ে তৈরি ভবনের দুপাশে দুটি সুউচ্চ গম্বুজ সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছে জমিদার বংশের ঐতিহ্যের কথা।

দোতলায় উঠার ছয় দিকে ছয়টি সিড়িঁ ও তিন তলায় উঠার দু’দিকে দুটি সিঁড়ি রয়েছে। বাড়তি পশ্চিম-উত্তর কোণে ছয়টি বেড রুম এবং মল পুকুরের পূর্বপাড়ে চারটি এবং পশ্চিম পাড়ে চারটি বেড রুম রয়েছে। বাড়ির পশ্চিম দিকে তিতাস নদীর পাড়ে পাকা ঘাটলার উত্তর দিকে কৃষ্ণ প্রসাদ রায় চৌধুরী ও দক্ষিণ দিকে গৌরী প্রসাদ রায় চৌধুরীর সমাধি মঠ রয়েছে। পাশেই একটি বড় কড়ই গাছ ছায়া দিয়ে রেখেছে।

বর্ষা মৌসুমে তিতাসে যখন পানি থৈ থৈ করে, তখন বাড়িটির সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়। বাড়িটি সংস্কারে সরকার ইতোমধ্যে হাত দিয়েছে। ভেতরের একটি অংশ পুরাতন নকশা ঠিক রেখে নতুন করে সংস্করণ করে সাদা রঙ করা হয়েছে। এ বাড়িতে ‘মধুমালতি’ ‘ঘেটু পুত্র কমলা’ ‘নাইওরীসহ অনেক ছবি চিত্রায়িত হয়েছে।

জমিদার বাড়িতে আসলে আপনি খেতে পারবেন বাড়িতে বসবাসকারীদের হাতে তৈরি গরম গরম পুরি, বেগুনি, সিঙ্গাড়া, সমুচা প্রভৃতি। পাওয়া যাবে টিউবওয়েলের ঠাণ্ডা পানি। আপনি ইচ্ছা করলে এখানে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করে ঘুরতে পারবেন তিতাস নদীতে। তবে নৌকা ভাড়াটা দরদাম করে নিতে হবে। আমরা ইঞ্জিনচালিত নৌকা হাতে বৈঠা নিয়ে বেয়ে চলার জন্য চুক্তি করেছিলাম ১৫০ টাকার।

যেভাবে যাবেন

দেশের যেকোনো স্থান থেকে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলাতে নামতে হবে। সেখান থেকে অটোরিকশা যোগে যাওয়া যাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের এই জমিদার বাড়িতে। ভাড়া পড়বে জন প্রতি ২০ টাকা। ট্রেন যোগেও যাওয়া যাবে। এছাড়া ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে সিলেটগামী বাসে সহজেই যাওয়া যাবে। ভাড়া জন প্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। এছাড়া রাতে থাকার জন্য মাধবপুরে রয়েছে আবাসিক হোটেল, জেলা পরিষদ ডাক বাংলো ও রেস্ট হাউজ। সময় নিয়ে এই বর্ষায় চাইলে আপনি সহজেই ঘুরে আসতে পারেন হরিপুর জমিদার বাড়ি।

ঢাকাটাইমস/৬আগস্ট/এসকেএস/এএইচ

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

যে পাঁচ সমস্যায় আক্রান্তরা গুড় খাওয়ার আগে একবার ভাবুন, নইলে...

সাজেদুর রহমান শাফায়েতের স্বপ্ন পৃথিবী ঘুরে দেখা

খাওয়ার পরপরই চা পান উপকার না ক্ষতি? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

জ্বরের মধ্যে যে পাঁচ খাবার খেলেই বিপদ! জানুন, সাবধান হোন

গরমে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে ডায়াবেটিস রোগীদের! সুস্থ থাকবেন যেভাবে

মুখে দুর্গন্ধের কারণে হা করতেও অস্বস্তি লাগে? সমাধান কী জানুন

লিভার ভালো রাখে লাউ! ওজন এবং উচ্চ রক্তচাপও থাকে নিয়ন্ত্রণে

কিডনি ভালো রাখে আমের পাতা! উচ্চ রক্তচাপও থাকে নিয়ন্ত্রণে

ইফতার ও সাহরিতে বাহারি আয়োজন ধানমন্ডির দ্য ফরেস্ট লাউঞ্জে

বারবার ফোটানো চা খেলেই মারাত্মক বিপদ! বাঁচতে হলে জানুন

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :