করোনা সংক্রমণ ‘এ’ গ্রুপে বেশি ‘ও’ গ্রুপে কম

প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০২০, ১৩:৫৮ | আপডেট: ১১ আগস্ট ২০২০, ১৪:০৩

স্বাস্থ্য ডেস্ক, ঢাকাটাইমস

করোনাভাইরাসে শঙ্কিত বিশ্বের মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে এক গবেষণা বলছে, যারা এ গ্রুপের (দ্বিতীয় রক্তের ধরন) রক্ত বহন করছেন তারা করোনা আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে বেশি আশঙ্কায় রয়েছেন। আবার যারা ও গ্রুপের রক্ত বহন করছেন তারা কম শঙ্কায় রয়েছেন।

চীনের একদল বিজ্ঞানীর করা এক গবেষণাপত্রে এমন তথ্য জানানো হয়েছে। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে মেডরেক্সিভ ওয়েবসাইটে। বিজ্ঞানীরা উহান ও শেনজেন হাসপাতালের দুই হাজার রোগীর তথ্য নিয়ে এই গবেষণা করেছেন।

করোনা ভাইরাস শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে কি সহায়ক হয়ে উঠছে রক্তের বিশেষ কোনও একটি গ্রুপ? সেই গ্রুপের রক্ত যার, করোনাভাইরাস কি তার শরীরেই আরও মারাত্মক হয়ে উঠছে? অন্য গ্রুপগুলোর রক্ত যাদের, সেই রোগীদের শরীরে কি করোনাভাইরাস ততটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারছে না? পাচ্ছে কিছুটা প্রতিরোধ?

অপরদিকে সম্প্রতি একটি গবেষণা এই প্রশ্নগুলো তুলে দিল। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক চিকিৎসা-জার্নাল ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’-এ।

গবেষণা চালানো হয়েছে ইউরোপের দু’টি দেশ স্পেন ও ইটালিতে। করোনা সংক্রমণের হার ও মৃতের সংখ্যায় যে দু’টি দেশই রয়েছে সামনের সারিতে। গবেষণাটি নির্দিষ্ট জিন ও ক্রোমোজোমের সঙ্গে রোগীদের দেহে করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ হয়ে ওঠার একটি সম্পর্ক (‘কোরিলেশন্স’ বা ‘অ্যাসোসিয়েশন’) খুঁজে পেয়েছে বলে দাবি গবেষকদের। অভিনব পর্যবেক্ষণটি নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে শোরগোলও পড়ে গিয়েছে।

গবেষকদের দাবি, তারা দেখেছেন, ‘এ’ গ্রুপের (পজিটিভ ও নেগেটিভ) রক্তবাহকদের শরীরে কোভিড-১৯ ভাইরাস বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠছে। অন্যান্য গ্রুপের রক্তবাহকদের থেকে অন্তত ৪৫ শতাংশ বেশি। কিন্তু ‘ও’ গ্রুপের (পজিটিভ ও নেগেটিভ) রক্তবাহকদের শরীরে কোভিড-১৯ ভাইরাস ততটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারছে না। অন্যান্য গ্রুপের মতোই ও গ্রুপের অন্তত ৬৫ শতাংশ রক্তবাহকের দেহে করোনা সংক্রমণ ঘটছে।

তাদের এও দাবি, ‘এবি’ এবং ‘বি’ গ্রুপের (পজিটিভ ও নেগেটিভ) রক্তবাহকদের শরীরেও কোভিড-১৯ ভাইরাস এ গ্রুপের রক্তবাহক রোগীদের মতো ততটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারছে না। তবে আমাদের শরীরে কোভিডের দ্রুত ভয়াবহ ওঠা রোখার ব্যাপারে ও গ্রুপের মতো ততটা কার্যকরী নয় এবি এবং বি গ্রুপের রক্ত। এবি গ্রুপের ক্ষমতা ও গ্রুপের চেয়ে কম। বি গ্রুপের ক্ষমতা এবি গ্রুপের চেয়েও কম।

স্পেন ও ইটালির করোনায় চরম সঙ্কটাপন্ন আট লক্ষেরও বেশি মানুষের জিনোম পরীক্ষা করেছেন বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। তাঁদের সঙ্গে তুলনা করেছেন আরও বহু মানুষকে, যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হননি।

রক্তের গ্রুপ কী কেন?

 

মানবশরীরে রক্তের গ্রুপ মূলত হয় চার ধরনের। ‘এ’, ‘বি’, ‘এবি’ এবং ‘ও’। প্রতিটি গ্রুপই আবার দু’ধরনের হতে পারে। পজিটিভ ও নেগেটিভ। ফলে, সঠিক ভাবে বলতে হলে, মানবদেহে মোট আট ধরনের রক্তের গ্রুপ হয়। যেমন, এ পজিটিভ, এ নেগেটিভ, ও পজিটিভ, ও নেগেটিভ ইত্যাদি। এই সবক’টি মিলিয়ে বলা হয়, ‘এবিও ব্লাড গ্রুপ’। এবিও ব্লাড গ্রুপকে নিয়ন্ত্রণ করে মূলত যে জিন, সেটি থাকে আমাদের নবম ক্রোমোজোমে। নদী যেমন গতিধারায় বিভিন্ন শাখা নদীতে ভেঙে যায়, তেমনই রক্তের প্রতিটি গ্রুপের জন্যই থাকে নির্দিষ্ট এক-একটি জিন। এ গ্রুপের জন্য এ জিন, বি গ্রুপের জন্য বি জিন, ইত্যাদি।

রক্তের এই চারটি গ্রুপ পজিটিভ হবে নাকি নেগেটিভ, তা নির্ভর করে আমাদের শরীরে আরও এক ধরনের রক্ত সংবহনতন্ত্রের উপর। তার নাম ‘রেশাস (আরএইচ)’। এই গ্রুপেরও অনেক সাব-গ্রুপ রয়েছে। রক্তের এই রেশাস গ্রুপটিকে নিয়ন্ত্রণ করে যে জিন, সেটি থাকে আমাদের প্রথম ক্রোমোজোমে। এই গ্রুপেরও অনেক প্রকারভেদ রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- আরএইচডি।

কারও শরীরে আরএইচডি পজিটিভ গ্রুপের রক্ত থাকলে তখন তাঁর রক্তের গ্রুপ হয় এ পজিটিভ বা বি পজিটিভ হবে। না হলে হবে এবি পজিটিভ অথবা ও পজিটিভ। আর কারও শরীরে আরএইচডি নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত থাকলে তখন তাঁর রক্তের গ্রুপ হয় এ নেগেটিভ বা বি নেগেটিভ হবে। না হলে হবে এবি নেগেটিভ অথবা ও নেগেটিভ। বেশির ভাগ মানুষেরই রক্তের গ্রুপ হয় পজিটিভ। তাই নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত পেতে এত ঘাম ঝরাতে হয় আমাদের।

রক্তের গ্রুপ আমরা পেয়ে থাকি মা, বাবার কাছ থেকে। এর উপর আমাদের বা পরিবেশের কোনও হাত নেই। তবে আমাদের রক্তের গ্রুপ কেন বিভিন্ন হয়, তারা আমাদের শরীরের গঠনে নির্দিষ্ট কী কী ভূমিকা নেয়, তা এখনও নিশ্চিত ভাবে জেনে-বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি বিজ্ঞানীদের পক্ষে। বিভিন্ন ভাইরাস ও রোগের হানাদারির ক্ষেত্রে তারা কে কতটা সহায়ক বা প্রতিরোধী, সে সম্পর্কেও খুব সামান্যই জানা সম্ভব হয়েছে।

রক্তের বিভিন্ন গ্রুপ আবিষ্কার করেছিলেন অস্ট্রিয়ায় ইমিউনোলজিস্ট কার্ল ল্যান্ডস্টিনার। পরে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। তার আগে উনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুতে লন্ডনের এক নামজাদা চিকিৎসক জেমস ব্লান্‌ডেল রোগীদের বাঁচানোর জন্য অন্য ১০ জনের রক্ত ১০ জন রোগীকে দিয়েছিলেন। যা ‘ব্লাড ট্রান্সফিউশন’ নামে এখন খুবই প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি। কিন্তু ব্লান্‌ডেল যে ১০ জনের রক্ত বদলেছিলেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র পাঁচ জনকে বাঁচাতে পেরেছিলেন। বাকি পাঁচ জনকে বাঁচাতে পারেননি। ব্লান্‌ডেল তখনও জানতেন না সকলের রক্ত নিতে পারে না মানুষ। এও জানতেন না মানুষ শুধুই কয়েকটি বিশেষ গ্রুপের রক্ত নিতে পারে।

কলকাতার ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, এবিও এবং আরএইচ মিলিয়ে রক্তের যে আট রকম গ্রুপ আছে, তাদের প্রত্যেকেরই আছে নির্দিষ্ট আলাদা আলাদা অ্যান্টিবডি ও আলাদা আলাদা অ্যান্টিজেন। এই অ্যান্টিবডিগুলি আমাদের দেহের স্বাভাবিক প্রতিরোধী ব্যবস্থার অংশবিশেষ। আর অ্যান্টিজেনগুলো তৈরি হয় শর্করা আর প্রোটিন দিয়ে। যেগুলি লোহিত রক্তকণিকার উপরে আস্তরণ তৈরি করে।

বিভিন্ন গ্রুপের রক্তের অ্যান্টিবডিগুলি বাইরে থেকে শরীরে ঢোকা (‘ফরেন’) অ্যান্টিজেনগুলিকে চিনে ফেলতে পারে। আর সঙ্গে সঙ্গে তারা দেহের প্রতিরোধী ব্যবস্থার কাছে বার্তা পাঠায় সেগুলিকে ধ্বংস করে ফেলার জন্য। সে জন্যই যে কারও থেকে নিয়ে যে কোনও গ্রুপের রক্ত অন্য কারও শরীরে ঢোকালে তা রোগীর পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

মনে করেন আমার শরীরে রয়েছে এ পজিটিভ গ্রুপের রক্ত। ডাক্তার যদি আমাকে বি অথবা এবি গ্রুপের রক্ত দেন, তা হলে আমি মারা যাব। কারণ, আমার দেহের এ পজিটিভ গ্রুপের রক্তে স্বাভাবিক ভাবেই তৈরি হয়ে গিয়েছে বি অ্যান্টিবডি। সেই অ্যান্টিবডি অন্য কারও শরীর থেকে নেওয়া বি গ্রুপের রক্তের অ্যান্টিজেনকে দেখা মাত্রই চিনে ফেলবে। আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেহের প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে বলবে সেগুলিকে মেরে ফেলতে। ফলে, আমার রক্ত জমাট (‘ক্লটিং’) বেঁধে যাবে। তার ফলে ব্যাঘাত ঘটবে রক্ত সংবহনে। নাক, মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে। শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকবে। পরিণতি হবে মৃত্যু।

একই ভাবে আমার শরীরে যদি বি পজিটিভ গ্রুপের রক্ত থাকে, তা হলে স্বাভাবিক ভাবেই তৈরি হয়ে যেত এ অ্যান্টিবডি। ফলে, তখনও আমাকে এ অথবা এবি গ্রুপ দেওয়া হলে আমার রক্ত জমাট বেঁধে যেত। তার ফলে ব্যাঘাত ঘটত রক্ত সংবহনে। নাক, মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসত। শ্বাসকষ্ট বাড়তে বাড়তে পরিণতি হত মৃত্যু। ফলে, প্রথম ক্ষেত্রে যেমন আমাকে এ অথবা ও গ্রুপের রক্ত দেওয়া হলে বেঁচে যাব, তেমনই দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বেঁচে যাব আমাকে বি অথবা ও গ্রুপের রক্ত দেওয়া হলে।

হেমাটোলজিস্ট ও ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, অযথা আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। সবে ৬/৭ মাস হয়েছে। কোভিডকে এখনও পুরোপুরি চিনে-বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। যেটুকু তথ্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে, তার ভিত্তিতেই পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা চালানো হচ্ছে। চালাতে হচ্ছে। ভাইরাসটি আমাদের শরীরে কী ভাবে কাজ করে, কোথায় কোথায় কতটা ক্ষয়-ক্ষতি করে সেটা জানতে ও বুঝতে। তার ফলে, নানা ধরনের তথ্য বেরিয়ে আসছে। যা পরবর্তী কালে সত্য প্রমাণিত হতে পারে আবার না-ও পারে। সন্ধানই এগিয়ে নিয়ে যায় বিজ্ঞানকে। অযথা আতঙ্ক ছড়ানো বিজ্ঞানের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নয়।

(ঢাকাটাইমস/১১আগস্ট/আরজেড/এজেড)