যেদিন বাংলাদেশের রাজনীতি চিরতরে বিভক্ত হয়েছিল

প্রকাশ | ২১ আগস্ট ২০২০, ২১:৫৪

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

অনেকেই বলেন বলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় না? হয়, এবং হয় বলেই বাংলাদেশে চোখের সামনে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখেছি আমরা। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট যা ঘটেছিল, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঘটল তারই পুনরাবৃত্তি। বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছিল, হত্যায় যাদের মদদ ছিল, তারাই চেয়েছিল বঙ্গবন্ধু কন্যাসহ পুরো আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট যারা ঘটিয়েছিল, তাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানো। একুশে আগস্ট সেই শক্তিই ঘটিয়েছে যারা পূর্ব পাকিস্তান ফিরিয়ে আনার এক প্রকল্প নিয়ে মাঠে সক্রিয়। ১৫ আগস্টের সাথে জড়িয়ে আছে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়ার নাম আর একুশে আগস্টের সাথে জড়িত তার পুত্র তারেক রহমান, যিনি এই মামলায় যাবজ্জীবন সাজা পেয়ে এখন দেশের বাইরে ফেরারি।

২০০১ সালে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে সাথে ক্ষমতা পেয়ে বিএনপি যে ধর্ষণ, খুন আর জঙ্গি চর্চার উৎসবে মেতেছিল তার সবচেয়ে কদর্য প্রকাশ ছিল একুশে আগস্ট। ক্ষমতার দম্ভ মানুষকে কোথায় নিয়ে যায় যে, রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা করে, সংসদের প্রধান বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে, নেতৃত্বশূন্য করতে ঠান্ডা মাথায় জঙ্গিদের দিয়ে গ্রেনেড হামলা করাতে পারে সরকারি দলের নেতারা!

যারা বলেন, রাজনীতিতে সমঝোতার ও সহাবস্থান প্রয়োজন, তাদের বুঝতে হবে আলোচনা, বিতর্ক, সমঝোতা তাদের সাথে হতে পারে, যারা এর মর্ম বোঝে। একুশে আগস্টের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিকে চিরদিনের জন্য বিভক্ত করেছে। বাংলাদেশের রাজনীতি অনেকদিন ধরেই সংঘাতময়। কিন্তু বিএনপি ও জামায়াত ২০০১ সালের ক্ষমতায় এসে যা যা করেছে, একুশে আগস্ট যা ঘটিয়েছে সেটি হলো নির্মূলের রাজনীতি যার কারণে আর কখনো কোন সমঝোতা বা আলোচনার কোন পথ এদেশে আর খোলা নেই।

এত বড় একটি নৃশংস ঘটনার পর বিএনপি থেকে প্রচার করা হলো, আওয়ামী লীগ নিজেই বোমা ফাটিয়েছে। সংসদে দাঁড়িয়ে বিএনপি প্রধান, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বললেন, শেখ হাসিনা নাকি নিজেই ভ্যানিটি ব্যাগে করে বোমা নিয়ে গিয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে এমন মর্মান্তিক কৌতুক কোন সভ্য মানুষ করতে পারে কিনা সেটা বিএনপি বুদ্ধিজীবীরাই বলতে পারবেন। বিচার না করে কোন এক জজ মিয়াকে হাজির করে, মিথ্যা কথা শিখিয়ে আসলে এই হামলার দায় নিয়ে নিজেরাই নিয়েছিলেন বেগম জিয়া ও তারেক রহমান।

আদালত প্রমাণ পেয়েছেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই দিনের নৃশংস হামলায় অলৌকিকভাবে শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও দলটির তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত ও কয়েকশ' আহত হন। ২০১৮ সালে দীর্ঘ ১৪ বছর পর ওই গ্রেনেড হামলার রায় প্রকাশ হয়। রায়ে আমরা দেখেছি রাষ্ট্রযন্ত্র কিভাবে জড়িয়ে পড়ে। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালতও বলেছে, রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের সহায়তায় সেই হামলার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেখানে রাষ্ট্রের যোগসাজশ স্পষ্ট, সেখানে নিরাপত্তার বিষয়ে বলা বাহুল্য।

১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে যে রাজনীতির সূচনা করেছিল মুশতাক, জিয়া আর এরশাদ, এর মূল উপাদান ছিল সাম্প্রদায়িকতা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বদলে, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মূল দর্শন ছিল ঘৃণার রাজনীতি। সেই ঘৃণা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, উদারতার প্রতি, প্রগতির প্রতি। দলে সক্রিয় হয়ে ২০০১-সালে ক্ষমতা পেয়ে তারেক রহমান বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ফ্যাসিবাদ কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে।

আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, প্রগতিশীল সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এক সর্বব্যাপী ঘৃণার রাজনীতি শুরু করেছিল বিএনপি-জামায়াত। এসবের অগ্রভাগে ছিলেন তারেক রহমান, কারণ তিনিই কার্যত সরকার পরিচালনা করতেন হাওয়া ভবন নামের এক বেসরকারি সচিবালয়ে বসে। তার লাগামহীন স্বেচ্ছাচারিতায় দেশ এক জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। বিএনপির কিছু মন্ত্রী ও এমপির প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজশাহীর বাগমারায় বাংলা ভাই আর শায়খ আবদুর রহমানের মাধ্যমে জেএমবি নামের জঙ্গি গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল, আহলাদে, আপ্যায়নে বড় হয়ে উঠেছিল হরকাতুল জেহাদ। দেশব্যাপী জঙ্গি হামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র আমদানি, ৫৩ জেলায় সিরিজ বোমা হামলা, সিনেমা হলে আক্রমণসহ অসংখ্য ঘটনায় বিশ্ববাসীও ভাবছিল- জামায়াত-বিএনপির যৌথ শাসন বাংলাদেশকে গড়ে তুলছে আরেক আফগানিস্তান হিসেবে। 

জনসাধারণের সামাজিক আর রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়ে এমন এক শাসনব্যবস্থা তখন গড়ে উঠেছিল যে, যা ছিল নৈরাজ্যকর ও ফ্যাসিবাদি। তারেক রহমান ঘৃণার রাজনীতি চালু করেছিলেন, ভেবেছিলেন শেখ হাসিনাকে হত্যা করলে আজীবন ক্ষমতায় থাকবেন তিনি ও তার দল। ভাগক্রমে শেখ হাসিনা বেঁচে আছেন এবং পরপর তিনবার নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনা করছেন।

ঘৃণা বস্তুটি প্রবাহমাণ এবং এর গতি তার দিকেই ধাবিত হয় যে এর সৃজন করে। জাতীয় ঘৃণা আজ তারেক রহমানের প্রতি বয়ে চলেছে। তারা গণতন্ত্রের কথা বলত, আবার তারা হত্যার নেশায় উন্মত্ত ছিল। এই দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে, ক্ষমতার আস্ফালনের বিরুদ্ধে মানুষ জেগেছিল এবং এখনো জেগে আছে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।