বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন আবদুল হামিদ

প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০২০, ১২:৩৭ | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২০, ১২:৫৩

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

বাঙালি জাতির শোকের দিন ১৫ আগস্ট। প্রতিবছর দিবসটিতে ১৯৭৫ সালের বীভিষিকাময় সেই রাতের আগে-পরের অনেক ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের ঘনিষ্ঠজনরা। এদেরই একজন বর্তমান রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ।

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) এক স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে আবদুল হামিদ তুলে ধরেছেন ১৫ আগস্টের আগে তখনকার ডিজিএফআইয়ের লোকদের গতিবিধি নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করার কথা। কিভাবে এমপি হোস্টেল থেকে বের হয়ে যাওয়া, নিজ এলাকা কিশোরগঞ্জে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করার বিষয়টি।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে তখনকার সামরিক কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের পক্ষ থেকে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে কারাগারে থাকার কথাও তুলে ধরেছেন সজ্জন রাষ্ট্রপতি হিসেবে পরিচিত আবদুল হামিদ। কবে প্রথম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে তাও বলেছেন তিনি।

আবদুল হামিদ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৮ আসন থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ, ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ, ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ, ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ এবং সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

ছাত্র জীবন থেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আবদুল হামিদ ১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিজের প্রথম দেখা হওয়ার কথা বিভিন্ন সময় তুলে ধরেছেন।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষবার একান্তে কথা বলার স্মৃতি তুলে ধরে আবদুল হামিদ বলেন, ‘৭৪-৭৫ সালে এমপি হোস্টেলে থেকে প্রায়ই ক্যান্টনমেন্টে যেতাম মামা শ্বশুর ড. মাহবুবুর রহমানের বাসায়। সেখান থেকে ডিজিএফআই অফিস খুব কাছাকাছি। শ্যালক মাসুমকে সঙ্গে নিয়ে ওদের অনেকেরই হাবভাব, চালচলন পর্যবেক্ষণ করতাম। ভালো লাগত না। বারবারই মনে হত খারাপ কিছু ঘটবে। কিন্তু ওরা যে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মেরে ফেলবে, এটা কল্পনাই করতে পারিনি। তারপরও সিদ্ধান্ত নিলাম ডিজিএফআই অফিসের লোকজনের কথাবার্তা ও রহস্যজনক আচরণের বিষয়গুলো বঙ্গবন্ধুকে জানাব।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, ‘যতদূর মনে পড়ে, পঁচাত্তরের ১১ আগস্ট বিকালে গণভবনে গিয়েছি। তৎকালীন মন্ত্রী কোরবান আলী তখন সেখানে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে বললাম, আমার কিছু একান্ত কথা আছে। তিনি আমাকে ইশারায় বসতে বলে অন্যান্য কাজ সারতে থাকলেন। সন্ধ্যার পর আমাকে নিয়ে বের হলেন। গণভবনের বাগানে হাঁটতে হাঁটতে আমার কাছে জানতে চাইলেন, কী বলতে চাস? আমি ডিজিএফআই অফিসের বিষয়গুলো জানিয়ে বললাম, ওদের হাবভাব ও চলাফেরা আমার ভালো ঠেকছে না। বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, একটু ঝামেলা ছিল, সব ঠিক হয়ে গেছে, চিন্তা করিস না। ফিরে এলাম আশ্বস্ত হয়ে। এটাই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা, শেষ কথা। এখন বুঝতে পারি, কোনো কিছুই ঠিক ছিল না তখন। আমাদের অগোচরেই জনকের রক্তে কালো হাত রঞ্জিত করতে প্রস্তুত হচ্ছিল ঘাতকরা।’

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের রাতের ঘটনা তুলে ধরে আবদুল হামিদ বলেন, ‘১৪ আগস্ট রাতে নানা জায়গায় আড্ডা দিয়ে এমপি হোস্টেলে ফিরি। ৩টা-৪টার দিকে ঘুমাতে যাওয়ার আগেও একাধিক আওয়াজ শুনেছি। ভেবেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনন্দ-উল্লাস হচ্ছে, পটকা ফুটছে। সকাল ৭টার দিকে পাশের রুমের খন্দকার নুরুল ইসলাম (রাজবাড়ীর এমপি) এসে দরজা ধাক্কানো শুরু করলেন। রাতে দেরিতে ঘুমিয়েছি তাই বেশ বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই তার মুখে শুনলাম, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে’। তিনি দৌড়ে রেডিও নিয়ে এলেন। সেখানে বারবার বাজছে, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি...।’

পরের ঘটনা তুলে ধরে বর্তমান রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘এরপরের কথাগুলো আমি আর শুনতে পারি না। আমার কান বন্ধ হয়ে আসে। মাথা ঘুরতে থাকে। আমার নেতাকে, আমার বঙ্গবন্ধুকে, বাঙালির জাতির জনককে ওরা মেরে ফেলেছে, এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। আমরা চেয়ে দেখি এমপি হোস্টেলের বাইরেও ট্যাঙ্ক ঘুরছে। অনেক এমপি এবং নেতাকে ফোন করি, অনেককেই পাই না। এমপি হোস্টেলে হামলা হতে পারে এই আশঙ্কার মধ্যেই বের হই। স্যান্ডেল পায়ে হেঁটে হেঁটে ফার্মগেটে যাই। তারপর সেখান থেকে মহাখালীতে এক আত্মীয়ের বাসায়। কিশোরগঞ্জে গিয়েছি আরও পরে।’

পরের বছর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের পক্ষ থেকে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পাওয়ার পর তা ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়েও কথা বলেন তিনি।

আবদুল হামিদ বলেন, ‘১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জে আয়োজিত আলোচনা সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করি। বক্তব্যে বলি, হিটলার-মুসোলিনি থেকে শুরু করে কোনো স্বৈরাচারই টেকেনি, এ দেশেও টিকবে না। এই অপরাধেই বোধ হয় কিছুদিন পর গ্রেপ্তার হই। জেলখানার ভেতরেই জিয়াউর রহমান কর্নেল মাহফুজুর রহমানের মাধ্যমে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পাঠান। বলা হয়েছিল, প্রস্তাবটি না মানলে ২৫ বছর জেলে থাকতে হবে।’

বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ এসেছে মনে করে আবদুল হামিদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করতে পারিনি বলে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিই। জীবনভর বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসেবে তার আদর্শ আঁকড়ে ধরেই থাকতে চেয়েছি। এর ফলেই হয়ত অধিষ্ঠিত হতে পেরেছি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির আসনেও। আমার জীবনে আর কোনো চাওয়া-পাওয়া বাকি নেই।’

জাতির জনকের স্বপ্ন পূরণে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমি শুধু চাই, এ দেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চিরঞ্জীব থাক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবদান অপরিসীম। গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি এই জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। এজন্য তাকে বহুবার কারাবরণসহ অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এ দেশের জনগণকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে এই মহান নেতা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এজন্য পুনরায় তাকে কারাবরণ করতে হয়, যেতে হয় ফাঁসির মঞ্চে। তবুও তিনি শত্রুর সঙ্গে আপস করেননি। দেশ ও জনগণের স্বার্থকে সারা জীবন সমুন্নত রেখেছেন। দুঃখী মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। তাই ঘাতক চক্র জাতির জনককে হত্যা করলেও তার আদর্শ ও নীতিকে ধ্বংস করতে পারেনি। তিনি ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্ন দেখেছিলেন।

রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব হবে দেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করে জাতির জনকের সেই স্বপ্ন পূরণ করা। তাহলেই তার আত্মা শান্তি পাবে এবং আমরা এই মহান নেতার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারব।’

১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করেছেন। দেশের মানুষকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবেসে গেছেন। তিনি কখনো ভাবতেও পারেননি যে কোনো বাঙালি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে বা তাকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি সব সময়ই সুযোগ খুঁজতে থাকে। এ সময় ছোটখাট কিছু ঘটনা ঘটলেও বঙ্গবন্ধু কখনোই সেসব আমলে নিতেন না।’

আবদুল হামিদ বলেন, ‘নতুন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে কোনো দেশের জন্যই সম্পদ। তাই তাদেরকে সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নিজের দেশ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানাতে হবে। বাংলাদেশকে জানতে হলে বঙ্গবন্ধুকে জানতে হবে। আর বঙ্গবন্ধুকে জানতে হলে আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখন আর শুধু একটি নাম নয়। বঙ্গবন্ধু একটি প্রতিষ্ঠান, একটি কালজয়ী ইতিহাস ও একটি সত্ত্বা। বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু রেখে গেছেন তার রাজনৈতিক দর্শন, নীতি ও আদর্শ যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সকলকে আলোর পথ দেখাবে, উন্নতি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যেতে সাহস যোগাবে।’

রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়ন ও অগ্রগিতর ‘রোল মডেল’। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ আজ বাণিজ্য-বিনিয়োগসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ সকল খাতেই এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে দেশ তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে স্বাধীনতা দিয়েছেন আর তারই কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ- বঙ্গবন্ধুর ৪৫তম শাহাদাত বার্ষিকীতে এটাই সকলের প্রত্যাশা।’

করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কথা তুলে আবদুল হামিদ বলেন, ‘কোভিড-১৯ এর ছোবলে গোটা বিশ্ব বর্তমানে বিপর্যস্ত। এ অবস্থার উত্তরণে সবচেয়ে বেশি দরকার পারস্পরিক সহযোগিতা এবং জীবনযাপনের সকল স্তরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরাও যদি কোভিড-১৯ মোকাবেলায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে উদ্যোগী হই তাহলে নিশ্চয়ই এ দুর্যোগ থেকে দেশ মুক্ত হবে ইনশাল্লাহ্। কেটে যাবে অমানিশার অন্ধকার, আলোকিত হয়ে উঠবে সবার জীবন।’

(ঢাকাটাইমস/১৫আগস্ট/বিইউ/এমআর)