করোনা ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল কতটা সুবিচার ও ন্যায়সম্মত

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ ও ড. সোচনা শোভা
 | প্রকাশিত : ০৭ আগস্ট ২০২০, ১৯:৪৫

রোগ-জীবাণু আমাদেরকে নানাভাবে কষ্ট দেয়। আর এসব থেকে মুক্তির জন্য আমাদের নানা রকম চেষ্টা থাকে। সেসব চেষ্টার মাঝে ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা একটি উত্তম কাজ। একজন বিজ্ঞানী এসব গবেষণায় নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করে, অনেক পরিশ্রম করে অবশেষে একটি ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন। আবার অনেক সময় তারা ব্যর্থ হন। গবেষণায় তিনি অনেক পশুর ওপর সেসব ভ্যাকসিন প্রয়োগ করেন। হয়তো চোখের সামনে একটি ইঁদুর বা একটি গিনিপিগের প্রাণহানি ওইসব গবেষকের কষ্টের কারণ হয়। কিন্তু তারা ভাবেন মানুষ সবার উপরে। তাই মানুষের রোগ মুক্তি ওই সব গবেষককে হাসিমুখে কষ্টকে মাথা পেতে নিতে শক্তি যোগায়।

যদিও মানব ও প্রাণী নিয়ে গবেষণা অন্যের ক্ষতির বা বেদনার কারণ হয়- তথাপি আমরা ভাবি এসব কাজ নৈতিক-আইনসম্মত। এখানে আমরা সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক কল্যাণের কথা ভেবে গবেষণাকে সমর্থন করি। কিন্তু যে নীতি বলে ‘মানুষকে মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা অনৈতিক’ সেই নীতি এমন গবেষণাকে সমর্থন করে না। আর সেজন্য গবেষণাপত্র নির্বাচনে এবং তাদের সম্মতি অর্জনে কঠোর নীতি অনুসরণ করতে হয়। আজকের দিনে গবেষণা করতে হলে কেবল সংশ্লিষ্ট মানুষটির সম্মতি যথেষ্ট নয়। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করবার জন্য সমাজ , রাষ্ট্র , সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্ব ভূমিকা পালন করে। সেজন্য চুলচেরা বিচার যারা করতে পারেন , যাদের গভীর জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং মানবিক গুণাবলী আছে তাদের সহযোগিতা নেয়া হয়।

রোগ -জীবাণুর আক্রমণে কী যন্ত্রণা একজন মানুষ ভোগ করে- তা আমরা সহজে অনুমান করতে পারি। একজন বিজ্ঞানী কি রকম কষ্ট ভোগ করে সেটাও আমরা উপলব্ধি করতে পারি। হ্যাঁ -তাদের যন্ত্রণার কথা ভেবে আমাদের মন আরও উদার হয়। মনের উপলব্ধির সেই জায়গা থেকে যেকোনো ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশ নেয়াকে আমরা একটি ভালো কাজ মনে করি। কারণ কামিনী রায়ের কবিতা থেকে আমরা সেই শিশুকালে শিখেছি –

পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি

এ জীবন মন সকলি দাও,

তার মত সুখ কোথাও কি আছে?

আপনার কথা ভুলিয়া যাও।

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালকেও আমরা তাই একটি মানবিক কাজ হিসেবে দেখছি। অনেকে এই গবেষণাকে একটি মহাবিপদ থেকে মুক্তির সম্ভাবনা হিসেবেও দেখছেন। আমরা হয়তো ভাবছি, আমার ত্যাগের বিনিময়ে যদি অন্ধকার কালো অমানিশা পেরিয়ে মুক্তির আলোর রেখা দেখা দেয়- তবে কেন আমাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করবো না?

আর ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এক্ষেত্রে নিজের দেহ দানকে নেকির বা সওয়াবের কাজ মনে করা হয়। আবেগের স্থান থেকে হয়তো ভাবছি আমার ত্যাগের বিনিময়ে কত না মানুষের উপকার হবে। মানুষের জীবন বাঁচানো একটি উত্তম কাজ। এমন সুযোগ আর কোনোদিন নাও আসতে পারে আমাদের জীবনে। যেন একটি মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়ে লড়াই করার মতো পবিত্র সুযোগ।

সুতরাং এসব যুক্তির আলোকে আমরা আমাদের শিক্ষা অনুসারে ‘আপনার’ কথা ভুলে যাচ্ছি। আমাদের পরবর্তী কথাগুলো হয়তো তাই বেমানান ও স্বার্থপর চিন্তার ফসল মনে হতে পারে। হ্যাঁ- আমরা আপনাদেরকে স্বার্থপর হতে বলছি না - আমরা আপনাদের ন্যায্য অধিকার ও সুবিচারের কথাই বলছি। আমরা চাই আমাদের সকলের অবদান থাকুক মানবতার মুক্তিতে। কিন্তু সেটা যাতে কোনোভাবে অনৈতিক না হয় সেটাও আমাদের ভাবতে হবে।

আমরা অনেকেই জানি না কোভিড -১৯ ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালটি একটি বাণিজ্যিক সংস্থার মুনাফালোভী একটি বাণিজ্যিক প্রকল্প। চীনের সিনোফার্মা যারা এই গবেষণায় আমাদেরকে যুক্ত করতে চাইছে সেটা একটি বাণিজ্যিক সংস্থা। তাদের বিপুল পরিমাণ শেয়ার বাজারে আছে। আমাদের দূরবস্থা ও মানবিকতাকে পুঁজি করে তারা বাণিজ্য করবে ভাবা যায়। সুতরাং, চুলচেরা হিসেব করে আমাদের দাবি আদায় করতে হবে। হিসেব কষাটা নৈতিক নয় কি?

যুগে যুগে লক্ষ্য করা গেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা গুলো ওই গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির মতো সস্তা মূল্যে দরিদ্রদের দূরবস্থাকে এক্সপ্লয়েট করে লাভবান হতে দৈত্ব নীতি অনুসরণ করে থাকে। যদি ইংল্যান্ডে সম্পাদিত একজন ব্রিটিশ নাগরিককে/ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পার্টিসিপেন্টকে সংশ্লিষ্ট ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিটি তিন হাজার পাউন্ড দেয় তো সেখানে বাংলাদেশের নাগরিককে দেয়া হবে হয়তো ৩০০০ টাকা। ব্রিটিশ নাগরিক পোস্ট -ট্রায়াল সুবিধা পাবে যদি কোনো প্রকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

আর বাংলাদেশের মানুষটিকে তারা ভুলে যাবে - আমরা আর কোনোদিন তাদের টিকিটি পাবো না। এই ক্লিনিকাল ট্রায়াল করতে আমাদের সরকারির কর্মকর্তারা সময় ব্যয় করে থাকে, আমাদের ডাক্তার , নার্স তাদের মেধাকে কাজে লাগায়। সেগুলোও সস্তায় কেনা হয়। অপরদিকে একজন উন্নত দেশের ডাক্তার , নার্সকে সেদেশের বেতন কাঠামো অনুসারে পরিশোধ করা হয়। উন্নত দেশের এরকম দৈত্ব নীতি কোনোভাবে ন্যায় বিচার হতে পারে না।

আজকে বাংলাদেশ যদি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অনুমোদন করে- তবে সঙ্গে সঙ্গে এই কোম্পানির শেয়ার এর দাম লাফিয়ে উঠবে। সফল হলে এটি বিক্রি করে তারা বিলিয়ন বিলিয়ন এমনকি ট্রিলিয়ন ডলার আয় করবে। সুতরাং , হিসাবটা ঠিকমত করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতিতে এমন কোনো নিয়ম নেই যা দিয়ে আমরা ওই কোম্পানিকে ক্ষতি পূরণের জন্য বা লভ্যাংশের শেয়ার পাওয়ার জন্য আইনের আওতায় আনতে পারি। সুতরাং , রাষ্ট্রর সঙ্গে রাষ্ট্রের চুক্তি হতে হবে ক্ষতিপূরণ , লভ্যাংশ বিভাজন এবং পোস্ট ট্রায়াল কেয়ার যাতে নিচ্চিত হয় । অতীতে অনেক কোম্পানি আমাদেরকে প্রতারিত করেছে- আমাদের মানবিকতাকে ব্যবহার করে। এবার আমাদের হক আদায় করে নিতে হবে।

সক্রেটিস বলেছেন অন্যের ক্ষতি না করা ন্যায়। আর প্লেটোর মতে - যারা যা কর্তব্য তা পালন করা এবং অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ না করা ন্যায়। ওই রিপাবলিকে থ্রেসিমেকাস বলেছিল ন্যায় হচ্ছে শক্তিমানের স্বাৰ্থ। বরাবর থ্রেসিমেকাসরা জয়ী হয়। এবার করোনাভাইরাস সকলের শক্তিকে একই অবস্থানে নিয়ে গেছে। এটা যদি হয় নিউ নরমাল বাস্তবতা- তবে এখানে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যাতে আমাদের সিদ্ধান্ত সঠিক হয়।

রোগ ও নিরাময়ের সঙ্গে রাজনীতি যায় কি না ভাবনার বিষয়। তবে সম্প্রতিকালের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বিষয়টি অর্থনীতি-বাণিজ্য নীতির সঙ্গে জড়িত। আমাদের এখানে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে।

কেউ হয়তো বলতে পারেন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে আমরা জানতে চাই/বিবেচনা করতে চাই মানবতাকে চীন ও চীনের কোম্পানি কীভাবে দেখছে। আমরা দেখতে চাই মানব মুক্তির জন্য তারা কতটুকু নিবেদিত। কীভাবে তারা তাদের দরদ বিশ্ববাসীর জন্য প্রকাশ করছে। আমরা জানি গৌতম বুদ্ধ জীব হত্যা মহাপাপ মনে করতেন - কিন্তু সেই দর্শনে দীক্ষিত একটি দেশের সেনারা কীভাবে আমাদের ওপর ১০ লাখ রোহিঙ্গার দায় চাপিয়ে দিয়েছে তা জানি। তারা কোথায় এতো সাহস পায় সেটাও জানা আছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমাদের নাগরিকদের ভালো মন্দ আমাদেরকে ভাবতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে ভারত আমাদের ৯০ লাখ নারী পুরুষ শিশুকে আশ্রয় দিয়েছিল। ওই ভারতীয় বাহিনী আমাদেরকে দেশকে মুক্ত করতে প্রাণ দিয়েছিল। সেই ভারতকে আমাদের শত কষ্টেও পাশে পেতে চাই। চীন সেখানে সেই ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে কী করছে সেটা কোনো একজন নাগরিক মনে করিয়ে দিতে পারেন।

আমরা এখনো কমনওয়েলথ এর সদস্য। সুতরাং আমরা কেন অক্সফোর্ডের ক্লিনিকাল ট্রায়াল হোস্ট করতে চেষ্টা করছি না প্রশ্নটি করা যুক্তিসঙ্গত নয় কি? এ ব্যাপারে ভারত আমাদের পাশে থাকতে পারে কি? ১৯৭১ সালে চীন কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পাশেই ছিল। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

১৫ আগস্ট আবার ফিরে আসছে। আমরা বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী পালন করতে পারিনি ওই ‘চাইনিজ ভাইরাস’ এর জন্য। সুতরাং, কেবল একটি ভ্যাকসিনের আশায় নিজেদেরকে বিসর্জন দেয়া যুক্তিযুক্ত হতে পারে কি?

আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র হওয়ার আগে এমন একটি সংস্থা এদেশে খাবার স্যালাইন নিয়ে গবেষণা করেছিল। পরে বাংলাদেশেকে বাদ দিয়ে কোম্পানিটি কেবল তাদের নাম রেজিস্ট্রার করে পেটেন্টের জন্য। সেই স্যালাইন থেকে ওই কোম্পানি বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য করছে। আমাদের হক তারা দেয়নি। জাপান যেখানে ৩২৯ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে মহামারি মোকাবেলা করতে সেখানে আমরা উন্নয়নের অন্যতম পার্টনারের কাছ থেকে কি পাচ্ছি সেটা কেউ জানতে চাইতে পারে।

বাংলাদেশ যদি তার অবদানের প্রকৃত মূল্য পেত তবে কেউ সাহস পেতো না বাংলাদেশকে নিয়ে খবরের শিরোনামে ‘খয়রাতি’ শব্দ ব্যবহার করতে। বিদেশি একটি কোম্পানিকে অনুমোদন দিতে বাংলাদেশের একটি সংগঠন গবেষণা করছে তাদের দিকটিও আমাদের মনে রাখা দরকার। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বিষয়টি কেবল ভারত থেকে বাংলাদেশকে দূরে সরানোর টোপ মনে করতে পারে যে কেউ। এমন জটিল পরিস্থিতিতে আমাদের সকল দুর্বলতাকে কাটিয়ে জেগে উঠবার এখনই সময়। আমরা একই সঙ্গে ১৬ কোটি বাঙালি বলতে চাই - আমরা পারি !

লেখক: অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ, দর্শন বিভাগ , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; ড. সোচনা শোভা, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :