ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ও শ্রিংলার ঝটিকা সফর

প্রকাশ | ২২ আগস্ট ২০২০, ১২:১০ | আপডেট: ২২ আগস্ট ২০২০, ২০:০১

কাওসার রহমান

সম্প্রতি এক ঝটিকা সফরে বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। সফরটি এই কারণে ঝটিকা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে যে, অন্যান্য বারের মতো এবার কোন আগাম ঘোষণা দিয়ে তিনি বাংলাদেশে আসেননি। ছয় মাস আগেও তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। যার ঘোষণা ভারতের পক্ষ থেকে আগেই দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার আগাম কোন ঘোষণা দেয়া হয়নি। বরং ভারতের আগ্রহের কারণেই এই সফরটি হয়েছে। এ কারণে তার এই সফরকে গণমাধ্যম ঝটিকা হিসাব্যে আখ্যায়িত করেছে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে সম্পর্ক নিয়ে নেতিবাচক বেশ কিছু লেখালেখি, বিশেষ করে ভারতীয় গণমাধ্যমে আক্রমনাত্মক কিছু লেখালেখির কারণে এ ধরনের একটি সফর প্রত্যাশিত ছিল। আর এই সফরের মাধ্যমে শ্রিংলা দুই দেশের সম্পর্কেও সেই উত্তপ্ত অবস্থাকে প্রশমিত করার চেষ্টা করেছেন। সেই সঙ্গে দুই দেশের সম্পর্কে আগের সেই উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাই করা হয়েছে। অবশ্য প্রকাশ বিবৃতিতে সেই বিষয়টিও উঠে এসেছে। দুই পক্ষ থেকেই বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের সম্পর্কের শীতলতা বা অস্বস্তি নিয়ে নানান যে আলোচনা চলছে, সে ব্যাপারে ঢাকায় দেশ দু’টির পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠকে একে অপরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। দুইপক্ষই বলেছে, দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে সোনালী অধ্যায় চলছে, তা অব্যাহত থাকবে এবং সেই সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নেয়া হবে।

বর্তমান সরকারের আমলে দুই দেশের সম্পর্কে যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় থাকবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এতদিন সেই সম্পর্কই অব্যাহত ছিল। কিন্তু এমন সম্পর্কের মাঝে অস্বস্তি তৈরি হলো কেন? আর অস্বস্তির কারণগুলোই বা কী? বড় দেশ হিসাবে ভারত প্রতিবেশি ছোট দেশগুলোর সমর্থন তাদের পেছনে আছে বলে এরকম ধরেই নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ গত কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন নীতির কারণে অনেক ক্ষুব্ধ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মুচকুন্দ দুবের মুল্যায়ন হলো, ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতি রাষ্ট্রের ব্যবহার। বাংলাদেশে সবার সঙ্গে কথা বলে আমি যেটা বুঝেছি, তা হলো ভারতে মুসলিমদের কেন গরুর গোশত খাওয়ার জন্য পিটিয়ে মারা হবে এবং শুধু মুসলিম হওয়ার অপরাধে কেন একদল মানুষ বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার হবে। এটা তাদের ক্ষুব্ধ ও হতাশ করে। সে দেশে ভারতকে যারা ধর্মনিরপেক্ষতার আলোকবর্তিকা হিসেবে দেখতেন, তাদের জন্যও এই বাস্তবতা মেনে নেওয়া হৃদয়বিদারক হয়ে ওঠে বলেও তার পর্যবেক্ষণ!

আসামের এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরির প্রক্রিয়া এবং গত বছর (২০১৯) পাস হওয়া ভারতের নাগরিকত্ব আইন সেই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে নিঃসন্দেহে। গত ডিসেম্বরে ভারত নাগরিকত্ব বিল পাস করার পর ড. মোমেনই তার নির্ধারিত দিল্লি সফর স্থগিত করেছিলেন। সে সময় ভারতে যাওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানেরও। কিন্তু তিনিও শেষ পর্যন্ত যাননি। ওই দুটো সফরের কোনোটাই আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি এবং ভারতে মুসলিমদের প্রতি বঞ্চনার প্রশ্নে ঢাকার যে একটা অভিমান বা অনুযোগ রয়েই গেছে, সেটা ওই সফর বাতিলে আর গোপন থামেনি। কিন্তু ওই আইন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বারেবারই বলে এসেছে যে আইনটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।

আবার এই পটভূমিতে ৫ আগস্ট মহাধুমধামে ভারতের অযোধ্যায় সুবিশাল রামমন্দিরের ভূমিপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ তিন দশক আগে ভেঙে ফেলা বাবরি মসজিদের জায়গায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এখন যে রামমন্দির তৈরি হবে, তারই নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও সে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন।

আবার সীমান্তে মানুষ হত্যা নিয়েও বাংলাদেশের উদ্বেগ আছে। এছাড়া তিস্তা চুক্তি আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি, রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ কাঙ্খিত সমর্থন ভারতের কাছে পায়নি। তারপরেও প্রতিবেশিদের মধ্যে ভারতের সবচেয়ে ভাল বন্ধু যদি কেউ থাকে সেটা হল বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ কখনই আগ বাড়িয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়নি বা নেবে না যেখানে ভারতের সাথে তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশ যদি নিজের স্বার্থে কখনও মনে করে যে চীনের সাথে তাদের সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে, সেটা বাংলাদেশ করতে পারবে না। এই স্বাধীনতা বাংলাদেশের আছে। অথচ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে নিকৃষ্ট ভাষায় সমালোচনা করা হয়েছে।

১৭ জুন লাদাখে চীনের সৈন্যদের সঙ্গে সংঘাতে ভারতের ২০ সেনা নিহত হয়। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যখন উত্তেজনা চলছে, তার দুই দিন পরেই বাংলাদেশকে চীন আরও ৫ হাজার ১৬১ পণ্যের ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়। মুলত স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে চীনের বাজারে এই সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। যা চলতি বছরের ১ জুলাই  থেকে শুরু হয়ে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। অথচ ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যম এই বলে খবর প্রকাশ করে  যে, চলমান পরিস্থিতিতে চীন বাংলাদেশকে কাছে টানতেই এই পদক্ষেপটি নিয়েছে।

অথচ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক হচ্ছে অর্থনৈতিক। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার চীন সফরের পর থেকে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক ভিন্নমাত্রা নিয়েছে। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং বাংলাদেশ সফর করে। সে সফরের সময় চীন এবং বাংলাদেশের মধ্যে ২৬টি নানা ধরণের চুক্তি এবং সমঝোতা হয়। দুই দেশের কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, চীন বাংলাদেশকে বিভিন্ন খাতে ২৪ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ঋণ দেবে বলে অঙ্গীকার করে। যার বেশিরভাগই অবকাঠামো খাতে।

বর্তমানে চীন বাংলাদেশে পদ্মা সেতুসহ নানা অবকাঠামো প্রকল্পের সাথে সরাসরি জড়িত। এছাড়াও চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ, একটি সার কারখানা, চট্টগ্রাম এবং খুলনায় দুটি বড় তাপ বিদ্যুৎ  কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের সাথেও চীন সম্পৃক্ত আছে। এছাড়া চীনের কাছ থেকে সাবমেরিনও ক্রয় করেছে বাংলাদেশ।

ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কটা এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক। এ জায়গাটাকে দিল্লী উদ্বেগের সাথে দেখলেও  শেষ পর্যন্ত কূটনীতিক আলাপ-আলোচনায় তা অন্য কিছু প্রমাণ করাটা দুরুহ হবে। কারণ উভয় দেশের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। আর এ কারণেই সোনাদিয়া দ্বীপে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের ক্ষেত্রে ভারত এবং চীন উভয় দেশের আগ্রহ দেখালে,  একপক্ষকে একাজ দেয়া হলে অন্যপক্ষ অখুশি হতে পারে- এমন আশংকায় কোন পক্ষকেই এ কাজটা দেয়া হয়নি।

সেদেশের মিডিয়া অভিযোগ করেছে, ভারতীয় হাইকমিশনার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চার মাস সাক্ষাৎ করতে পারেননি। অথচ করোনার কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কারও সঙ্গে দেখা করেননি। আর ভারতের হাইকমিশনার দেশে ফিরে যাবেন সেপ্টেম্বরের শেষে অথবা অক্টোবরের প্রথমে। এরমধ্যে তিনি একটি সাক্ষাৎ চেয়েছেন। আবার বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এমন অভিযোগও তোলা হয় যে ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনর্নিবাচিত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে বিভিন্ন ভারতীয় প্রকল্পের কাজে ধীরগতি চলছে।

এছাড়া পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী টেলিফোন করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পরও ভারতের পত্র-পত্রিকায় নানা উদ্বেগ প্রকাশ করে খবর প্রকাশ করে, যা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে অস্বস্তির কারণ হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কিন্তু ভারত কেন ভূলে যায় যে, তার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক রক্তের। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা রক্তের এ সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে। ১০ মিনিট কথা বললেই পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভারতের উদ্বেগের পর্যায়ে চলে যাবে না। বাংলাদেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভারতের যে ভূমিকা বাংলাদেশ তা ভূলে কী করে? রক্তের রাখি বন্ধনে যে সম্পর্কের সৃষ্টি তা কি কখনো ভোলা যায়?

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলছেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক এবং চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক। সম্প্রতি চীন আমাদের দেশে ৮ হাজারেরও বেশি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। এটা আমাদের জন্য বড় পাওয়া। এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর কোনও প্রভাব পড়বে না।’ অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়, ভারত বাংলাদেশের বন্ধুত্ব সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং ৭১ এর রক্তের রাখিবন্ধনে আবদ্ধ। সম্পর্কের এই সেতুবন্ধ সময়ে পরিক্রমায় দিন-দিন নবতর মাত্রায় উন্নীত হচ্ছে।

প্রকৃতপক্ষে, ভারতের আচরণের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চীন একটা জায়গা করে নিচ্ছে। এই অঞ্চলে  নেপাল-শ্রীলংকাও চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ফলে প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের ঘাটতির বিষয়টা হয়তো ভারত এখন অনুধাবন করছে। সেজন্যই ভারত বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের শীতলতা হয়তো কাটানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ভারত আচরণ পরিবর্তন না করলে শুধু আলোচনা করে বা ভাল ভাল কিছু কথা বলেই সম্পর্কের ক্ষেত্রে অস্বস্তি বা মান-অভিমান দূর হবে না।

যখন দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপট আলোচনায় এসেছে। তখন মহামারি পরিস্থিতি সামাল দেয়া এবং ভ্যাকসিন ইস্যুতে বাংলাদেশ এবং চীনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার বিষয়টিও অনেক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান হয়েছে। বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে যেমন নানা জল্পনা কল্পনা চলছে, একইসাথে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের গণমাধ্যমেও দেশটির রাজনৈতিক মহলের অস্বস্তির বিষয় শিরোনাম হয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ে বছরের পর বছর আলোচনা হলেও তিস্তা নদীর পানি বন্টন চুক্তি না হওয়া এবং দ্বিপাক্ষিক কিছু ইস্যুতে ভারতের ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশে এক ধরণের হতাশা রয়েছে। এসব কারণেই করোনাভাইরাস দুর্যোগের পাঁচ মাস পর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এই প্রথম কোন দেশে অর্থাৎ বাংলাদেশে উড়ে এসেছেন। এর আগে গত ২৭ জুলাই শুভেচ্ছাস্বরূপ বাংলাদেশের কাছে ১০টি ব্রডগেজ লোকোমোটিভ বা রেল ইঞ্জিন হস্তান্তর করে ভারত। আর এমন পটভূমিতেই দুই দেশের সম্পর্কের বিষয়ই আলোচনায় অগ্রাধিকার পেয়েছে ঢাকায় দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিবের বৈঠকে। জনাব শ্রিংলা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথেও দেখা করে প্রায় এক ঘন্টা সময় ধরে তারা আলোচনা করেছেন।

এসব অস্বস্তির বিষয় কাটানোর একটি উদ্যোগও নেয়া হয়েছে বৈঠকে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, নানা জল্পনা কল্পনার জবাবে তারা দুই দেশের ভাল সম্পর্কের বিষয় মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে তুলে ধরার ব্যাপারে একমত হয়েছেন। করোনাকালীন অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান অপ্রীতিকর বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব। দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন ইস্যু যেমন ভ্যাকসিন সহযোগিতা, বাবল এয়ার, জয়েন্ট কনসালটেটিভ মিটিং, মুজিববর্ষ, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় ঢাকা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।

ভারতের কূটনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, ইমরান খান ঢাকায় একটা কি দুটো ফোন করলেই যে সর্বনাশ হয়ে যাবে না, সেটা ভারত খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু তিনি যদি বাংলাদেশের মতো মুসলিম-প্রধান একটা দেশে কাশ্মির আবেগকে উসকে দিতে চান, তাহলে ভারতকে যে কূটনৈতিকভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে, দিল্লি সে বিষয়েও সচেতন! দিল্লির জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর সাউথ এশিয়া স্টাডিজের প্রধান ড. সঞ্জয় ভরদ্বাজের কথায়, ‘চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি। অর্থনৈতিক স্বার্থে, বিনিয়োগের স্বার্থে ঢাকাকে যে বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেই হবে-এটা উপলব্ধি করার মতো বিচক্ষণতা ভারতের নেই, এটা ভাবাটাও চরম ভুল হবে’।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব তথা মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তবও বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা আসলে ঐতিহাসিক এবং সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। জম্মু ও কাশ্মিরকে এবং সেখানে যা-ই ঘটুক সেটাকে তারা চিরকাল ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলেই স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সেই অবস্থানেই তারা অনড় আছে।’ এর মাধ্যমে যে কথাটা তিনি অনুচ্চারিত রেখেছেন তা হলো, ইমরান খান টেলিফোনে যতই কাশ্মির প্রসঙ্গ খুঁচিয়ে তুলুন না কেন, শেখ হাসিনা তাতে যে মোটেই আমল দেবেন না, ভারতের সেই ভরসা আছে পুরোমাত্রায়। কোভিড মহামারির কারণে ভারতের অর্থায়নে বাংলাদেশের প্রকল্পগুলোতে ধীর গতি এসেছে বটে। তবে লকডাউনের মধ্যেও যেভাবে রেলপথে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যের নতুন নতুন দিগন্ত খুলছে, কিংবা চট্টগ্রাম হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জাহাজে পণ্য পাঠানোর উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে, তাতে স্পষ্ট বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কিন্তু থেমে নেই। এমনকি, দুদেশের যৌথ উদ্যোগে নির্মীয়মাণ রামপাল বিদ্যুৎ উৎপাদন  কেন্দ্রেুর কাজও কিন্তু লকডাউনে থেমে থাকেনি বলে জানিয়েছে, ভারতের পররাষ্ট্র দফতর।

সবশেষে, দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শক্ত ভিতের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে। ইমরান খান কয়েক মিনিট কথা বললেই বাংলাদেশের কাশ্মির নীতি বদলে যাবে-এটা যেমন বিশ^াসযোগ্য নয়। তেমনি বাংলাদেশ গালওয়ান নিয়ে বিবৃতি দিলো না বলেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ভেঙে পড়বে, এটাও একেবারেই হাস্যকর ভাবনা। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, সেটাকে ভারত একটি নতুন মাত্রা দিতে চাইছে বলেই পররাষ্ট্র সচিবের এই ঝটিকা সফর। আগামী বছর মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে এই সম্পর্ক আরও জোরালো হবেই বিশ্লেষকরা আশা করছেন। 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক