কোবরাকে হিরো বানিয়ে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে চাপা দিচ্ছেন না তো?

প্রকাশ | ১৪ আগস্ট ২০২০, ১৫:৫১

সাইদুর রহমান রিমন

দেশে দিন দিনই তথ্য প্রযুক্তির নানা অপব্যবহার চরম আকার ধারণ করেছে। এতদিন এই অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তোলা হতো। ইদানীং সংঘবদ্ধ চক্র তা ব্যবহার করছে বড় বড় ইস্যু চাপা দেয়ার কাজে। আবার কখনও তা সরকারবিরোধী মতামতকে রাষ্ট্রবিরোধী কাজেও ব্যবহার হতে দেখা যাচ্ছে। মূল ঘটনাকে চাপা দিয়ে ছোট্ট বানান ভুল নিয়ে ফেসবুকের পাতা গরম করার অপকর্ম করতেও দ্বিধা করেন না এই শিক্ষিত বেহায়ারা।

গত ২৯ জুন এমনই বেহায়াপনা দেখতে পেয়েছেন গোটা দেশবাসী। সেদিন ময়ূর-২ নামক একটি লঞ্চের ধাক্কায় মর্নিং বার্ড লঞ্চটি ডুবে ৪০ জনের মতো যাত্রীর করুণ মৃত্যু ঘটে। স্বজনহারা মানুষের আহাজারিতে নদীর তীরজুড়ে শোককাতর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। অনেক পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন তারা। কেউ কেউ শুধু লাশটি পাওয়ার আশা নিয়ে বুক চাপড়ানো আহাজারিতে আকাশ- বাতাস কাঁপিয়ে তোলেন।

ঠিক সেই মুহূর্তে শিক্ষিত একটি অসভ্য গোষ্ঠী মেতে উঠে ১৩ ঘন্টা পর পানির নিচ থেকে উদ্ধার হওয়া সুজন বেপারীকে নিয়ে। কিভাবে বাঁচলো, ঘটনা সঠিক কি বেঠিক, বিশ্ব বিজ্ঞানীরা পানির নিচে বেঁচে থাকা নিয়ে কী বলেছেন- সেসব নিয়ে গবেষণার যেন অন্ত নেই। তর্ক-বিতর্ক বাদানুবাদ গবেষণায় লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহত ৪০টি লাশ যেন গৌণ হয়ে গেল। সব কিছু ছাপিয়ে উঠে এলো একজন সুজন বেপারী। অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়ালো যে, সুজন বেপারীর বেঁচে ফেরাটাই কাল হলো। বেচারা এখনো রাস্তাঘাটে বের হলে তার পরিচিত জন, বন্ধু-বান্ধবরা গায়ে চিমটি কেটে দেখে সুজন বেপারী আসলেই মানব হয়েই ফিরেছে নাকি জিন-ভূত হয়ে ফিরেছে।

সাভারে রেশমার ঘটনাটিও রানা প্লাজায় চাপা পড়ে মারা যাওয়া ১১০০ লাশকে প্রায়ই ঢেকে দিচ্ছিল। আবার সেই চক্রের সচেতন ভাবের অপতৎপরতা খেয়াল করছি মেজর সিনহার নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে। সংঘবদ্ধ চক্রটি কোথাকার কোন্ কোবরা ছোবরাকে মূল ইস্যু বানিয়ে মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডকেই চাপা দেয়ার পাঁয়তারায় নেমেছে।

রিপোর্টটিতে ২৩টি পয়েন্ট উল্লেখ আছে-সবকটি পয়েন্টের চূড়ান্ত রেজাল্ট হিসেবে দাঁড়িয়েছে যে,

(১) সিনহা ও তার টিম পর্যটন বিষয়ক ডকুমেন্টারি তৈরির ফাঁকে ফাঁকে ইয়াবার নেপথ্য অনুসন্ধানেই ব্যস্ত ছিলেন।

(২) নিজেদের সব অপকর্ম ফাঁস হওয়ার ভয়ে ভীত ওসি প্রদীপ এবং এসপি মাসুদ মেজর সিনহাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

(৩) হত্যাকাণ্ডকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তারা পরিকল্পিত মিশন সাজান এবং সেই মোতাবেক ওসির নেতৃত্বে একটি টিম বড়ডিল নামক স্থানে অবস্থান নেন।
(৪) পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ওসি প্রদীপের নিজস্ব সোর্স ও এজেন্টদের মাধ্যমে নারিসবুনিয়া গ্রামে ডাকাত ডাকাত বলে মেজরের ওপর হামলার প্রথম ধাপ সূচনা করেন-সেখানে জনৈক ইলিয়াস কোবরাকেও ব্যবহার করা হয়।

(৫) সেখান থেকে কৌশলে মেজর সিনহা বেরিয়ে এসে হিমছড়ির দিকে রওনা দিলেও যাতে হত্যাকাণ্ড মিস না হয় তার জন্য শামলাপুর চেকপোস্টে এসআই লিয়াকত বাহিনীকে আগাম প্রস্তুত রাখা হয়।

(৬) চেকপোস্টে পৌঁছার পর পরই এসআই লিয়াকত পূর্ব নির্দেশনা মোতাবেক মেজর সিনহাকে গাড়ি থেকে নামতে বলেন এবং মেজর সিনহা গাড়ি থেকে নামতেই চারটি গুলি তার দেহে বিদ্ধ করেন।

(৭) ঘটনার ১৫-১৬ মিনিটের মধ্যেই ওসি ঘটনাস্থলে পৌঁছান- কারণ কাছাকাছি জায়গায় তিনি অপেক্ষমাণ ছিলেন বলেই এত শিগগির তিনি সেখানে পৌঁছাতে পেরেছিলেন।
(৮) ওসি সেখানে পৌঁছে মেজর সিনহার গুলিবিদ্ধ দেহকে পা দিয়ে চেপে ধরে আরো দুই রাউন্ড গুলি চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।

(৯) মেজর সিনহাকে হত্যা করার পর তার সঙ্গে মাদকের সম্পৃক্ততা যুক্ত করেন।

এখন নানা আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে সমালোচনাকারী বিজ্ঞজনরা দয়া করে বলুন- আমার এ পয়েন্টগুলোর কোনটি মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডকে ধামাচাপা দেয়ায় প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে? দয়া করে বলুন-আপনি কোন পয়েন্টের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছেন? রিপোর্টে বেরিয়ে এসেছে- ইয়াবা সংশ্লিষ্টতার কারণেই মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড ঘটেছে-আপনি এটা ভুয়া ভাবলে দয়া করে বলুন- কোন কারণে মেজর খুন হয়েছে বলে আপনি মনে করছেন?

আপনি খুনের মোটিভও বলতে পারবেন না, অথচ ভুয়া বলতেও এগিয়ে আসবেন-বিষয়টা ‘মানি না-মানবো না, বিন্তু কি মানি না তা জানি না' এমন হয়ে গেল তো।

মেজর সিনহার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের চেয়ে কোবরা আপনার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, সিনেমা নাটক বলে আখ্যা দিবেন- এসবের মূল লক্ষ্যটা কি? লঞ্চ দুর্ঘটনার মতো ৪০ লাশ চাপা দেয়ার স্টাইলে মেজর সিনহার হত্যাকাণ্ডকে চাপা দিতে চান?

রিপোর্টটিকে যারা নাটকীয় সিনেমা থ্রিল বলে আখ্যা দিচ্ছেন তারা টেকনাফে বিভিন্ন ক্রসফায়ারকে ঘিরে ওসি প্রদীপ-চক্রের নানা কাহিনি পাঠ করে দেখুন। সব থ্রিল নারকেল তেলের মতো জমে যাবে।

একটি চেলিভিশন চ্যানেল যেকোনো ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বাঁচাতে তার বক্তব্য ব্যাখ্যা দেয়ার বিস্তৃত সুযোগ দিয়ে থাকে। অভিযুক্ত ব্যক্তি বিজ্ঞাপনের মতো টাকা দিয়ে এটা করান আমি তা বলবো না- তবে কোবরার বক্তব্য প্রচারের মুহূর্তে আমার বক্তব্য নিতে ভয়টা কি ছিল?

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

ঢাকাটাইমস/১৪আগস্ট/এসকেএস