বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানো কতদূর?

প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০২০, ১০:৫৪ | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২০, ১১:৩০

নজরুল ইসলাম, ঢাকাটাইমস
বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনি রাশেদ চৌধুরী

১৯৭৫ সালে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ৪৫ বছর অতিবাহিত হতে চলল। কিন্তু দীর্ঘ এই সময়ের মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার শেষ করা সম্ভব হয়নি। খুনিদের মধ্যে পলাতক পাঁচজনকে ফিরিয়ে এনে কবে নাগাদ মৃত্যুদ- কার্যকর করা যাবে সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফাঁসির দন্ড পাওয়া এই পাঁচজনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম আত্মস্বীকৃত খুনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আশার আলো দেখা দিয়েছে। কারণ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা রাশেদ চৌধুরীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার উদ্যোগ নিয়েছে দেশটির বিচার বিভাগ।

অথচ ফাঁসির আসামি বলে তাকে ফেরত দিতে বহু বছর অনীহা দেখিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার বিষয়টিকে নতুন ডাইমেনশন বা ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা এখনই বলা যাবে যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরিকে ফেরত পাঠাবে। তবে দেশটির আন্তরিকতা আর ঢাকার কূটনৈতিক প্রচেষ্ঠায় তাকে ফেরত আনা সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফেরত আনার সঙ্গে জড়িত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় বাতিল করার জন্য আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে এবং এটি ভালোভাবে শেষ হওয়ার পরে ফেরত আনার প্রক্রিয়াটি সামনে আসবে।

ফাঁসির আসামি বলে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দিতে অনীহা দেখিয়ে আসা দেশটির সরকার ১৫ বছর পর  সিদ্ধান্তের পুর্নবিবেচনা করায় তাকে ফেরত পেতে আশাবাদী প্রত্যাবাসন কর্মকর্তারা।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর বাকি খুনিদের ফেরানো নিয়ে সরকারের আন্তরিকতার অভাব নিয়ে প্রশ্ন নেই। তার প্রমাণ হিসেবে বলা যায়,  বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরি বিষয়ে এর আগে খুব একটা গুরত্ব না দিলেও নড়েচড়ে বসেছে দেশটির সরকার। তবে এখনই বলা যাচ্ছে না ফেরত পাঠাবে। অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটা যে নাড়াছাড়া হয়েছে সেটা খুবই পজিটিভ। শেষ পর্যন্ত কি হয় সেটার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।’

এদিকে গত শুক্রবার গোপালঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দ্রুত দেশে ফেরত এনে রায় কার্যকর করতে সরকার সচেষ্ট। তিনি আশা প্রকাশ করেন,  বাকি খুনিদের মধ্য থেকে মুজিববর্ষে কমপক্ষে একজন খুনিকে দেশে ফেরত এনে বিচারের রায় কার্যকর করা হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গত এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান। সেই চিঠির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে পাঠানো ফিরতি চিঠিতে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি পুনরায় উল্লেখ করেন।

পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার গত ১৭ জুন দেশটির ইমিগ্রেশন আপিল বোর্ডের কাছে রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় মামলার নথি পর্যালোচনার জন্য তলব করেছেন বলে গত ২৪ জুলাই মার্কিন সাময়িকী পলিটিকো এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে।

পলিটিকো লিখেছে, বারের এই পদক্ষেপের চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে তার রাজনৈতিক আশ্রয় হারাতে পারেন এবং তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোও হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পেতে বাংলাদেশ বেশ কয়েক বছর ধরে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। রাশেদকে ফেরাতে এ নিয়ে দুইবার ট্রাম্প প্রশাসনকে চিঠি পাঠিয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সঙ্গে একাধিক বৈঠকে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর দাবি তুলেছেন। গত বছর মে মাসে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি অ্যালিস ওয়েলসের সঙ্গে এক বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে রাশেদ চৌধুরীর বিচারের নথিপত্র চেয়েছে ওয়াশিংটন। পরে চলতি বছর এপ্রিলেও ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলারের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের। এ ছাড়া দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনায় প্রায় নিয়মিত ইস্যু রাশেদ চৌধুরী।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যা করে খুনিরা। সে সময় দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মধ্যমে এই হত্যাকা-ের বিচারের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর এতে করে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা ছাড়া পেয়ে যায়।

২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ খোলে। তখন বিচার শুরু হলেও বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিচারের গতি শ্লথ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার পর মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে দ-িত পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয় সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার), এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিনের (আর্টিলারি)।

সর্বশেষ বাকি পলাতক ছয় খুনির মধ্যে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। জানা যায়, খুনি আব্দুল মাজেদ গ্রেপ্তার হওয়ার আগে প্রায় ২৩ থেকে ২৪ বছর ভারতের কলকাতায় লুকিয়ে ছিলেন।

এছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনি বিদেশে পালিয়ে আছেন। তারা হলেন খন্দকার আবদুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী ও এ এম রাশেদ চৌধুরী। এর মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে ও নূর চৌধুরী কানাডায় আছেন। বাকি তিনজন কোথায় আছেন, সে সম্পর্কে সরকারের কাছে নিশ্চিত তথ্য নেই। পলাতক ছয়জনের বিষয়ে ইন্টারপোল থেকে রেড নোটিশ জারি করা আছে। ২০০৯ সালে এই নোটিশ জারির পর প্রতি পাঁচ বছর পরপর নবায়ন করা হচ্ছে।

ঢাকাটাইমস/১৫আগস্ট/এনআই