নয়নসমুখে তুমি নাই

এম মতিউর রহমান মামুন
 | প্রকাশিত : ১২ আগস্ট ২০২০, ১১:১৪

তিনি রাজনৈতিক মানুষ হলেও ছিলেন সাংস্কৃতিসেবী, সম্পাদনা করেছেন আন্তর্জাতিক রবীন্দ্র জার্নাল। নিরলস সাহিত্য সাধনা করেছেন। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে ১৭ জুলাই সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে বাসাতে এসে গানে বসে আমাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাস করলেন, 'মামুন আমি কী আগের মতো গান করতে পারছি'? উত্তরে বললাম, না। কিছু সময় নীরব থেকে বললে্‌ 'শরীরের যে পরিস্থিতি কী হবে জানি না, যদি কিছু হয়েই যায় পতিসরে তুমি তোমার দায়িত্ব যথাযথ পালন করবে। একমাত্র তুমি পারবে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের পতিসরে আমার অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নিতে'। ইরাফিল আলম এমপির অকাল প্রয়াণে অন্ধকার আত্রাই রাণীনগরের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন।তাঁর অকাল মৃত্যুতে পতিসর কী অন্ধকার হবে?

এ কথা বললাম এই জন্য যে, রবীন্দ্রনাথের জন্ম মৃত্যুদিবসে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছেন তা আর কার পক্ষে সম্ভব! কে আর রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্যদের পতিসরে অতিথি করবে, কে আর শান্তিনিকেতনে শিল্পিদের নিজ খরচে পতিসর এনে অনুষ্ঠান করবে? কে আর ফোন করে বলবে , 'আমরা এখনো রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়ান ২২ শ্রাবণ সরকারিভাবে শুরু করতে পরিনি, নিশ্চই আমাদের ব্যর্থতা। ড. আতিউর রহমান পতিসরে যাবেন কি না? ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার কোন পথে পতিসরে যাবেন আমাকে জানাবে, আমি সুস্থ হতে পারলে নিশ্চই পতিসরে পৌঁছে যাব'। হার্টের অসুস্থতা নিয়ে এমন জিজ্ঞাসা হয়তো আমাকে আজীবন কাঁদাবে।

কতটা সাহিত্য পাগল ছিলেন এই সাংসদ তার একটি উদাহরণ বলতে পারি-

২০১৬ সালে ১০ মে বাংলা একাডেমির মাঠ পর্যায়ে গবেষণা প্রোগ্রাম ছিল পতিসরে, স্থানীয় আয়োজক হিসাবে সেই বিষয় নিয়ে একাডেমিতে শামসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে আলাপ করছিলাম। আলোচলায় অতিথি হিসবে বহু গুণীজনের নাম এল, বিশেষ করে স্থানীয় এমপি ইসরাফিল আলম, প্রফেসর ড. সনৎ কুমার সাহা, প্রফেসর ড. জুলফিকার মতিন, বাংলা একাডেমীর দুজন পরিচালক। আলোচনার মূল বিষয় নির্ধারণ করা হলো রবীন্দ্রনাথের 'শিক্ষা ও সমাজ ভাবনা'। আমাকে কাছে পেলে শামসুজ্জামান স্যার প্রায়ই পতিসর ও ররীন্দ্রনাথকে নিয়ে আলোচনা করতেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রাথের দীর্ঘ ৪৬ বছরের পতিসরে আসা-যাওয়া এবং সাহিত্য কর্মের বাইরে যে গ্রামোন্নয়ন, আধুনিক সমাজ গড়ন, শিক্ষা, কৃষি ও ব্যাংক ব্যাবস্থা নিয়ে কাজ করেছিলেন তা থেকে শত বছর পরে কতটুকু আমরা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি এমন বিষয়। রবীন্দ্রনাথের কৃষিসমবায় ব্যাংকের যে লেজার উদ্ধার করে সরকারকে দিয়েছি, তার যথাযথ সংরক্ষণ ও পতিসরে কৃষি বিশ্ববিদ্যায় স্থাপনের গুরুত্ব আলোচনায় উঠে আসতন। ৩ মে ২০১৬ বাংলা একাডেমিতে স্যারের সঙ্গে পতিসরের অনুষ্ঠান নিয়ে কথা বলছিলাম, আলোচনার মাঝে আমার ফোনটা বেজে উঠল, দেখলাম রবীন্দ্র জার্নালের সম্পাদক, শ্রদ্ধাভাজন সাংসদ ইসরাফিল আলম। আমাকে বললেন, 'জানি তুমি ব্যস্ত আছো, ধৈর্য এবং আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাও, মনে রাখবে রবি ঠাকুরের জন্ম মানেই বাঙালিদের জন্ম। আর একটি বিষয় তুমি আমাকে পরিষ্কার করে বলো, হাতে কলম নিয়ে বসে আছি, ররীন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিসর হাইস্কুলের ছাত্রশিক্ষদের উপদেশ দিয়ে আশিরবাণীতে কী যেন লিখেছিলেন? ঐ যে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক নির্যাতন না করতে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের উপদেশ দিয়েছিলেন?'

আমি কোনো কিছু না ভেবেই ফোনেই বলতে শুরু করলাম, "রথীন্দ্রনাথের নামচিহ্নিত কালীগ্রামের এই বিদ্যালয়ের আমি উন্নতি কামনা করি। এখানে ছাত্র এবং শিক্ষকদের সম্বন্ধ যেন অকৃত্রিম স্নেহের এবং ধৈর্য্যের দ্বারা সত্য ও মধুর হয়— এই আমার উপদেশ। শিক্ষাদান উপলক্ষে ছাত্রদিগকে শাসন পীড়নে অপমানিত করা অক্ষম ও কাপুরুষের কর্ম— একথা সর্ব্বদা মনে রাখা উচিত। এরূপ শিক্ষাদান প্রণালী— শিক্ষকদের পক্ষে আত্মসম্মানের হানিজনক। সাধারণতঃ আমাদের দেশে অল্পবয়স্ক বালকগণ প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষকদের নির্মম শাসনের উপলক্ষ্য হইয়া থাকে— একথা আমার জানা আছে। সেই কারণেই সতর্ক করিয়া দিলাম।"।

আমার খেয়াল ছিল না আমরা আলেচনা করছিলাম, সেখানে ছিলেন একজন সচীব, আধ্যাপক, গবেষকসহ আরও কিছু গুণী মানুষ। স্যার আমার কাছে জানতে চাইলেন কে ফোন করেছিল? আমি বললাম 'রবীন্দ্র জার্নালের সম্পাদক এমপি ইসরাফিল আলম। কিছু সময় নীরব থেকে স্যার বললেন 'আমাদের দেশ এবার অনেক এগিয়ে যাবে'। আমি জিজ্ঞাস করলাম কেন? স্যার বললেন, 'একজন সংসদ সদস্য যখন ফোনে সাহিত্যচর্চা করেন তার মানে বুঝতে হবে আমরা অনেক এগিয়ে যাচ্ছি।'

অজস্র ধারার বহুমাত্রিক প্রতিভার মানুষ ইসরাফিল আলমের সঙ্গে আমার পরিচয় পতিসরে 'রবীন্দ্র সাহিত্য পরিষদ' প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। পতিসর তখন বইশূন্য ছিল। রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের কাচারি বাড়ির চারদিকটা ছিল অবৈধ দখলদারদের হাতে জিম্মি। বাড়ির মধ্যে কার্ড খেলা, সভা সমাবেশ, বারান্দায় রীতিমতো চলত চাল-ডাল বিক্রি, নিচে মাছের আড়ত। ঠিক এমন যখন পতিসর, তখন সাহিত্য পরিষদের জন্য প্রায় লক্ষাধিক টাকার বই, হারমোনিয়ানসহ তাঁর প্রিয় সাংবাদিক বন্ধু দিনেশ দাসকে নিয়ে পতিসরে এসেছিলেন ইসরাফিল আলম।

তিনি সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুয়, কখনো নেতা-কর্মীদের সঙ্গে রেগে কথা বলতে দেখিনি। বরং নেতাকর্মী যত রেগেই যাক মাথায় পরশ দিয়ে শান্ত করেন। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা শুনেছেন মন দিয়ে, দুঃখ-কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করেছেন। আত্রাই-রাণীনগরে নির্য়াতিত মানুষের পাশে থাকেছেন। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, সর্বহারামুক্ত আত্রাই-রাণীনগর গড়ে তুলে জননেতা ইসরাফিল আলম মানুষের মনের মাঠে আছেন, থাকবেন।

আত্রাই-রাণীনগরে অন্ধকার চিরে আলোর জোসনা এনে দিয়েছেন তিনি। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী জননেতা ইসরাফিল আলম গুণী রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক, সংগঠক, শিল্পী বটে। অভাবগ্রস্ত সাধারণের কথা ভাবেন, গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার জন্য সহযোগিতা করেন। দলীয় অনুষ্ঠানেও সহয়োগিতা করেন রীতিমতো। নেতাকর্মীর অভাব মোচন করেছেন যথাযথ।

এভাবেই ইসরাফিল আলম আত্রাই-রাণীনগরে গণমানুষের নেতা হয়েছিলেন। নির্যাতিত মানুষের পাশে থেকেছেন। জঙ্গিবাদমুক্ত, নকশালমুক্ত আত্রাই-রাণীনগর গড়ে জননেতা মো. ইসরাফিল আলম চির অম্লান এই জনপদে।

তাঁর হাতের ছোঁয়াতে রবিতীর্থ পতিসরে উন্নতি হয়েছে। বহু কাজের পরিকল্পনা করেছিলেন, তা এখন অসমাপ্ত। একসময়ের ভারতীয় হাইকমিশনার কে পি মুন্সি রবীন্দ্র উদ্যানে দাঁড়িয়ে ইসরাফিল ভাইকে বললেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিসরে (১৯০৫) যে বিদ্যালয় করেছেন তা ভারতের ইতিহাস। বিদ্যালয় সরকারি করণসহ বিদ্যালয়ের প্রবেশ রাস্তা উন্নত করা জরঋ'। এই তো মৃত্যুর কয়েক দিন আগে সেই রাস্তা টাইলস দ্বারা নির্মাণ, পতিসরে হাইটেক পার্ক, অডিটোরিয়াম, ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যাল নিয়ে আলোচনা করলেন।

গণমানুষের চাওয়া তিনি পূরণ করেছেন, গণমানুষের কথাই তিনি বলেছেন আজীবন। তাঁর অকাল প্রয়াণে আত্রাই-রাণীনগরে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা কোনো কিছুর বিনিময়ে পূরণ সম্ভব হবে না। তার সৃষ্টির মাঝে তিনি চির অমর, চির অম্লান। জনতার চাওয়া পূর্ণ করেছেন ইসরাফিল আলম। তাঁর রেখে যাওয়া অসমাপ্ত বাঁকি কাজ যথাযথ সম্পন্ন হোক, সেই প্রত্যাশা তো থেকেই যায়।

লেখকঃ রবীন্দ্রস্মৃতি সংগ্রাহক ও গবেষক

(ঢাকাটাইমস/১২আগস্ট/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :