অস্তিত্বে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুই অস্তিত্ব

প্রকাশ | ১৪ আগস্ট ২০২০, ২০:০৬ | আপডেট: ১৪ আগস্ট ২০২০, ২০:১৬

ড. কাজী এরতেজা হাসান

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। জাতির জনক। স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি দেশ শাসনের সুযোগ পেয়েছিলেন। এই স্বল্প সময়ে বঙ্গবন্ধু ধ্বংসপ্রায় দেশটির পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে নানা কল্যাণমুখী পরিকল্পনা করেন। মাত্র ১০ মাসের মধ্যে তিনি একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান উপহার দেন, যার ভিত্তি ছিল জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল বিপথগামী সেনা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের এসব আদর্শের বিপরীতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একজন নেতা, যার সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসের সম্পর্ক গভীর। ঘাতকের বুলেট তাঁকে হত্যা করলেও সে সম্পর্ক মোটেই ছিন্ন করতে পারেনি। যত দিন যাচ্ছে, ততই ইতিহাসে তাঁর নাম সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা পরিবর্তনের যে কালো অধ্যায়ের সূচনা হয় তার ধারাবাহিকতায় বারবার বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ যে সাম্প্রদায়িকতার কবর দিয়েছিল, তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস চলে ১৫ আগস্টের পর থেকে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক নেতা, পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পুরোধা এবং বাংলাদেশের জাতির জনক। জনসাধারণের কাছে তিনি শেখ মুজিব নামে বেশি পরিচিত এবং তার উপাধি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম মহানায়ক। সেরা মুক্তি সংগ্রামী, সেরা রাষ্ট্রনায়ক। জননন্দিত নেতা হিসেবে তার তুলনা ছিলেন তিনি নিজেই। দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ও দায়বোধ তাকে মহীরূহে পরিণত করেছিল। ব্যক্তি শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং অস্তিত্বের শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই বিপন্ন করতে চেয়েছিল। তাই বলছি পিতৃ হত্যার অভিশাপ থেকে জাতি আজও মুক্ত নয়।

বাঙালি জাতির অস্তিত্বের উৎস হিসেবে শেখ হাসিনার মাঝে বঙ্গবন্ধুকে আমরা দ্বিতীয়বার পেয়েছি। শেখ হাসিনার মাঝে আমরা খুঁজে পাই বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি, খুঁজে পাই বাঙালি জাতির অস্তিত্বের উৎস। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও ত্যাগ না থাকলে বাংলাদেশ হতো না। জাতিকে পরিত্রাণ দেওয়ার জন্য, ৩০ লাখ শহিদের স্বপ্নকে সার্থক করার জন্য, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত বিপ্লব সুখী, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য ষড়যন্ত্র, আক্রমণ, আঘাত সবকিছু থেকে শেখ হাসিনা রক্ষা পেয়েছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব পাওয়া আমাদের জাতির জন্য গৌরবের।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে যারা মেনে নেয়নি, তারা স্বাধীন বাংলাদেশকে মেনে নেয়নি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্রষ্টাকেও মেনে নিতে পারেনি। তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে ধ্বংস করার জন্য চেষ্টা করেছে। এখনও সেই চেষ্টা চলছে। সেই চেষ্টা থেকে আত্মরক্ষার জন্য সকলের সোচ্চার হওয়া সময়ের দাবি। ১৯৭১ সালের খুনীরা ১৯৭৫ সালে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

স্বাধীনতার পরাজিত শত্রু ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সম্মিলন এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের সম্পৃক্ততায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, চীনসহ অনেকগুলো রাষ্ট্র আমাদের অভ্যুদয়কে মেনে নেয়নি। তারা পাকিস্তানকে সাপোর্ট দিতো। তারা বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। তারা বঙ্গবন্ধুর কুলাঙ্গার খুনীদের প্রতিষ্ঠিত করেছে, আশ্রয় দিয়েছে, প্রশ্রয় দিয়েছে।

বাংলাদেশকে যারা পাকিস্তান বানাতে চেয়েছিল, তারা এখনো সোচ্চার। খালেদা জিয়া রাজশাহীতে জনসভায় বক্তৃতায় বলেছিলেন, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এরা যুদ্ধাপরাধী নয়, এদের রাজনৈতিকভাবে বন্দী করা হয়েছে। অথচ ১৯৭১ সালে এদের ভূমিকা প্রকাশ্য দিবালোকের মতো সত্য। খালেদা জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতার মোহে অন্ধ ছিলেন, অপরদিকে শেখ হাসিনা ক্ষমতার ঝুঁকি নিয়ে, সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন। শেখ হাসিনা বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের মতো খুনীদের সাথে সমঝোতা করেননি।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নেপথ্যে ইন্দনদাতা ছিলেন জিয়াউর রহমান। যে ‍জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর বদান্যতায় বীর উত্তম উপাধি দেওয়া হয়েছিল, একের পর এক পদোন্নতি দিয়ে মেজর জেনারেল করা হয়েছিল। সেই জিয়াউর রহমান অমানবিক, অকল্পনীয় পশুপ্রবৃত্তির মানসিকতার কারণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য সৈনিকদের অনুমতি দিয়েছেন।

জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে স্যালুট করতে সামনে যেতে পারতেন না, তিনি ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যে চাবিকাঠি নেড়েছেন। এজন্য তাকে বলা হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার মাস্টারমাইন্ড। তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুনর্বাসন করেছেন, খুনীদের বিচার করার পরিবর্তে হাইকমিশনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ৩১শে ডিসেম্বর জেলখানার গেট খুলে দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী সাজাপ্রাপ্ত, বিচারাধীন ও তদান্তাধীন সবাইকে ছেড়ে দিয়েছেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স পার্লামেন্টে পাশ করেছেন।

সমকালীন বিশ্বে সবচেয়ে বিপ্লবী নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি জাদুকর হিসেবে সারা দুনিয়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলের হিমালয়ের মতো উদার, বঙ্গোপসাগরের মতো গভীরতার মানুষ। বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল মনের মহানুভব মানুষকে পাকিস্তানিরা ফাঁসি দিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি, ফাঁসির রজ্জুকে স্বাগত জানিয়েছিলেন, বাংলার মানুষের ভালোবাসার সাথে বেঈমানি করেননি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন পাকিস্তানিরা আমাকে খুন করেনি। বাঙালিরা আমাকে মারবে না। সেই মানুষকেও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। এটাই বাস্তবতা।

বঙ্গবন্ধু হত্যার কারণে জাতি কতটা পিছিয়েছে তা আমরা আজ উপলব্ধি করতে পারছি। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আজ বাংলাদেশ থাকতো সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার চেয়ে উন্নত। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যেতো। বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হলে একটা জাতীয় ধারণা থাকতে হবে। তার আগেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,  বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব,  শেখ কামাল,  শেখ জামাল, শেখ রাসেলসহ সকল শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। পাশাপাশি একটি কথাও বলতে চাই, এখনো পাকিস্তানের প্রেতাত্মা,     আইয়ুব খান,  মোনায়েম খান এবং খন্দকার মোশতাকের দোসররা এদেশে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে থেকে যারা পরোক্ষভাবে মদদ দিয়েছে তাদেরও বিচার করতে হবে। এক্ষেত্রে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা জরুরি।  এছাড়া যারা সরাসরি হত্যাকান্ডে জড়িত ছিল তাদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চারজন আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং তাদের ফাঁসিতে ঝুলানো হলেই দেশ কলংকমুক্ত হবে। এমনকি আওয়ামী লীগের ভেতরেও অনেক মোশতাকের আদর্শিক বংশধরর রয়েছে।  তাদের খুঁজে বের করতে হবে।  

আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখি নাই, কিন্তু আমরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ কিভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তা দেখছি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করি বলেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তরুণ প্রজন্মের সামনের সারির যোদ্ধা হিসেবে  কাজ করে যাচ্ছি।  বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস বইয়ে বঙ্গবন্ধুকে অবমাননার দায়ে আমিই বাদী হয়ে মহামান্য হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলাম।  আমরা মনে করি, তরুণ প্রজন্মের মানুষ হিসাবে অবশ্যই শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে সকল ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো, ইনশাল্লাহ। 

আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে শিক্ষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, সর্বোপরি সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ৭ মার্চ ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে তিনি বজ্রকণ্ঠে যে ভাষণ দেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তা হয়ে আছে এক চির অম্লান মাইলফলক। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অমল ধবল স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। তিনি এবং কেবল তিনিই তাঁর বলিষ্ঠ সুযোগ্য সুদৃঢ় অনমনীয় অকুতোভয়, সর্বোপরি দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে পৌঁছে দিয়েছেন স্বাধীনতার সুবর্ণ তোরণে। এর পরের ইতিহাস সবার জানা এবং তা বিশ্ববাসীরও অজানা নয়। ভাষণটি ইতোমধ্যে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণের স্বীকৃতি পেয়েছে। কেবল একটি ভাষণ ‘ওয়ার্ল্ডস ডুকমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির গৌরব বহির্বিশ্বে বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু অমর। তার মৃত্যু নেই। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের মানচিত্র থাকবে যতদিন ততদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থাকবেন পৃথিবীর বুকে স্মরণীয় হয়ে। তাইতো কবি বলেছেন, যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক ভোরের পাতা ও দ্যা পিপলস টাইমস , পরিচালক, এফবিসিসিআই