শিপ্রার প্রতিবাদ করাই ছিল অপরাধ!

প্রকাশ | ০৬ আগস্ট ২০২০, ১৭:৩০

শুভজিত প্রান্ত শ্রেয়

সিনেমা সিনেমা করে এ পর্যন্ত কম কিছু সহ্য করেনি আমার বোন! ২০১৫-তে আর্কিটেকচারে ডিপ্লোমা শেষ করার পর, ঢাকায় IEB এর অধীনে সে বুয়েটে B.S.C in Civil Engineering এ পড়ার সুযোগ পায়। কিন্তু সিনেমার প্রতি তার প্রচণ্ড নেশা তাকে ইন্জিনিয়ারিংয়ের মতো শক্ত, কঠিন, কাঠবন্দি একটা জীবনকে বেছে নিতে দেয়নি! সে পরিবারের শত অনিচ্ছা থাকা শর্তেও দ্বিতীয় বছরে এসে তার স্নাতক ডিগ্রির পড়া বন্ধ করে দিল! আমাকে বললো, 'প্রান্ত, সিনেমা বানাতে হবে বুঝছিস! আমি আসলে খেয়াল করলাম আমার দ্বারা এই ইন্জিনিয়ারিং আর সম্ভব না! I need a change.'

আমি বললাম তাহলে মা বাপী? তাদের স্বপ্ন তো মেয়ে ইন্জিনিয়ার হবে, চাকরি বাকরি করে ঘর সংসার করবে। সিনেমার জীবন তো এত অনিশ্চিত, এত এত স্ট্রাগল, চ্যালেন্জ! ইন্জিনিয়ারিং শেষ করলে তো অন্তত একটা স্ট্যাবল ক্যারিয়ার থাকার সম্ভাবনা আছে!

দি ঠান্ডা গলায় বললো- না! সবাই তার জীবনকে একভাবে দেখে না, অন্তত আমি তো দেখিই না। আমার জীবনের নিয়ন্ত্রণে আমি থাকবো, আমি সিদ্ধান্ত নিবো যে আমি কী করবো!

আমি বললাম, আচ্ছা! কিন্তু টাকা-পয়সা কই পাবি? এই ঢাকাতে থাকা, পড়াশোনা!? চলচ্চিত্র নিয়ে পড়তে গেলে তো মা-বাবা কখনোই রাজি হবেন না! সে তখন বললো, আমি দুইটাই পড়বো। ইন্জিনিয়ারিংয়ের জাস্ট ডিগ্রিটা নেব আর সিনেমা নিয়ে পড়বো নিজের জন্য! আসলে নিজের জন্য কিছু করতে পারাটা হলো সবচেয়ে আনন্দের।

আমি মাথা নাড়ালাম! এরপর দিন যেতে থাকলো। আজ তার সাথে ছবি, কাল তার সাথে ছবি! দি কখনও ওসব সোশ্যাল মিডিয়াতে দিতো না তেমন একটা সে আমাকে বলতো, আমি মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনতাম! বড় বড় সব আর্টিস্ট আর ফিল্মমেকারদের সাথে ধীরে ধীরে ওর যোগাযোগ হতে থাকে। একেকটা শর্টফিল্ম বানায়, কোনো ডকুমেন্টারির স্ক্রিপ্ট লেখে, কোনোটার প্রোডাকশনে কাজ করে! এডিটিং প্যানেলে বসে ছবি পাঠায় আমাকে। বড় বড় তারকাদের সাথে বসে, স্ক্রিপ্ট নিয়ে কথা হলে আমাকে জানায়! নতুন কাজ পাইলে বলে একটা কাজ পাইছি! একেক সময় একেকটা বলে! কখনও বলে এই নাটকের স্ক্রিপ্ট এডিটর, ওই নাটকের প্রোডাকশন টিমের মেম্বার, কখনোবা অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর! বেশ কিছু টপ নচ বিজ্ঞাপনেও কাজ করেছিলো!

আমি আগ্রহ নিয়ে বলি, তোর নাম কই? পোস্টারে নাম কই? নাম আসবে স্ক্রিনে? তোর নাম তো নাই! ও হাসে... বলে আরে পাগল এগুলা তো ছোটোখাটো কাজ, নাম আছে সমস্যা নাই! এগুলোতে কাজ করা শেখার জন্য, জানার জন্য! আমি এখানে আমার ক্রেডিট খুঁজি না!

সেবার তো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলে গেলো বিবিসির ডকুমেন্টারি শ্যুট করতে, সে মানুষের জন্য কাজ করবে নাকি! কখনও কখনও পেমেন্ট পাইলে সে আমারে জানাইতো, যে এখন তার কাছে অনেক টাকা! মাস শেষ হতে না হতেই বলতো আবার যে, ভাই হাতে তো টাকা নাই! আমি বলতাম, সেদিন না বললি পেমেন্ট পাইছিস? বলে, হুর ছাতা! টাকা হাতেই থাকে না বুঝছিস, কেমনে কেমনে যেন খরচ হয়ে যায়! আমি বলতাম, কত টাকা ই বা পাস। চাকরি কর! কবে কাজ পাবি, কবে পেমেন্ট পাবি কোনো নিশ্চয়তা নাই। এগুলা চাকরির পাশাপাশি কর! বলতো, চাকরির করলে ভার্সিটি যাব কেমনে? আর সমস্যা নাই, টাকা জোগাড় হয়ে যাবে! মাসের শেষে সিনেমার মানুষদের হাতে টাকা থাকবেনা এটায় তো স্বাভাবিক!

ঢাকাতে শিফট হওয়ার পর বাড়ি থেকে ও তেমন প্রয়োজন ছাড়া কখনও টাকা নেয়নি! নিজের পড়াশোনাসহ থাকা-খাওয়া সব নিজেই ম্যানেজ করেছে! এমনকি আমি যখন ঢাকাতে কলেজে পড়তাম, আমার হাত খরচের টাকা যখন যেভাবে পারছে দিছে! টাকা না থাকলে ১০০ টাকা দিছে, আর থাকলে ৫০০। টাকা চাইলে না করে নাই কখনও। আমি শেষ কবে আমার মা বাবার কাছে টাকা চাইছিলাম আমার হাত খরচের জন্য আমার মনে নাই, আমি ওর কাছেই চাইতাম।

কলকাতাতে আসার পর থেকে আমি একটা ইন্ট্রোভার্ট মানুষ, কি করবো বুঝে উঠতে পারতেছিলাম না! পড়াশোনা সিলেবাস দেখে মাথা মুথা আওলায় বসে থাকতাম, কিছু পারি না বলে না পড়ে বসে থাকতাম! ইংলিশ লিটারেচার নিয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখা আমি সুযোগ পাই ইনফরমেশন টেকনোলজি নিয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি পড়ার!

একটা সময় আসলো যখন পাস করবো কি করবো না জানি না, পরীক্ষার আগের রাতে ওরে ফোন করে করে বলতাম যে - ব্রো আমার দ্বারা মেবি পসিবল না! এখানে যদি পাস না করি বাড়ি সামলাস প্লিজ। ও বলে- আরে ব্যাটা চিল! তুই ট্রাই করতে থাক, কিছু হইলে আমি তো আছি ই!

শেষদিকে এসে ও অনেক বড় কতগুলা কাজ করেছিল! কবে কবে স্ট্যামফোর্ডের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্ট্যাডিস এর থার্ড ইয়ারেও উঠে গেছিল। করোনার লকডাউনের আগে ওর বড় কাজ ছিল গিয়াসউদ্দিন সেলিমের পাপ-পূণ্য মুভির এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার হিসেবে। চঞ্চল চৌধুরী, ফজলুল রহমান বাবুর মতো বড় বড় অভিনেতাদের নির্দেশনা দেয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করা নিশ্চয়ই অনেক বড় ব্যাপার! ও সেগুলো নিজে নিজে ই শিখেছিলো, সবকিছুর উর্দ্ধে গিয়ে।

কক্সবাজার যাওয়ার আগে ও আমারে বললো- ব্রো প্রোডাকশন টিম রেডি! ডকুমেন্টারি ডিরেক্ট করবো। আমি কইলাম এসময় কক্সবাজার! এতো করোনা, বিপদের সময়? বললো আরে ব্যাটা আমরা তো পাহাড়ে শ্যুট করবো, প্রকৃতি শ্যুট করবো! জনসমাগম তো নাই, টেনশন করিস না! আমি বললাম ওকে যা! এরপর মাঝে একদিন টেক্সট দিয়ে বললাম কী অবস্থা? কেমন চলছে শ্যুট? হেসে বললো এইতো সারাদিন কামলা দিতেছি!

সপ্তাহখানেক আগে সকালে ওরে ফোন দিয়ে আমি সে কি কান্না! তিন মাস ধরে আমি অসুস্থ, কথা বলতে পারি না! কী সব প্রেম ভালোবাসার কেচ্ছা কাহিনির মেন্টাল ট্রমায় দাঁড়ায় উঠতে পারি না কোনোভাবেই! ২১ তারিখ সকালে ওর সাথে ঘণ্টাখানেক কথা বলছিলাম, আসলে আমি শুধু কান্না করেছি, ও শুধু বলে গেছে! ওর সাথে কথা বলার পর সবকিছুর পার্সপেক্টটিভই চেন্জ হয়ে গেছিল। আমার, ওই সকালের পর আমি নিজেকে গত তিন মাসের মধ্য সবচেয়ে বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় পেয়েছি!

দিদি বলেছিল আমার কাছে চলে আয় ভাই, আমাকে কাজে হেল্প কর! এখানে টিম রেডি, আমারে স্ক্রিপ্টের কাজে হেল্প করিস, তোর মনও ভালো হবে! ওরে বললাম, আমি ইলেকট্রিক পিয়ানো কিনবো একটা, টাকা জমাইতেছি! বললো খুবই বেটার, মিউজিক এর চেয়ে বেটার কিছু হয় না। আমার ইচ্ছা ছিলো দেশে গিয়ে সত্যিই যাব ওর কাছে, একটু সিনেমা আমিও বানাবো!

এরপর গত ১ তারিখ সকালে আমি ওরে ইদ মোবারক বলে উইশ করি! ঘন্টাখানেক বাদে রিপ্লাই দেয়, "Sinha is Dead! আমি থানায়, Wait for my call. Don't worry, I'm okay."

এরপর আর কোনো কল আসেনি ওর মোবাইল থেকে আমার কাছে! ৩১ তারিখ মধ্যরাতে পুলিশ তার রিসোর্টে এসে তাকে আর রিফতী ভাইয়াকে ধরে নিয়ে যায়। তার কোনো আইডিয়াও ছিলো না তখন যে কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে! কেন মারা হয়েছে তার টিমের একজনকে, কোথায় আছে তার বন্ধু সিফাত! তাকে সারারাত কিছুই বলা হয় নি! আমিই তাকে পরে ঘটনা জেনে সব মেসেজ করে করে বলি! সে বলে- আমাকে এরা কেউ কিছু বলছে না! তুই সিফাত, রিফতী সবার বাসায় ফোন দে; আমি এদেরকে ছাড়া একা বের হবো না! রিফতী আর দি একসাথে ছিলো ১ তারিখ সারাদিন। পরে রিফতী ভাইকে ছাড়লেও দিদিকে ছাড়া হয়নি!

দিদি নাকি পুলিশের সাথে প্রতিবাদ করেছিলো কেন করা হয়েছে এমন, কেন শ্যুট করা হয়েছে সিনহা ভাইয়াকে এগুলা নিয়ে প্রশ্ন করেছে! হয়তো এটাই তার অপরাধ!

যে মানুষটা আমাকে সপ্তাহে খানেক আগেও আমার মেন্টাল কন্ডিশন হিল করার জন্য হাজার রকমের উদাহরণ টেনে টেনে বুঝিয়েছিলো সে মানুষটাই ওইদিন আমায় লেখে যে- তার নাকি সব শেষ! সে আর বেঁচে থাকতে চায় না! আমি জানি না আমার বোনের আদৌও কোনো দোষ ছিলো কিনা যে তাকে রিসোর্ট থেকে মধ্যরাতে তুলে নিয়ে গিয়ে মাদক মামলার আসামী করা হলো! শুধু আমি এটুকু বিশ্বাস করি আমার এই বোনটার নামে পুলিশ যা বলেছে, সেটা ও কখনোই করতে পারে না!

আমি আমার দেশের সংবিধান এবং বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখি, সিনহা ভাইয়া আর ফিরে আসবে না আমি জানি! সে শেষবার আমার কাছে গান শুনতে চেয়েছিল, এরপরই আমার গলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তাকে আর গান শোনাতে পারি নাই! ব্ল্যাকের ‘আমার পৃথিবী’ গানটা দ্বিতীয়বার তাকে কখনোই শোনানো হবে না- তবে আমি চাই আমার বোন ফিরে আসুক এবং আমি তাকে জীবন যে কত সুন্দর এ বিষয়ে জ্ঞান দিয়ে তার সপ্তাহখানেক আগে বলা কথাগুলোর ঋণ শোধ করব! এদেশে বাস করে স্বপ্ন দেখাটা যে পাপ শিপ্রা বুঝে নি!

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক কর্মী

(ঢাকাটাইমস/০৬আগস্ট/এসকেএস)