বৈচিত্র্য আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর

গাউসুল আলম শাওন
 | প্রকাশিত : ০৭ আগস্ট ২০২০, ১৭:৩৫

আপাত স্বাধীন মানুষও এমন সব সীমাবদ্ধতায় অদ্ভূতভাবে আটকে থাকে যে সে তা এক জীবনে বুঝে উঠতে পারে না। সারাজীবন নিজেকে নারীবাদী ভেবে একজন পুরুষ কিংবা নারী তাদের বিশেষ কোনো ব্যবহারে ভীষণ পুরুষতান্ত্রিক থেকে যান আজীবন নিজের অজান্তেই। তাই কারো কিংবা কোনো বিষয়ে কতটুকু জেনে কতোটুকু সঠিক ভাবছি, সেটা একটা অতি সংবেদনশীল বিষয় বলেই মনে করি। কিন্তু তারপরও ভুল হয়ে যায়, আমি তারে পারি না এড়াতে।

এই প্যানডেমিকের ঠিক আগে দিয়ে সিডনি গেছি অফিসের একটা কনফারেন্সে। আর বাকি অনেকের মতোই সেখানে পরিচিত বাঙালির অভাব নেই তাই ফেরার দু'দিন আগে রাতে তৌহিদ (এক্স-গ্রে) আর সাজিদের (এক্স-গ্রামীণফোন) সাথে চৈনিক খাবার খেতে গেছি সিডনি ডাউনটাউনে। খাওয়া, আড্ডা শেষে তৌহিদ-সাজিদ আমাকে একটা ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিলো হোটেলের উদ্দেশ্যে। ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারকে দেখেই কেমন বাঙালি বাঙালি মনে হলো।

কৌতুহল সংযম করতে না পেরে বাংলায় জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, উত্তর নাসূচক আসাতে ভারতীয় জেনে আমার ভাঙা-চূড়া হিন্দিতে গল্প জমানোর চেষ্টার একপর্যায়ে ভদ্রলোক হঠাৎ বাংলায় কথা বলে উঠলেন এবং জানালেন তিনি কলকাতার বাঙালি। শুনে তো আমি আমার কলকাতার গল্পের ঝাঁপি খুলে বসলাম এবং কলকাতা আমার কত'টা প্রিয় শহর সেটাও বলে ফেললাম।

তারপর কৌতূহলি হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কেন তিনি প্রথমে তার বাঙালি পরিচয় লুকাচ্ছিলেন। তাতে তিনি যেই ব্যাখ্যা আমাকে দিলেন, তাতে মন'টা খুব খারাপ হয়ে গেল। উনি আসলে আমার বাংলা শুনে প্রথমেই বুঝে গিয়েছিলেন যে আমি বাঙালি এবং বাংলাদেশের বাঙালি এবং সেইজন্যই তিনি আমাকে বলেননি যে তিনি বাঙালি এবং কলকাতার বাঙালি। কারণ, ওনার ট্যাক্সি চালানোর প্রথমদিককার দিনগুলোতে এমনসব বাংলাদেশিকে পেলে উনি অতিউৎসাহে নিজের পরিচয় দিতেন। আর তার প্রতিউত্তরে আমরা তাকে না কি শুনিয়ে দিয়েছি বহুবার যে কলকাতার বাঙালি'রা কেমন কৃপণ, কীভাবে বাজারে গিয়ে ২০০ গ্রাম মাছ কেনে, বাড়িতে হঠাৎ কেউ হাজির হলে কীভাবে না খাইয়ে বিদায় করে দেয়, মিষ্টির দোকানে গিয়ে ২'টা মিষ্টি কেনে- এইসব কথা আর কী! ভদ্রলোক কষ্টে এখন আর কোনো বাংলাদেশিকে নিজের বাঙালি পরিচয় দেন না। কষ্ট পেতে কার ভাল্লাগে, তাও আবার এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে!

অথচ কত সহজেই না আমরা বলতে পারতাম কাঠি রোল খাওয়ার কথা, পার্ক স্ট্রিটে গিয়ে ফ্লুরিসে ব্রেকফাস্ট খাওয়ার কথা কিংবা অক্সফোর্ড থেকে বই কেনার কথা, সাড়ং থেকে শাড়ি কেনার কথা, ফ্যাব ইন্ডিয়া থেকে বুক পকেটওয়ালা পাঞ্জাবি কেনার কথা, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মাটির ভাড়ে করে মশলা চা খাওয়ার কথা, সিনেমা থিয়েটারে বসে শাহরুখ খানের নতুন সিনেমা দেখার কথা, দক্ষিণাপনে গিয়ে চা পাতা কেনার কথা।

বারবার কলকাতা যাবার কারণে কয়েক ডজন বন্ধু বানিয়ে ফেলার কথা। অথচ আমরা তা বললাম না। আমরা তার মনে একটু ক্ষত করে দিয়ে নিজের ভেতরের কোনো এক অজানা ক্ষতকে আরেকটু রগড়ে দিলাম। কী জানি কী আনন্দ হয় তাতে। অথচ কোলকাতার সব আনন্দময় স্মৃতি আমরা চাইলেই তার সাথে ভাগাভাগি করে নিতে পারতাম। বিদেশ-বিভুঁইয়ে বসে দু'জন একে অন্যের সুখানুভূতির ভাগিদার হতে পারতাম।

যাহোক, এই গল্প শোনার পর আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমরা আসলে সবাই এমন নই এবং কলকাতাকে আমরা বড্ড ভালোবাসি। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর মোটা টিপস দিয়ে, ধন্যবাদ বলে, দু'ভাই গলা মিলিয়ে বিদায় নিলাম। কিন্তু মনে প্রশ্ন'টা রয়েই গেল, আমরা এমন ব্যবহার কেন করি? কেন কলকাতার লোকদের আমাদের কৃপণ মনে হয়? যদিও কলকাতার বন্ধুরা তাদের সাধ্যের মধ্যে আমাদের কখনো একটুও কম খাওয়ায়নি, আমাদের জন্য কিছু কম করেনি।

সেদিন করোনা প্যানডেমিকের সময় কীভাবে কলকাতার মানুষ বাজার যাওয়া ছাড়ছে না কিংবা ছাড়তে পারছে না- এমন একটা রিপোর্ট দেখার পর একটু পড়াশোনা করে বিষয়'টা কিছু'টা বোঝা গেল। একটা খুব মজার তথ্য দিই আপনাদের। কলকাতায় কোনো বাঙালির বাড়িতে আপনি একটা ডিপফ্রিজ খুঁজে পাবেন না। আবার ঢাকার শহরের কোনো মধ্যবিত্তের বাড়ি আপনি ডিপ-ফ্রিজ ছাড়া পাবেন না। কারণটা হচ্ছে, কলকাতার মানুষ ফ্রিজে রেখে খাবার খায় না। প্রতিদিনের খাবার প্রতিদিন বানিয়ে খায়। রোজ বাজার করে খায়। ফ্রিজে রেখে খাওয়ার কথা তারা ভাবতেই পারে না। এটা তাদের অনেক বছরের অভ্যাস। ফ্রিজে পুঁই শাক রেখে পরে বের করে সেই শাক ছোট চিংড়ি দেয়ে রাঁধবার কথা তারা কল্পনাই করতে পারে না। তাই তারা ২০০ গ্রাম মাছ কেনে, মিষ্টির দোকান থেকে দু'জনের জন্য দু'টো মিষ্টি কিনে নিয়ে বাড়ি ফেরে।

সেইজন্য কলকাতায় লকডাউন দেবার পর ওখানে সবার প্রথম প্রশ্ন হলো, 'কাল কী খাবো?!' কারণ, কাল তো বাজার যেতে পারবো না। এমনভাবে প্রতি'টা শহরেরই নিজস্ব সংস্কৃতি থাকে, তাদের নিজস্ব আচার-ব্যবহার থাকে, যা অনেক সময় খালি চোখে ধরা পড়ে না। অনেকটা দাবার ছকের মতো, ছকের বাইরে থেকে অনেক সময় ভাল চাল চোখে পড়ে। আবার এইসব ভিন্ন ভাবনা বৈচিত্র্যই, ইংরেজিতে যাকে বলে ডাইভার্সিটি, কিন্তু পৃথিবীকে এতো বর্নিল করে তোলে। এতো বৈচিত্র্যময় বলেই কিন্তু পৃথিবী এতো সুন্দর।

অথচ সেই বৈচিত্র্যই আজ সবার গলার কাঁটা। আমার আর আপনার সংস্কৃতি, ভাষা কিংবা ধর্ম আলাদা বলেই তো আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব আরও বেশি হওয়ার কথা। মানুষের জানার আর শেখার আগ্রহই তো সেই আদি মানবকে আজ চাঁদে নিয়ে গেছে। কিন্তু আজ চারিদিকে শুধু ভাঙনের শব্দ শুনি। নিজের ভাবনা আর বৈচিত্রের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে আজ আর কেউ কারো ভাবনা শুনতেও রাজি না। বরং একই বিষয়ে অন্যের নতুন ভাবনা যেন গা এ জ্বালা ধরিয়ে দেয়। তবে করোনার এই দুঃসময়ে আমাদের বোধহয় আরো মানবিক হতে হবে। একের বৈচিত্র্য যেন হয়ে ওঠে আরেকজনের জন্য শিক্ষা। দুই এ দুই এ যেন পাঁচ বানানো যায় সেই সময় এখন। তাই কারো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার দিক থেকে বিষয়টা বুঝে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা এইমূহুর্তে খুব জরুরি এবং সেটাই মানবিকতা।

লেখক: বিজ্ঞাপন নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার

(ঢাকাটাইমস/০৭আগস্ট/এসকেএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :