রাজশাহীর মসজিদ মিশন একাডেমির ১১ কোটি টাকার হদিস নেই

ব্যুরো প্রধান, রাজশাহী
 | প্রকাশিত : ১০ আগস্ট ২০২০, ১৫:৪২

রাজশাহীর মসজিদ মিশন একাডেমির প্রায় ১১ কোটি টাকার হদিস পায়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর। ২০০৬-৭ অর্থ বছর থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মধ্যে এই টাকা নগদে খরচ দেখানো হয়েছে। অডিটের সময় ব্যাংক চেকের মাধ্যমে টাকা খরচের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। নগদে কোন খাতে টাকা খরচ হয়েছে তারও কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা সোমবার নগরীর একটি রেস্তোরাঁয় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এই তথ্য দিয়েছেন। এ সময় তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বিপুল পরিমাণ এই অর্থ জঙ্গিবাদ ও সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে ব্যয় করা হয়েছে।

রাজশাহীর মসজিদ মিশন একাডেমি একটি বেসরকারি সংস্থা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। বাংলাদেশ মসজিদ মিশন রাজশাহী জেলা শাখা নামের ওই সংস্থা ১৯৭৬ সালে সমাজসেবা থেকে নিবন্ধন নেয়। এরপর সংস্থাটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে স্কুলটি এমপিওভুক্ত হয়। তবে নিবন্ধনের পর সংস্থাটি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে কোনো অডিট করায়নি। নিজেদের ইচ্ছেমতো কমিটি গঠন করে সংস্থাটি পরিচালিত হয়ে আসছে। তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও কমিটি হয় নিজেদের ইচ্ছেমতো। এই স্কুলে কোনো হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় না। অমুসলিম ছেলেমেয়েদেরও এখানে পড়াশোনার সুযোগ নেই। সংস্থার ১০ কোটি ৬০ লাখ ৭৮ হাজার ৪৭০ টাকা এই স্কুলে খরচ দেখানো হয়েছে।

এই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক আমিনুল ইসলাম রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া থানা শিবিরের সাবেক সভাপতি। তিনি এখন বোয়ালিয়া থানা জামায়াতে ইসলামীর আমির। প্রভাষক মাইনুল ইসলাম রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় (রাবি) শিবিরের সেক্রেটারি ছিলেন। এখন তিনি নগর জামাতের সেক্রেটারি। সহকারী অধ্যাপক শাহাদৎ হুসাইন নগর শিবিরের সভাপতি ছিলেন। এখন নগর জামাতের সহ-সেক্রেটারি এবং তথ্য ও প্রচার সম্পাদক। প্রভাষক কামরুজ্জামান সোহেল ছিলেন রাজপাড়া থানা শিবিরের সভাপতি। এখন থানা জামাতের আমির।

প্রভাষক সিরাজুল ইসলাম ছিলেন বোয়ালিয়া থানা শিবিরের সভাপতি। সহকারি শিক্ষক ফরিদ উদ্দীন আত্তার ছিলেন চট্টগ্রামের দুর্ধর্ষ শিবির নেতা। এখন তিনি রাজশাহী নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা থানা জামায়াতের আমির। এছাড়া প্রভাষক তৌহিদুল ইসলাম নগরীর ৮ নম্বর ওয়ার্ড জামায়াতের সভাপতি।

সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ফজলে হোসেন বাদশা এসব শিক্ষকের সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ তুলে ধরেন। তিনি জানান, মসজিদ মিশন একাডেমির প্রভাষক মাইনুল ইসলাম নগরীর লক্ষ্মীপুরের জমজম ইসলামী হাসসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও চাকরি করছেন। অনিয়ম করে দুই স্থান থেকেই বেতন নেন। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৪টি মামলা রয়েছে। প্রতিটি মামলার নম্বর তুলে ধরা হয়।

মসজিদ মিশন একাডেমির সহকারী প্রধান শিক্ষক আমিনুল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক শাহাদৎ হুসাইন ও প্রভাষক সিরাজুল ইসলামের চারটি করে মামলার বিবরণ তুলে ধরা হয়। এছাড়া প্রভাষক কামরুজ্জামান সোহেলের সাতটি এবং সহকারী শিক্ষক ফরিদ উদ্দীন আত্তার ও তৌহিদুল ইসলামের দুটি করে মামলার বিবরণ দেয়া হয়। এরা স্কুল ছুটির পর সেখানেই সরকারবিরোধী গোপন বৈঠক করার সময় গ্রেপ্তার হয়েছেন একাধিকবার। কিছু দিন পর জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। কিন্তু মসজিদ মিশন সংস্থা কিংবা স্কুল পরিচালনা কমিটি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এর আগে গত ২২ জুলাই বাংলাদেশ মসজিদ মিশনের রাজশাহী জেলা শাখার নিবন্ধন বাতিল করতে সমাজসেবা কার্যালয়কে আধা-সরকারি (ডিও) চিঠি দেন সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা। এতে তিনি বলেছেন, অরাজনৈতিক সংস্থা হিসেবে নিবন্ধন নিয়ে মসজিদ মিশন রাজশাহীতে জামায়াত-শিবিরের সরাসরি সম্পৃক্ততায় পরিচালিত হচ্ছে। শুরু থেকেই সংস্থাটির কর্মকাণ্ড স্বাধীনতাবিরোধী এবং জনগণ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণামূলক। তাই এটির নিবন্ধন বাতিল করা প্রয়োজন।

সোমবার সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে মসজিদ মিশন সংস্থা চলছে। তাদের গঠনতন্ত্রের কোথাও স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা ছিল না। কিন্তু তারা করেছে। তারা ইচ্ছেমতো স্কুলটি পরিচালনা করে। তাই সংস্থাটির নিবন্ধন বাতিল করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে স্কুলটি সরকারের তত্ত্বাবধানে নেয়া প্রয়োজন।

তিনি বলেন, স্কুলে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংগীত গাওয়া হতো না। আমরা বাধ্য করেছি। কিন্তু স্কুলে এখনও সরকারের পাঠ্যসূচি অনুসরণ করা হয় না। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জামাতের বই পড়ানো হয়। তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা হয়। এ টাকা জঙ্গিবাদ-নাশকতায় ব্যয় করা হয়। এক সময় বাংলা ভাইকে সহায়তা করা হতো। আমরা তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব দেখতে চাই।

ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, শিক্ষাবোর্ড মসজিদ মিশন একাডেমির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সমাজসেবা অধিদপ্তর সংস্থার বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এখনও আলী আহসান মুজাহিদের ভুতরা অধিদপ্তরের ভেতরে আছে। সেজন্যই কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যেসব কর্মকর্তা এই সংস্থাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তারা জামাত-জঙ্গিদের এজেন্ট। এই সংস্থা এতদিন কীভাবে চলল তার কৈফিয়ত তাদের দিতে হবে। যেসব কর্মকর্তা এতদিন বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন আমি তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাই।

সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা গত ২২ জুলাই মসজিদ মিশন একাডেমির নানা অনিয়ম ও সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রশ্নে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দেন। এছাড়া ১০ আগস্ট মসজিদ মিশন সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জেলা প্রশাসককে একটি চিঠি দিয়েছেন। আর সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশার চিঠির প্রেক্ষিতে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক হাসিনা মমতাজ ২৭ জুলাই অধিদপ্তরের পরিচালককে (কার্যক্রম) একটি চিঠি দিয়েছেন।

এতে হাসিনা মমতাজ উল্লেখ করেছেন, মসজিদ মিশন সংস্থার রাজশাহী জেলা শাখা ১৯৭৬ সালের ২৯ জুন সমাজসেবা কার্যালয় থেকে নিবন্ধন নেয়। কিন্তু এরপর থেকে বার্ষিক প্রতিবেদন, অডিট রিপোর্ট, অনুমোদনের জন্য কার্যকরী কমিটি পাঠানোসহ অন্য কোনো কারণে কোনো দিন যোগাযোগ করেনি। এ অবস্থায় ওই চিঠিতে পরিচালকের কাছে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চাওয়া হয়।

সোমবার হাসিনা মমতাজ জানান, অধিদপ্তর থেকে এখনও কোনো নির্দেশনা আসেনি। যে নির্দেশনা আসবে সে অনুযায়ী সংস্থাটির ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর মসজিদ মিশন একাডেমির অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মোকবুল হোসেনকেও ফোন করা হয়। তবে ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে তিনি কথা বলতে চাননি।

(ঢাকাটাইমস/১০জুলাই/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :