১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির অজানা আত্মত্যাগের ইতিহাস

মোহাম্মদ সাব্বির রহমান
 | প্রকাশিত : ১৪ আগস্ট ২০২০, ২০:২৮

জাতীয় শোক দিবসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যসহ সব শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। বাংলাদেশ পুলিশ রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য ও অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনসহ এদেশে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে পুলিশ প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে ও আসছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম বুলেট ছোড়া থেকে শুরু করে অদ্যাবধি দেশের ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ পুলিশ সবসময় সাধারণ ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালের পুলিশের আত্মত্যাগের ইতিহাস সবারই অজানা নয়। সেই কালরাতে থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে অসীম সাহসিকতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ট্যাংক কামানের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বীর পুলিশ সদস্যরা। ওই রাতে সম্মুখযুদ্ধে ঢাকা রাজারবাগে আট শতাধিক পুলিশ সদস্য শহীদ হয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত রাজারবাগে পুলিশের অবিশ্বাস্য প্রতিরোধের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বুঝতে পারে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে পুলিশকে নিরস্ত্র করতে হবে। তাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আক্রোশে বড় টার্গেট ছিল বাঙালি পুলিশ। তাইতো মার্চের শেষ সপ্তাহ এবং এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে মধ্যেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বহু পুলিশ সদস্যদের হত্যা করে থানা দখল করে নিয়েছিল। পরিস্থিতি বুঝেই বাঙালি পুলিশ সদস্যরা প্রায় সব থানার অস্ত্রাগারের অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেন এবং নিজেরাও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। প্রত্যেক জেলায় একই ঘটনা ঘটেছিল।

পুলিশের কনস্টেবল থেকে ডিআইজি পদমর্যাদার অনেক অফিসার মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদান অবিস্মরণীয়। দুর্ভাগ্য মুক্তিযুদ্ধের পর পুলিশের সেই অবদান কেউ স্বীকৃতি দেয়নি। অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত হলেও সত্য যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দেখা গেল পুলিশের কেউই বীরশ্রেষ্ঠ কিংবা বীরউত্তম খেতাব পাননি বা দেয়া হয়নি। চার দশক পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদান ছিল উপেক্ষিত। বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ২০১১ সালে পুলিশকে দেয়া হয় স্বাধীনতা পদক।

প্রথম পুলিশ সপ্তাহে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুলিশ বাহিনীর উদ্দেশে দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণের কথা মনে রেখেছিল পুলিশ। ১৯৭৫ সালে পিজিআর গঠনের আগ পর্যন্ত ঢাকা জেলা পুলিশ বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করত। বঙ্গবন্ধুকে জনগণের কাছে নিতে পুলিশ সবসময় সজাগ ছিল। প্রতিটি সরকারি সফরে পুলিশ সদস্যরাই বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার এবং প্রটোকলের দায়িত্ব পালন করতেন।

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ ভোররাতে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে ঘাতকরা আক্রমণ করলে পিজিআর সদস্যরা অস্ত্র হাতে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। কারণ তাদের বন্দুকে গুলি ছিল না। ১৪ আগস্ট রাতে পিজিআরের সুবেদার মেজর ওয়াহাব জোয়ার্দার ঘাতকদের সাথে ষড়যন্ত্র করে পিজিআরের সব গুলি নিজের জিম্মায় নিয়ে নেয়। কিন্তু পুলিশের গুলি নেয়ার সুযোগ ঘাতকেরা পায়নি। জাতির সাথে কিংবা রাষ্ট্রের সাথে বেইমানি করার কোনো ইতিহাস বাংলাদেশ পুলিশের নেই। তাই ভোরে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর আক্রান্ত হলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বাঁচাতে সর্বপ্রথম পুলিশ গুলি ছুড়ে প্রতিরোধ গড়ে। তার খেসারত হিসেবে ঘাতক সেনাদের গুলিতে ৩২ নম্বরের মেইন গেইটে শহীদ হন পুলিশের বীর সন্তান এএসআই ছিদ্দিকুর রহমান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা পুলিশের ডিএসপি অফিসার নুরুল ইসলাম খান।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বপ্রথম পুলিশ বুকের তাজা রক্তে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রঞ্জিত হলেও ৭৫-এর ইতিহাসে পুলিশ আজও উপেক্ষিত। বাংলাদেশের পুলিশ বরাবরই হতভাগা একটি বাহিনী। ১৫ আগস্ট শহীদদের তালিকার মধ্যে কর্নেল জামিলের ছবি দেয়া হয়। তাই সবাই শহীদ কর্নেল জামিলের আত্মত্যাগের ইতিহাস জানার সুযোগ পান। কিন্তু বীর শহীদ এএসআই ছিদ্দিকুরের কিংবা গুলিবিদ্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম খানের নাম কজন জানে? অধিকাংশ মানুষ জানে না। কারণ জাতীয়ভাবে ১৫ আগস্টের পুলিশের আত্মত্যাগের ইতিহাস কেউ জনগণের সামনে আনেনি। এদের অবদান কখনো স্মরণও করা হয়নি। এই বীর পুলিশ সদস্য বা তাদের পরিবারকে কখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করা হয়নি।

পুলিশ কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম খান, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিল। আওয়ামীমনা এই পরিবারকেও ৭৫ পরবর্তী বিভিন্ন সময় অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে।

শহীদ এএসআই ছিদ্দিকুরের মৃত্যুর পর তৎকালীন সরকার কোনো পেনশন দেয়নি ছিদ্দিকুরের পরিবারকে। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে অর্থাভাবে দিন কেটেছে ছিদ্দিকুরের স্ত্রী-সন্তানদের। পুলিশ কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম খান তার সন্তানদের মানুষ করতে পারলেও আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে শহীদ এএসআই ছিদ্দিকুরের স্ত্রী ও তার দুই সন্তানরা কঠিন জীবনযুদ্ধে কাছে বারবার পরাজিত হয়েছেন। ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির পুলিশের আত্মত্যাগের ইতিহাস অজানা ট্রাডেজি হয়ে থাকলেও ইতিহাস বলে, পুলিশ কখনই দেশ মাতৃকা এবং বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসের সাথে বেইমানি করেনি। একদিন ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ পুলিশের আত্মত্যাগের ইতিহাস নিশ্চয় স্বর্ণাক্ষরে লেখা হবে।

লেখক: অফিসার ইনচার্জ, নানিয়াচর থানা, রাঙামাটি

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :