বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে বিদেশি যোগসূত্র

মর্তুজা হাসান সৈকত
 | প্রকাশিত : ১৫ আগস্ট ২০২০, ১৩:০০

বেঁচে থাকলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স হতো এখন ১০০ বছর। আজ থেকে ৪৫ বছর আগে ১৫ আগস্ট শুক্রবার ভোরে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতিকে পরিবারের সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করে। একাত্তরে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, পঁচাত্তরে মূলত তারাই ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। চলতি বছরে উদযাপিত হচ্ছে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত এই নেতার জন্মশতবার্ষিকী। করোনা মহামারিকালে সীমিত আকারে চলমান এই উদযাপনের মধ্যেই এল শোকের মাস আগস্ট। তাছাড়া এই মাসেই নারকীয় হামলা হয়েছে তারই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। বাঙালি জাতির ইতিহাসের অধ্যায়ে আগস্ট তাই শোকের চাদরে ঢাকা।

নারকীয় ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড নিয়ে ভাবতে গেলে সবচেয়ে বিস্ময়কর লাগে, একটি মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক এবং একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার প্রধানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করেই ক্ষান্ত হলো না ষড়যন্ত্রকারীরা, এর পরে হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ রাখার জন্য প্রথমে ইমডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি হলো। দীর্ঘ ২১ বছর শেষে আমেরিকা ও পাকিস্তানের কবজা থেকে মুক্ত হয়ে যখন বিচার শুরু হলো তখন সেটাও বন্ধ রাখার জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা চলল। এমনকি আরো পরে এসে বিচারকরাও আপিল শুনানিতে বিব্রত বোধ করলেন! কেবল এই ঘটনাপ্রবাহগুলো নিয়ে ভাবলেই পরিষ্কার হয়ে যায়, কতটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফসল ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড।

হত্যাকাণ্ডের মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার ওয়াশিংটনকে জানান, 'বেলা ১১টা পর্যন্ত অভ্যুত্থানের ঘটনাপ্রবাহ সাফল্যের সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে, ঢাকা বা বাইরে কোথাও কোন গোলযোগ হয়নি। তবুও আমরা কিছু প্রতিরোধের আশঙ্কা এখনই নাকচ করে দিচ্ছি না। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, অভ্যুত্থান সফল হয়েছে। বেতার মাধ্যমে সেনা, নৌ, বিমান, বিডিআর ও পুলিশ প্রধানরা সরকারের প্রতি অনুগত থাকতে বিবৃতি প্রচার করেছেন।'

বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরটিও ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ভয়েস অব আমেরিকা থেকে প্রথম প্রচার করা হয়। অথচ তখনও বঙ্গবন্ধু জীবিত। এর কিছুক্ষণ পর ৬টার কিছু আগে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার প্রায় ত্রিশ মিনিট আগেই মৃত্যুর খবর প্রচার করা হয়। মৃত্যুর আগেই সংবাদমাধ্যমে কীভাবে মৃত্যুর খবর প্রচারিত হলো? তাহলে কি ভয়েস অব আমেরিকা আগে থেকেই জানত ভোর সাড়ে ৫টায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হবে? কে জানিয়েছিল তাদের? ঠান্ডা মাথায় ভাবলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যায়।

তথাকথিত কোনো সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে জাতির জনককে মৃত্যুবরণ করতে হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র ছিল আরও বিস্তৃত। গত ৪৫ বছরে অনেক কিছু জানা গেলেও এর সবকিছু এখনো জানা যায়নি। ভুট্টো-কিসিঞ্জার ছাড়াও আরও অনেক দেশ ও অনেক চক্রান্তকারী এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত রয়েছে। আর মোশতাক, জিয়া, ফারুক-রশীদ চক্র বিদেশি প্রভুদের ঘৃণ্য ভৃত্য হিসেবে হত্যাকাণ্ড ঘটাতে স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করেছে। ওই সময়ের বিভিন্ন দলিলে দেখা যায়, শেখ মুজিবকে হত্যার ব্যাপারে একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন কিসিঞ্জার আর ভুট্টো। সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার শীর্ষে ওঠার তীব্র উচ্চাভিলাষ থেকে সেনাবাহিনীর বিপথগামী জুনিয়র সদস্যদের কৌশলে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন জিয়া। ১৫ আগস্ট ভোর রাতে হত্যাকারীরা যখন বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাসভবনে অভিযান চালাচ্ছে সেই মুহূর্তেও সুদূর আমেরিকা থেকে খোঁজখবর রেখেছিলেন কিসিঞ্জার।

হত্যাকাণ্ডের দিন হিসেবে ১৫ আগস্ট তারিখটিকে বেছে নেওয়া হয়েছি্ল পাকিস্তানের সামরিক জান্তার গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর অনুমোদনক্রমে। কারণ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব আর ভারতের সহযোগিতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জয়লাভ ছিল তাদের নৈতিক পরাজয়। তাই ভারতের স্বাধীনতা দিবসটিই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য নির্ধারণ করা হয় প্রতিশোধস্পৃহা থেকে। এর পাশাপাশি তাদের আশঙ্কা ছিল, অন্য কোনো দিনে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে, ভারত-বাংলাদেশের পঁচিশ বছরের শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালাতে পারে। ভারত সামরিক অভিযান চালালে তা সামাল দেয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কিন্তু ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতের সরকার, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক বাহিনী ব্যস্ত থাকবে। এমন একটি দিনে তারা প্রতিবেশী দেশে সামরিক অভিযান চালাবে না। তাই কৌশলগত কারণেই এই দিনটিকে চক্রান্তকারীরা বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন হিসেবে বেছে নেয়।

হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র হয়েছিল কলকাতার আমেরিকান কনস্যুলেট হো চি মিন সরণিতে বসেও। যদিও এই ষড়যন্ত্রের সদর দপ্তর ছিল ওয়াশিংটন ও রাওয়ালপিন্ডি। তবে সরকারের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা বিভিন্ন সময়ে জানানো হলেও বঙ্গবন্ধু এসবে তেমন একটা গুরুত্ব দেননি। তিনি বিশ্বাস করেননি, কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে। এমনকি হত্যাকাণ্ডের আগের দিনও 'র' এর পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত ২০১৯ সালের ১৫ আগস্ট দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত এক লেখায় উল্লেখ করেন, বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধী ও তাঁর স্ত্রী মেনকা গান্ধীর সাথে ১৯৭৭ সালে তার কথা হয়েছিল। তাঁরা সুখরঞ্জন দাশগুপ্তকে জানিয়েছিলেন, হত্যাকাণ্ডের খবর যখন আসে ইন্দিরা গান্ধী তখনও রাতের পোশাকে। এর মধ্যেই ঘর থেকে বেরিয়ে তিনি লনে ছোটাছুটি করছিলেন আর কাঁদছিলেন। আমাদের দেখে জড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, এখনই ধাওয়ানকে ডাকো, মন্ত্রীদের ডাকো। তাঁকে তখন আমরা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছি; কিন্তু তিনি আমাদের সরিয়ে দিয়ে শুধু বলছিলেন, মুজিব ভাই নেই, মুজিব ভাই নেই। আর বলছিলেন, মুজিব ভাইকে বারবার সতর্ক করেছিলাম, উনি আমার কথা শোনেননি। কিন্তু তাঁকে আমরা থামাতে পারছিলাম না। মুজিব ভাই নেই, মুজিব ভাই নেই— একই কথা বারবার বলে যাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পর ধাওয়ান এসে পৌঁছালেন। এলেন বিদেশসচিব জগৎ মেহতা, এলেন সামরিক বাহিনীর প্রধান শ্যাম মানেকশ। ইন্দিরা গান্ধী তাদের বললেন, আপনারা কী করেছেন? আপনারা তো জানতেন, এ ধরনের একটা খবর আমাদের কাছে ছিলো। এলেন ‘র’-এর প্রধান রামনাথ কাউ। কাউকে ইন্দিরা গান্ধী ধমক দিয়ে বললেন, তোমরা কী করেছো? কাউ উত্তরে বললেন, ‘আমরা গতকালও বঙ্গবন্ধুকে বার্তা দিয়েছিলাম। তাঁকে ওই বাড়ি ছাড়তে বলেছিলাম, তিনি আমাদের কথা শোনেননি।’ যা-ই হোক, কেউ তাঁকে থামাতে পারছিলেন না। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেনো তাঁর সহোদর ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছি প্রবীণ মন্ত্রীরা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তখন বিদেশমন্ত্রী ছিলেন ওয়াই বি চ্যাবন। তিনি ইন্দিরাকে বললেন, ‘কয়েক মাস আগে ঢাকায় গিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করে এসেছিলাম। কিন্তু তিনি এতই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে আমাকে বলেছিলেন, আমি জাতির পিতা, আমাকে কেউ মারবে না, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। তাঁকে মারার জন্য জিয়া-খন্দকার জুটি আমেরিকা ও পাকিস্তানের সঙ্গে সব রকম নীলনকশা তৈরি করেছিলেন। এ কথাও আপনাকে ও বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয়েছিলো।’

এ প্রসঙ্গে অশোক রায়নার ‘ইনসাইড র দ্য স্টোরি অব ইন্ডিয়াস সিক্রেট সার্ভিস’ গ্রন্থ থেকে আরও জানা যায়, 'বেগম জিয়ার বাড়ির ট্রেস থেকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ক্যু-এর একটি স্ক্রাপ পেপার উদ্ধার করা হয়েছিলো হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে। কাগজটি গার্বেজ করা হলেও একজন গুপ্তচর গৃহভৃত্যের মাধ্যমে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দিল্লীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। এরপর বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করে দেয়ার জন্য ‘র’এর পরিচালক রামনাথ কাউ ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে পান বিক্রেতার ছদ্মবেশে বাংলাদেশে আসেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করলেও বঙ্গবন্ধু সেটাকে যথারীতি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ওরা আমার সন্তানের মতো। কাউ হতাশ হয়ে দিল্লি ফিরে যান। সেই চিরকুটে জিয়াউর রহমান, মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, জেনারেল ওসমানী এবং মেজর শাহরিয়ায়ের নাম ছিলো। ‘র’ ১৯৭৫ সালে সর্বশেষ আরেকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে দিল্লি থেকে ঢাকা পাঠায়। তিনি বঙ্গবন্ধুকে এই সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের ব্যাপারে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্রই কেবল দেননি, এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জিয়া ছাড়াও আর কারা কারা জড়িত তাদের নামও তাঁর কাছে প্রকাশ করেন। কিন্তু ফলাফল এবারও একই। তবে বঙ্গবন্ধু জিয়াকে মার্চ মাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বদলি করেন এবং এটি নির্ধারিত হয় যে জিয়া কোনো একটি দেশে রাষ্ট্রদূত হয়ে চলে যাবেন। কিন্তু অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কিছু নেতার মাধ্যমে তার বদলির আদেশটি বাতিল করাতে সক্ষম হন জিয়া।

এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সাথে আন্তর্জাতিক যোগসাজশের আরও একটি অকাট্য প্রমাণ মেলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কিছু সময় পরে ওয়াশিংটন সময় সকাল ৮টায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়ে তড়িৎ সভায় বসায়। নিকট প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আথারটন সভায় বাংলাদেশের ঘটনাবলি সম্পর্কে বলেন, ‘এটা হচ্ছে সুপরিকল্পিত ও নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করা অভ্যুত্থান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেন, ‘আমি ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ (আইএনআর) থেকে আরও ভালো খবর পেয়েছি। তিনি ওই কর্মকর্তার সঙ্গে ওয়াশিংটনে আগেই কথা বলেছিলেন। কিসিঞ্জারের ভালো খবর হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর। তাছাড়া স্ট্যানলি উলপার্ট তার গ্রন্থে মুজিব হত্যা-ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর জড়িত থাকার দলিলপত্রও হাজির করেছেন। ১৯৭৫ এর জুনে কাকুলের পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে ভুট্টো বলেন, ‘এ অঞ্চলে শিগগিরই কিছু পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে।’ স্ট্যানলি উলপার্ট আরও লিখেছেন, দু’বছর যাবৎ ভুট্টো বাংলাদেশের কয়েকটি মুজিববিরোধী দলকে তার গোপন ‘স্বেচ্ছাধীন তহবিল’ থেকে অর্থ সাহায্য অব্যাহত রাখেন এবং আগস্ট মাস (১৯৭৫) শেষ হওয়ার আগেই তিনি তার বিনিয়োগের ফল লাভ করেন। এ হত্যাকাণ্ডটি মূলত ছিলো, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের একটি ধারাবাহিকতার সাফল্য।

বাংলাদেশের ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানের যে ঘটনা, তার সঙ্গে পৃথিবীর আর কোনো দেশের সামরিক অভ্যুত্থানের কোনো মিল নেই। কেননা না, সামরিক অভ্যুত্থান দ্বারা যদি প্রধান সেনাপতিসহ তিন বাহিনীর প্রধান ক্ষমতায়ই বসতে না পারলেন তাহলে সেটা কেমন সেনা অভ্যুত্থান? বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে যা হয়েছিল সেটাকে আসলে কোনো সামরিক অভ্যুত্থান বলা যায় না। পনেরোই আগস্টের হত্যা মামলার আপিল শুনানিতেও আদালত বলেছেন, প্রধান সেনাপতি হত্যা চক্রান্তে জড়িত না থাকলেও হত্যাকারীদের প্রতিরোধ এবং দেশের রাষ্ট্রপতির জীবন রক্ষার কাজে ব্যর্থ হয়েছেন এবং ভীরুতার পরিচয় দিয়েছেন। আদালতের এই মন্তব্য সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর তখনকার প্রধানসহ আরও অনেক কর্মকর্তা সম্পর্কে সত্য। তারা জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার চক্রান্তের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না যেমনই সত্যি তেমনই সত্যি হচ্ছে এই চক্রান্ত রুখতেও তারা সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এবং এই হত্যাকাণ্ডের কারণে বেনিফিসিয়ারিও হননি তারা কেউ।

উল্টো এই তথাকথিত অভ্যুত্থানের পরে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী প্রধানকে রাষ্ট্রদূত করে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। একমাত্র বেনিফিসিয়ারি হন উপ-সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান। তাকে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান করা হয়। যিনি ধীরে ধীরে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার ও শাস্তি দেওয়ার পথ রুদ্ধ করার জন্য সংবিধানে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ যুক্ত করেন এবং ঘাতকদের অধিকাংশকেই সরকারি উচ্চপদে নিয়োগ দিয়ে পুরস্কৃত করেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নিয়ে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা করেছেন মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ। লিফশুলজ ১৫ আগস্টের হত্যা ষড়যন্ত্র বিষয়ে ‘An Unfinished Revolution’ নামে একটি তথ্যসমৃদ্ধ বইও লিখেছেন। লিফশুলজ এই গ্রন্থে বহু দলিলপত্র ভিত্তিক তথ্য প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে, লেডিস ক্লাবের তুচ্ছ ঘটনার জের হিসেবে শেখ মুজিব নিহত হননি। তিনি প্রমাণ করেছেন, লেডিস ক্লাবের ঘটনার বহু আগেই মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ প্রতিনিধিদের সঙ্গে মুজিব হত্যাকারীরা যোগাযোগ স্থাপন করেছিলো। লিফশুলজ ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে প্রধান ভূমিকা পালন করেন জিয়া। জিয়ার সহযোগিতা ছাড়া ওই হত্যাকাণ্ড ঘটতোই না। জিয়া অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কর্নেল রশীদের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেন এবং রশীদকে সব সময় আশ্বস্ত করেন যে, তিনি তাদের সঙ্গে আছেন।’

১৯৭৭ সালে ইউরোপের একটি শহরে অভ্যুত্থানের আগে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব যোগাযোগ সম্পর্কে লিফশুলজকে লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আব্দুর রশীদ বলেন, জিয়াই আমাদের আশ্বস্ত করেছে যে, আমেরিকা আমাদের সঙ্গে আছে এবং অন্য কোনো তরফ থেকেও কোন বাধা আসবে না। এসব বিষয় জিয়াই দেখবেন বলে জানান রশীদ। কিসের ভিত্তিতে জিয়া তাদের আশ্বস্ত করেন, এ প্রশ্নের জবাবে রশীদ বলেন, তিনি পরিষ্কার জানতে পেরেছিলেন যে, মার্কিন কর্তৃপক্ষের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাথে জিয়ার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। তবে তিনি ওই কর্মকর্তার নাম জানেন না।

এছাড়াও লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আব্দুর রশীদ ১৯৭৬ সালে ইংল্যান্ডের আইটিভি টেলিভিশনে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলো যে, বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনাকালে সে সময়ের উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়ে তারা হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করলে জিয়া তাদের এগিয়ে যেতে বলেন এবং তাদের উৎসাহিত করে বলেন, তারা সফল হলে জিয়া তাদের সঙ্গেই থাকবেন। সাক্ষাৎকারের এ অনুষ্ঠানটি যুক্তরাজ্য এবং বাইরে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। সাক্ষাতকারটি নিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক নেভিলে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। সেই সাক্ষাৎকারে মাসকারেনহাসকে তারা বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনায় উপরের সহযোগিতা পেতে একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার আশ্রয় এবং দিকনির্দেশনা দরকার ছিলো তাদের। তাই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া জুনিয়র অফিসাররা তৎকালীন আর্মির উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বেছে নেয়। এ বিষয়ে অন্যতম খুনি কর্নেল ফারুক মাসকারেনহাসকে ভিডিও সাক্ষাৎকারে আরও বলেন, 'আমাদের লীড করার জন্য জেনারেল জিয়াই ছিল মতাদর্শগত ভাবে যোগ্যতম ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি'।

হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জিয়ার সাথে ফারুক-রশীদের সাক্ষাৎ এবং আলোচনা যে বহুবার হয়েছে তার প্রমাণ মেলে রশীদের স্ত্রী জোবায়দা রশীদের একটি বক্তব্য থেকেও। তিনি বলেন, 'একদিন রাতে ফারুক জিয়ার বাসা থেকে ফিরে আমার স্বামীকে (রশীদ) জানায় যে, সরকার পরিবর্তন হলে জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চায়। শুধু তাই নয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে জিয়া আরও বলেন- এটি যদি সফল হয় তবে আমার কাছে এসো, আর যদি ব্যর্থ হয় তবে আমাকে জড়িত করো না'।

এছাড়াও, অন্য একটি ঘটনায় মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে জিয়া যে বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্তের বিষয়ে আগে থেকেই অবহিত ছিলেন সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় কর্নেল শাফায়েত জামিল এবং জিয়ার কথোপকথন থেকে। হত্যাকাণ্ডের কিছু সময় পর শাফায়েত জামিল জিয়ার সাথে দেখা করতে গেলে তাকে শেভ করতে দেখেন। জামিল জিয়াকে বলেন, 'The President has been killed, Sir. What are your orders'? জিয়া নির্বিকারভাবে তখন তাকে বলেন, 'If the President is no longer there, then the Vice President is there. Go to your headquarters and wait there'.

তার একটু পরেই ঘটনায় আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর জরুরী তলব পেয়ে চিফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফের সাথে জিয়াও সেনাসদরে এসে উপস্থিত হন। তখন খালেদের পরনে শার্ট ও পায়জামা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছেন। অন্যদিকে জিয়া এসেছেন ক্লিন শেভ ও মেজর জেনারেলের এক্সিকিউটিভ পোশাকে ড্রাইভার চালিত সরকারি গাড়িতে। জিয়ার এরকম পূর্বপ্রস্তুতিমূলক ফিটফাট হয়ে থাকা এবং ভাবলেশহীন শান্ত– নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বরই প্রশ্নের উদ্রেক ঘটায় যে তিনি নিশ্চয়ই আগেই থাকেই সবকিছু জানতেন, না জানলে তারও তো খালেদের মত অগোছালো অবস্থায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসার কথা ছিলো।

জিয়ার জড়িত থাকার আরেকটি প্রমাণ মেলে হত্যাকাণ্ডের মাত্র সপ্তাহখানেক আগে ঢাকার একটি বাসায় কুখ্যাত মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরির সাথে জিয়াউর রহমানের বৈঠকের মাধ্যমে। চেরির বিশেষ আগ্রহে তৃতীয় পক্ষের একজনের বাড়িতে হয় সেই বৈঠকটি। সেখানে একমাত্র আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন সস্ত্রীক জিয়াউর রহমান। উপরমহলের কারো সম্মতি না থাকলে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীদের কারও সঙ্গে ওই সময়ে চেরির বৈঠকে বসা কিংবা কথা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। চেরি নিশ্চয়ই ওয়াশিংটন কিংবা ল্যাংলিতে সিআইএ সদরদপ্তরের নির্দেশমতো কাজ করছিলো তখন। ওই দিনের ঘটনার বিবরণের ভিত্তিতে লিফশুলজ দাবি করেন, জিয়া এবং চেরি একে অপরকে আগে থেকেই চেনেন বলে মনে হচ্ছিল। তার ভাষ্য মতে, সেই রাতে ডিনারের আগে এবং পরে দীর্ঘ সময় ধরে চেরি-জিয়ার মাঝে নিমন্ত্রণকর্তার বাসার বাগানে বসে আলাদাভাবে কথোপকথন চলে। ওই সময়ে তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু কী হতে পারে তা নিশ্চয়ই একজন সচেতন মানুষের বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কারণ, জিয়া-চেরির সেই ডিনার কোনো সামাজিকতা সৌজন্যতামূলক সাক্ষাৎ ছিলো না। চেরি ভালো করেই বুঝেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে হলে জিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। লিফশুলজ তার অনুসন্ধানের ভিত্তিতে মন্তব্য করেন যে, প্রমাণ ক্রমবর্ধমানভাবে এই ইঙ্গিত দেয় যে জিয়া অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান স্থপতি ছিলেন এবং খোন্দকার মোশতাক আহমেদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।

সোজা কথায়, হাজার হাজার মাইলের পথ দূর থেকে কিসিঞ্জার-ভুট্টো আর ঢাকা থেকে রাষ্ট্রদূত বোষ্টার এবং সিআইএ স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরি মুজিব হত্যাকাণ্ড সরাসরি তদারকি করেছেন। এদের সহায়তায় কৌশলে পেছন থেকে মূল ভূমিকাটা পালন করে গিয়েছিলেন জেনারেল জিয়া। তিনি বিরোধিতা করলে এই অভ্যুত্থান ঘটানো সম্ভবই ছিল না কোনোদিন। তা না করে উল্টো তিনি অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া অফিসারদের বিভিন্ন সময়ে দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। এ থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে জিয়া ওৎপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। প্রকাশ্যে কিছু না করলেও মূলত তিনিই ছিলে্ন নাটের গুরু। বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ থেকেও বোঝা যায়, অভ্যুত্থানের মূল কারিগরদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জিয়া। খন্দকার মুশতাক আহমেদের চেয়ে তার ভূমিকা ছিল অনেক বড়।

লেখকঃ কবি, কলামিস্ট

[email protected]

ঢাকাটাইমস/১৫আগস্ট/মোআ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :