এক ট্রিপে তিন ট্রিপের লাভ!

প্রকাশ | ১৪ আগস্ট ২০২০, ১৩:১৫ | আপডেট: ১৪ আগস্ট ২০২০, ১৪:৫৬

বোরহান উদ্দিন

সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় স্বাভাবিক সময়ে আজিজুর রহমান ৪৫০ টাকা বাস ভাড়ায় আসা-যাওয়া করতেন। কিন্তু ঈদের ছুটিতে ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা আসা-যাওয়ায় প্রত্যেকবার তাকে গুনতে হয়েছে ৮০০ টাকা করে। তবে করোনাকালে সরকারের বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী বাসে অর্ধেক যাত্রী থাকার কথা থাকলেও ‘কিং ফিশার’ পরিবহনের বাসটির প্রত্যেক সিটেই যাত্রী নেওয়া হয়। আবার ভাড়াও আদায় করা হয় যাত্রীপিছু দ্বিগুণ হারে।

ফলে করোনায় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে সরকারের যে নির্দেশনা তা মোটেও মানার সুযোগ ছিল না আজিজের যাত্রায়। এক্ষেত্রে পরিবহন চালক-শ্রমিকদের পাশাপাশি মালিকদের কাছে কার্যত জিম্মি হয়ে পড়েছে যাত্রীরা। এজন্য সরকারের নির্দেশনা মানা নিয়ে কোনো তদারকি না থাকাকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।

হিসাব করে দেখা গেছে, বাড়তি ভাড়া নিয়েও সব সিটে যাত্রী বহন করায় এক ট্রিপে ‘কিং ফিশার’ বাসটি প্রায় তিন ট্রিপের মুনাফা করেছে। কারণ এমনভাবে চলাচল করায় স্টাফদের বেতনভাতা, তেল এবং সড়কের খরচ বেঁচে গিয়েছে। তবে এমনভাবে দূরপাল্লার যাতায়াতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত না হওয়ায় যাত্রীদের করোনা ঝুঁকিও বেড়েছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে ঈদের আগে-পরে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি শুধু সাতক্ষীরা রুটই নয়, দেশের কিছু কিছু রুট ছাড়া বেশিরভাগ সরকারের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি। এতে একেকটি পরিবহন যেমন বেশি মুনাফা করেছে অন্যদিকে যাত্রীদের পকেট কাটা গেছে।

গত ১ জুন থেকে সীমিত পরিসরে শর্ত সাপেক্ষে ৫০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর অনুমোদন দেয়া হয়। তখন থেকে বাড়তি ভাড়া নিলেও স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করছে গণপরিবহন সংশ্লিষ্টরা।

এমন চিত্র শুধু দূরপাল্লার বাসেই নয়, রাজধানীতেও বাড়তি ভাড়া নিলেও ডাবল সিটে যাত্রী বহন করছে অধিকাংশ বাস। বিশেষ করে সকালে এবং বিকালে অফিস ছুটির সময় এমন চিত্র বেশি দেখা যায়। এ নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে নিয়মিত স্টাফদের বচসার ঘটনাও ঘটেছে।

দিনে দুপুরে এমন অনিয়ম চললেও অনেকেই মুখ বুঝে সহ্য করেছেন। তবে কোথাও কোথাও যাত্রীরা পরিবহনের অনিয়ম নিয়ে প্রশাসনকে অবহিত করায় মোবাইল কোর্টে জরিমানা করা হয়েছে।  অভিযোগ আছে, করোনার মহামারির মধ্যে এমন ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল বন্ধে হাইওয়ে পুলিশ যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। পথে পথে তল্লাশিতেও ঢিলেঢালা ভাব ছিল।

পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় তারা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। সরকার শর্তসাপেক্ষে বাড়তি ভাড়া নেয়ার শর্তে গাড়ি চলাচলের অনুমতি দিলেও ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা অসম্ভব। তাই কোথাও কোথাও বেশি টাকা নিলেও যাত্রী বেশি নেয়া হয়েছে।

বাস মালিকদের পকেটে বাড়তি মুনাফা

রংপুর রুটে চলাচলকারী একটি পরিবহনের স্টাফদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা থেকে রংপুরে গাড়িভেদে এবং যাত্রীর চাপ অনুযায়ী ৫শ থেকে ৮শ টাকা ভাড়া নেয়া হচ্ছে। কিন্তু কাউন্টার থেকেই ডাবল সিট বিক্রি হচ্ছে। যাত্রাপথে যমুনা ব্রিজের টোল ছাড়া ৫ স্পটে চারশ ৮০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।

এছাড়া আসা-যাওয়ায় তেল খরচ আট হাজার, চালকের বেতন এক হাজার ৩শ, সুপারভাইজার ৮শ ও হেলপারের বেতন ৪শ টাকা। সেক্ষেত্রে এক ট্রিপে ডাবল সিটে ৬০ ভাগ বাড়তি ভাড়া নিয়ে চলাচল করায় প্রায় তিন ট্রিপের সমান আয় করছেন বাস মালিকরা। তবে ঢাকা থেকে বিভিন্ন রুটে চলা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রায় সব বাস সামাজিক দূরত্ব মেনে দুই সিটে একজন করে যাত্রী বহন করে চলাচল করছে।

জানা গেছে, ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটে সোহাগ, তিশা, রয়েল পরিবহনে স্বাভাবিক সময়ে ভাড়া ২শ টাকা। করোনার কারণে ৬০ ভাগ বৃদ্ধির পর এক সিট খালি রেখে ভাড়া রাখার কথা ৩২০ টাকা। কিন্তু এই রুটের সব বাসগুলোতে ‘ফ্যামিলি প্যাকেজের’ নামে দুই সিটে যাত্রী নিয়ে সোহাগ পরিবহন ৫৪০, তিশা এবং রয়েল পরিবহন ৬০০ টাকা করে ভাড়া নিচ্ছে।

হিসেব করে দেখা গেছে, ঢাকা-সাতক্ষীরা রুটের ৪৪ আসনের একটি বাসে স্বাভাবিক সময় ৪৫০টাকা করে ভাড়া নেয়া হত। যাতে তাদের মোট ভাড়া আসত ১৯হাজার ৮শ টাকা। করোনকালে সব সিটে যাত্রী নিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৮শ টাকা করে। যাতে আয় হচ্ছে ৩২ হাজার ২শ টাকা। সেক্ষেত্রে একবারের খরচে বাস মালিক পাক্কা ১৬ হাজার  টাকা বেশি আয় করেছেন।

ঢাকার বাস থেকে স্যানিটাইজার উধাও

দূরপাল্লার বাসে যখন এই অবস্থা তখন ঢাকার মধ্যে চলা বাসগুলোতে মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব। বেশিরভাগ বাস চলছে দুই সিটে যাত্রী নিয়ে। আবার যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। করোনার প্রকোপের শুরুর দিকে হেলপারের হাতে স্যানিটাইজারের বোতল দেখা যেত। বাসে ওঠার সময় যাত্রীদের হাতে স্প্রে করে দেয়া হত। কিন্তু এখন হেলপারদের হাতে সেই বোতলও দেখা যায় না। সেগুলো গেটের কাছের একটি সিটের পেছেনে ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। আবার চালক-হেলপার বেশিরভাগের মুখে মাস্কও দেখা যায় না।

মিরপুর থেকে বাংলামোটর আসতে প্রতিদিন ‘শিকড়’ পরিবহণে চলাচল করেন সাইফুর রহমান। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক সিটে যাত্রীও নেয় আবার বাড়তি ভাড়াও নেয়। প্রায় দিনই এ নিয়ে ঝগড়া হয়। কিন্তু সমাধান হয় না।’

অতিরিক্ত ভাড়া প্রত্যাহারের দাবি

এদিকে করোনা মহামারির মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন পরিচালনার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার অজুহাতে বাসের ৬০ শতাংশ বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, এখন দেশের কোনো গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। গাদাগাদি করে যাত্রী বহন করা হচ্ছে। কিন্তু সব পরিবহণে বাড়তি ভাড়া নেয়া হচ্ছে। এতে কর্মহীন ও আয় কমে যাওয়া মানুষের যাতায়াত দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে।

(ঢাকাটাইমস/১৪আগস্ট/ডিএম)