জাতীয় শোক দিবস এবং কিছু কথা

প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০২০, ১০:৩৪ | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২০, ১২:৪৮

সুব্রত বিশ্বাস শুভ্র

‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত,

বঙ্গবন্ধু মরে নাই।

যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো,

বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই।

তবে বিশ্ব পেতো এক মহান নেতা,

আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।’

হাসান মতিউর রহমানের লেখা, মলয় কুমার গাঙ্গুলীর সুর করা এবং সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গাওয়া এই গানটি যেন শুধু একটি গান নয়, কোটি কোটি বাঙালি এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর মনের কথা। আজ থেকে ৪৫ বছর আগের এই দিনে শেষ রাতের দিকে মানুষ নামের কীট, ক্ষমতালোভী, চক্রান্তকারী কিছু বিপথগামী সেনাসদস্য বাঙালি জাতিকে মুক্তির আলো দেখানো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। ঘাতকরা ওই দিন নারী ও শিশুদেরও রেহাই দেয়নি, যা ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায়। সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করার পর বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া। শোকে মহ্যমান হয়ে পড়ে পুরো বাঙালি জাতি।

১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭০ সালসহ বিভিন্ন সময়ে মৃত্যুর খুব কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু বারবার ফিরে এসেছিলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হায়েনারা যা করতে পারেনি, সেই কাজটিই অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ও পূর্বপরিকল্পিতভাবে সম্পাদন করে পাপিষ্ঠ বাঙালি ঘাতকরা। ওরা মানুষ নামের হায়েনার দল, ওরা শয়তানের প্রেতাত্মা, ওরা জঘন্য, ওরা হিংস্র জানোয়ারের দল।

একদিন যে অঙ্গুলি উঁচিয়ে বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলে তিনি বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স¦াধীনতার সংগ্রাম।’ ভাবতে অবাক লাগে সেই স্বাধীন দেশের মানুষই তাঁর অঙ্গুলি চিরদিনের জন্য নিস্তেজ করে দেয়। আর কোনোদিন ওই অঙ্গুলি আমাদের প্রেরণা দিতে আসবে না, দেবে না মুক্তির বারতা। মানুষ মরণশীল বলেই সবার মৃত্যু হয়। তবে কোনো কোনো মানুষের শুধু দেহাবসানই ঘটে, মৃত্যু হয় না। তারা থাকে মৃত্যুহীন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তেমনি একজন মানুষ। তিনি মৃত্যুহীন, তিনি অমর।

১৯৭৫ সালের এই দিনে ঘাতকরা জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসায় নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাকে সপরিবারে নিঃশেষ করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, জ্যেষ্ঠ পুত্র মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, দ্বিতীয় পুত্র মুক্তিযোদ্ধা লেফটেল্যান্ট শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শিশু শেখ রাসেল, সদ্য বিবাহিত পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসেরকে হত্যা করা হয়।

মিন্টো রোডে সরকারি বাসভবনে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি এবং তৎকালীন মন্ত্রী অবিসংবাদিত কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার একমাত্র মেয়ে বেবি সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত এবং আত্মীয় আবদুল নঈম খান রিন্টুকে।

আরেক বাসায় হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মনিকে। তারা বর্তমান যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপসের বাবা-মা।

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণ হয়েছে শুনে সেখানে যাওয়ার জন্য রওনা দেন বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ। তাকে ৩২ নম্বরের সামনে হত্যা করা হয়। এছাড়া ওই দিন ৩২ নম্বরের বাড়িতে কর্তব্যরত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও হত্যা করা হয় সেদিন।

সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর বড় সন্তান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তারা শেখ হাসিনার স্বামী প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী প্রয়াত ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে থাকায় বেঁচে যান।

সেই নারকীয় হামলার পর দেখা গেছে, ভবনটির প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে রক্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলো ঝাঁজরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছে চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ। তাঁর তলপেটে ও বুকে ছিল বুলেটে ঝাঁজরা। পাশেই পড়ে ছিল তার ভাঙা চশমা ও অতি প্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল, মূল বেডরুমের সামনে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, নিচতলার সিঁড়িসংলগ্ন বাথরুমের পাশে শেখ নাসের এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবির ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল ছোট শিশু শেখ রাসেলের লাশ। রক্তভেজা লাশ দেখে খুনিদের প্রতি চরম ঘৃণা-ধিক্কার জানানোর ভাষা খুঁেজ পান না মানবতাবাদী বিশ্বের কোনো মানুষ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পরই খন্দকার মোশতাক আহমেদ যে কি না বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন, তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেন এবং খুনিদের বাঁচানোর জন্য ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। ‘দি বাংলাদেশ গেজেট পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাক আহমেদের স্বাক্ষর আছে।

অধ্যাদেশটিতে দুটি ভাগ আছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইন প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো, অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

এরপর ক্ষমতায় আসে আর এক সামরিক শাসক মেজর জিয়া। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনে বৈধতা দেন।

এরপর দীর্ঘ ২১ বছর সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার আইনি বাধা অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (রহিতকরণ) বিল, ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদে উত্থাপন করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর আইনটি সংসদে পাস হয়। ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর এটি পরিপূর্ণভাবে আইনে পরিণত হয়। ফলে মোশতাকের জারি করা এবং জিয়াউর রহমানের সময় বৈধতা পাওয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বিলুপ্তি বলে গণ্য হয়। এরপর শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কাজ।

বিচারে নিম্ন আদালত ঘাতকদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। পরবর্তীতে নিম্ন আদালতের এ রায় হাইকোর্টেও বহাল রাখে। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ না দেওয়াসহ নানা কারণে বিচারের পথে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। ফলে রায় কার্যকরে বিলম্ব হতে থাকে। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পর উচ্চ আদালত পর্যায়ের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়। সুপ্রিম কোর্টেও আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি পাঁচ খুনিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রায় কার্যকর করা হয়। পাঁচজন হলেন- লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) এবং লে. কর্নেল একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার)। ২০০১ সালের ২ জুন লে. কর্নেল আবদুল আজিজ জিম্বাবুয়েতে মারা যান বলে কথিত আছে।

২০২০ সালের ৭ এপ্রিল ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১২ এপ্রিল তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আরেক খুনি রিসালদার মোসলেম উদ্দিন গত ১৯ এপ্রিল ভারতে গ্রেপ্তার হন। তবে তার গ্রেপ্তার নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা আছে। এছাড়া এখনো চারজন বিদেশে পালিয়ে রয়েছেন। পলাতকরা হলেন- কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ, লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী এবং লে. কর্নেল এস এইচ নূর চৌধুরী।

১৫ আগস্টের হৃদয় বিদারক ঘটনা যদি না ঘটত তা হলে বিশ্ব দরবারে বহু আগেই আমরা একটি মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে পরিগণিত হতে পারতাম। তবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল তার পরিপূর্ণ সফলতা অর্জন করতে পারেনি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যাওয়ায়। তাই হয়তো ২০০৪ সালের ২১ আগস্টসহ এ পর্যন্ত প্রায় ২১ বার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মেরে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিল ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকরা। কোটি কোটি দেশবাসীর দোয়া এবং আশীর্বাদের জন্যই হয়তো বারবার ভেস্তে গেছে শেখ হাসিনাকে মেরে ফেলার উদ্যোগ।

বঙ্গবন্ধু হত্যার সকল দুরভিসন্ধির সাথে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী ও পাকিস্তানি চক্র এবং তাদের এ দেশীয় দালালদের গোপন আঁতাতের কথা আজ দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আজ মানুষ বুঝতে পেরেছে বঙ্গবন্ধু হত্যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে বাংলাদেশের নাম চিরতরে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে। কিন্তু তাদের সেই ধ্যান-ধারণা বাস্তবে রূপলাভ করতে পারেনি।

জাতীয় শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে এবং কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিতে পারলেই জাতির জনকের বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে। আর এ লক্ষ্যেই দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন মানবতার জননী বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা।

লেখক: কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

ঢাকাটাইমস/১৫আগস্ট/মোআ