খুনিদের ফাঁসির দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছি

একেএম শহীদুল হক
 | প্রকাশিত : ১৮ আগস্ট ২০২০, ১৫:২৯

২০১০ সাল। আমি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার। ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় ডিসি (হেডকোয়ার্টার্স) হাবিবুর রহমান একটি লালরঙের এনভেলাপ আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘স্যার, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আজ ফাঁসি হবে।’ আমি এনভেলাপ খুলে পাঁচটি চিঠি দেখতে পেলাম। প্রতিটি চিঠি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার স্বরাষ্ট্র সচিবকে লিখেছেন। আইজি (প্রিজন), পুলিশ কমিশনার, জেলা জজ, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও সিভিল সার্জনকে অনুলিপি দিয়েছেন। পুলিশ কমিশনারকে অনুরোধ করেছেন ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার সময় নিজে অথবা ডিসির নিচে নয়, এমন একজন প্রতিনিধি উপস্থিত রাখতে। পত্রে যাদের ফাঁসি কার্যকর করা হবে তারা হচ্ছে-

লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব্যাহতি) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব.) একেএম মহিউদ্দিন, মেজর মো. বজলুল হুদা (আর্টিলারি) এবং লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহম্মেদ (২য় আর্টিলারি)। ডিসি হাবিবুর রহমান ফাঁসি প্রত্যক্ষ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করল। এটি হাবিবের পক্ষে স্বাভাবিক। সে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন সাহসী সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তার মধ্যে প্রখর। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি প্রত্যক্ষ করার প্রচণ্ড ইচ্ছে আমি তার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি। হাবিবকে বললাম, ‘হাবিব, ১৯৭৫ থেকেই বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার চেয়ে আসছি। খুনিদের ফাঁসি চাই- এ স্লোগান দিয়ে সভা-সমাবেশ ও মিছিলে যোগদান করেছি। আজ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি কার্যকর প্রত্যক্ষ করতে আমারও খুব ইচ্ছে।’ হাবিব বলল, ‘ঠিক আছে স্যার, আপনি যান।’

আমি কেন্দ্রীয় জেলখানা ও গোটা মহানগরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দিলাম। ফাঁসির পর মৃতদেহগুলো গ্রামের বাড়িতে পাঠানোর জন্য এস্কর্ট প্রস্তুত করতে ও অ্যাম্বুলেন্স সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর জন্যও হাবিবকে নির্দেশ দিলাম। পুলিশ কন্ট্রোলরুমে কয়েক প্লাটুন ফোর্স এবং অফিসার স্ট্যান্ডবাই রাখলাম। এসব নিরাপত্তা নেয়া হয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধী মহল আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে পারে এ আশঙ্কায়। তবে তাদের কোনো তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি।

আমি রাত ১০টার পর কেন্দ্রীয় কারাগারে গেলাম। কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে এবং রাস্তায় ক্যামেরাসহ বহুসংখ্যক সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। অসংখ্য উৎসুক জনতাও ভিড় করেছিল। কেউ যেন সীমানা অতিক্রম করে বেষ্টনীর ভেতরে আসতে না পারে, সেজন্য বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য মোতায়েন ছিল।

আমি জেল সুপারের অফিসে প্রবেশ করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও সিভিল সার্জনকে দেখতে পেলাম। কিছুক্ষণ পর স্বরাষ্ট্র সচিব জনাব সোবহান সিকদার এলেন। রাত সাড়ে ১১টার পর আমরা ফাঁসির মঞ্চের কাছে গেলাম। মঞ্চের সামনে আমাদের বসার জন্য চেয়ার ছিল। রাত ১২টার সময় খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান এবং সুলতান শাহরিয়ার রশিদকে হাতকড়া এবং কালো জমটুপি পরিয়ে ফাঁসির মঞ্চের কাছে নিয়ে আসা হয়। জল্লাদরা তাদের ফাঁসির মঞ্চে উঠাল। চতুর্দিকে পিনপতন নীরবতা। কোনো শব্দ নেই। ফাঁসির আসামিরাও নীরবে হেঁটে হেঁটে মঞ্চের কাছে গিয়েছিল। তারা কোনো কথাই বলেনি। দুটি ফাঁসির মঞ্চ পাশাপাশি ছিল। দু’জন জল্লাদ দুই ফাঁসির মঞ্চে ছিল। তারা আসামিদের গলায় ফাঁসির রশি পরিয়ে অপেক্ষা করছিল। অন্য দুই জল্লাদ আসামিদের পায়ের নিচের কাঠ সরিয়ে নেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। রাত ০০.০৫ মিনিটে সিনিয়র জেল সুপার তৌহিদুল ইসলাম তার হাতে থাকা একটি রুমাল মাটিতে ফেলে দিয়ে জল্লাদদের সিগন্যাল দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে জল্লাদদ্বয় দুই ফাঁসির আসামির পায়ের পাটাতন লিভারের মাধ্যমে টান দিয়ে সরিয়ে নিল। তাৎক্ষণিক আসামিরা নিচে পড়ে গেল এবং গলায় ফাঁস লেগে তাদের মৃত্যু হল। কিছুক্ষণ ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর মৃতদেহ ফাঁসির মঞ্চ থেকে নিচে নামানো হল।

দ্বিতীয় ধাপে একেএম মহিউদ্দিন ও বজলুল হুদাকে ফাঁসির মঞ্চে আনা হল। তাদের ফাঁসি একই উপায়ে কার্যকর করা হল। সর্বশেষ লে. কর্নেল মহিউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মহিউদ্দিন খুব কান্নাকাটি করছিল। প্রাণভিক্ষা চাচ্ছিল। ফাঁসির মঞ্চে উঠতে চায়নি। জোরপূর্বক তাকে ফাঁসির মঞ্চে উঠানো হয়েছিল। সিভিল সার্জন পোস্টমর্টেমের ব্যবস্থা করেন। পোস্টমর্টেম ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর কফিনে মৃতদেহ উঠিয়ে পুলিশের এস্কর্ট পার্টির কাছে হস্তান্তর করা হয়।

পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোনে সংবাদ দিলাম। তিনি বললেন, ‘সব দিকে খেয়াল রেখো। মৃতদেহগুলো ঠিকমতো পৌঁছে দিও।’ তার কণ্ঠ ভারি ছিল। মনে হচ্ছিল, তিনি কাঁদছিলেন। পরে শুনেছি, এশার নামাজের পর থেকেই তিনি নফল নামাজ পড়ছিলেন ও কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন। এই দিনে পিতা, মাতা, ভাই ও আত্মীয়স্বজন, যাদের হায়েনার দল নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল; তাদের কথা মনে পড়াই স্বাভাবিক। পিতার হত্যার বিচার করতে পেরেছেন, বিচার কার্যকর হয়েছে- এজন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছেন, তাদের জন্য দোয়া করছেন।

মৃতদেহগুলো প্রত্যেকের নিজ নিজ জেলার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিয়ে আমি কারাগার প্রাঙ্গণ থেকে বাসায় ফিরি। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি কার্যকরের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে পেরে আমি ইতিহাসের সাক্ষী হলাম। পাঁচজন লোকের মৃত্যুর দৃশ্য অত্যন্ত কাছ থেকে দেখলাম। বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি। বারবার মনে পড়ছিল- এ নরপশুরা যখন জাতির পিতাকে তার পরিবারের মহিলা ও শিশুসহ সবাইকে নির্মম ও বর্বরোচিতভাবে হত্যা করেছিল; তখন মুহূর্তের জন্যও কি তাদের বুক কেঁপে ওঠেনি? তারা কেউ কি একবারও ভাবেনি, যে মানুষটি সারা জীবন আপসহীনভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করে, জেল-জুলুম-অত্যাচার সহ্য করে বাঙালির পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করেছেন, জাতিকে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়ে জাতির পিতা হয়েছেন, স্বাধীনতার সেই মহানায়ক, বাঙালির অকৃত্রিম বন্ধুকে হত্যা করতে তাদের হৃদয়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও এ কথাগুলো কি ভেসে উঠেনি? তার চেহারা দেখেও কি খুনিদের হৃদয়ে একটু কম্পন জাগেনি? না, খুনিদের পাষাণ হৃদয়ে তা জাগেনি। তারা তো মানুষরূপী পশুতে পরিণত হয়েছিল। আজ সেই খুনিদের কয়েকজনের ফাঁসি হল। জাতি কলঙ্কমুক্ত হল।

ষড়যন্ত্রকারীরা সুপরিকল্পিতভাবে বিপথগামী মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের দ্বারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করিয়েছে, যাতে হত্যার দায় স্বাধীনতাবিরোধীদের ঘাড়ে না যায়। সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও খুনিদের ফাঁসির আদেশ কার্যকর দেখতে জাতিকে দীর্ঘ একুশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যার পর ষড়যন্ত্রকারী ও খুনি মোশতাক অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পথ বন্ধ করে দেন এবং হত্যাকারীদের দায় থেকে মুক্তি দেন। জিয়া ওই অধ্যাদেশকে পবিত্র সংবিধানের অংশ করেন। তিনি হত্যাকারীদের বিদেশী মিশনগুলোয় গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করেন। যে মানুষটি জীবন-যৌবন সব বিলিয়ে দিয়ে, সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করে দেশ স্বাধীন করলেন, তার সেই প্রিয় দেশের মাটিতে তারই হত্যার বিচার আইন করে বন্ধ করা হয়েছিল- ভাবা যায়!

একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্ত ও বিচারের পথ উন্মুক্ত করে। ৮ নভেম্বর ১৯৯৮ খুনিদের বিচারের রায় হয়। ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়। আসামিদের আপিল হাইকোর্ট হয়ে সুপ্রিমকোর্টে যায়। বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে আপিল বিভাগের সাতজন বিচারক মামলার শুনানিতে বিব্রতবোধ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানিতে উচ্চ আদালতের বিচারকরা বিব্রতবোধ করবেন- এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। তারা তো শপথ নিয়েই চেয়ারে বসেন। আসলে বিএনপি-জামায়াত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার করতে চায়নি। তারা খুনিদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। যাহোক, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শুনানি শেষে ১৯ নভেম্বর ২০০৯ তারিখে আপিল খারিজ হয়ে যায়। হাইকোর্টের দেয়া ১২ জন খুনির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে এবং তাদেরই কয়েকজনের মৃত্যদণ্ড কার্যকর করা হয়।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না এলে হয়তো এ বিচার কখনও হতো না। যোগ্য পিতার যোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাকে সালাম ও শ্রদ্ধা; তার সাহসী পদক্ষেপের মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য।

লেখক : সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :