দিনাজপুরে অপরিকল্পিত চালকলে হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

প্রকাশ | ২৭ আগস্ট ২০২০, ১৬:৪০

শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর

দিনাজপুরের ১৩টি উপজেলায় প্রায় দুই হাজার চালকল রয়েছে। এর মধ্যে অটোরাইস মিল ও হট ফ্লু মিল প্রায় দুইশটি। এছাড়া বাকিগুলো মেজর মিল ও হাসকিং মিল। এসব মিল ও চাতালের বিষাক্ত ধোঁয়া, ছাই, তুষ, ধুলো-ময়লা উড়ে ব্যাপকভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। জলাশয় ও নদীতে কালো পানি ও ছাই দূষণের ফলে মাছ মরে যাচ্ছে। এর ফলে হুমকিতে জনস্বাস্থ্য।

তাই যত্রতত্র গড়ে ওঠা অপরিকল্পিত এসব অটোরাইস মিল ও চাতালের দূষণ থেকে রক্ষা পেতে আন্দোলনে নেমেছে জেলার সাধারণ মানুষ।

তাদের অভিযোগ, এসব অটোরাইস মিল ও চাতালের বিষাক্ত ধোঁয়া, বর্জ্য, তুষ-ছাই উড়ে আবাসিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। ধোঁয়া ও ছাই উড়ে রাস্তা-ঘাট, বসতবাড়ি অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। এতে রাস্তা দিয়ে মানুষের চলাচল অযোগ্য হয়ে পড়েছে। চোখের রোগ, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এলাকার মানুষ। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে গাছ-পালা ও পুকুরগুলো।

এর প্রতিবাদে ভুক্তভোগী এলাকাবাসী বিক্ষোভ-মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও নেই কোন প্রতিকার। এদিকে নতুন নতুন আরো মিল-চাতাল গড়ে উঠছে। এনিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন এলাকাবাসী।

জানা গেছে, দিনাজপুর সদর, বীরগঞ্জ ও বোচাগঞ্জ উপজেলায় সব চেয়ে বেশি চালকল রয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে।

সদর উপজেলার মাঝিপাড়া এলাকার গৃহবধূ জান্নাতুন বেগম জানান, রান্না-বান্না করার সময় হাড়িতে ও খাওয়ার সময়ও ভাত বাড়া থালায় পড়ে এসব মিলের ছাঁই।

একই এলাকার মোবাররক হোসেনের অভিযোগ, পিরিকল্পিত এসব মিলের ধুলো-ময়লার ও বর্জ্যের প্রভাবে তার পুকুরের মাছ নষ্ট হয়ে গেছে। গাছগুলোও মরে যাচ্ছে। যেগুলো আছে, ফল ধরছেন না আগের মতো। এছাড়া প্রতিনিয়ত এলাকার লোকজনকে চোখের ডাক্তারের কাছে ছুঁটতে হচ্ছে। আর চর্মরোগ তো লেগেই আছে এলাকায়।

অটোরাইস মিলগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, বেশিরভাগ মিলেই চিমনী নেই। ফলে মিলের ছাই-ময়লা উড়ে আশপাশের বাড়ি-ঘর যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি পথচারিদের চোখ নষ্ট হচ্ছে। সেইসঙ্গে ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। সব মিলিয়ে চরম ভোগান্তিতে রয়েছে এলাকার মানুষ। প্রতিনিত চোখে ছাই ও তুষ পড়ায় অনেককে হাসপাতালেও যেতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে উদ্ভিদবিদ মোসাদ্দেক হোসেন জানান, ক্রমাগত বিষাক্ত ছাই ও কালো ধোঁয়া বাতাসে উড়তে থাকলে বাতাস ও জমিতে ক্ষারের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, আর অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। এতে উদ্ভিদের চরম ক্ষতি হয়। ফুল ও ফল উৎপাদনে বাঁধাগ্রস্থ হয়। জমির পুষ্টি উৎপাদন হ্রাস পায় এবং এক সময়ে মাছ-পশু পাখি মারা যায়।

দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কেবিএম কলেজের অধ্যক্ষ জিয়াউল হুদার অভিযোগ, অপরিকল্পিত অটোরাইস মিল-চাতালের ধোঁয়া-ময়লার জন্য ক্লাস নেওয়া থেকে শুরু করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পড়তে হচ্ছে চরম ভোগান্তিতে।

এ বিষয়ে দিনাজপুর চালকল মালিক গ্রুপের সভাপতি মোসাদ্দেক হুসাইন বলেন, ‘অটোরাইস মিলের পাশাপাশি ধান সিদ্ধ-শুকানোসহ নানা প্রক্রিয়ার জন্য বয়লার, চাতালও রয়েছে তিন সহস্রাধিক। সেখানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৫ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয়। এখানকার উৎপাদিত চালের ব্যাপক চাহিদা থাকায় দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাইরেও রপ্তানি করা হয়। দেশের উন্নয়নের জন্য শিল্পায়নের  প্রয়োজন রয়েছে। তবে এ শিল্পায়ন এলাকায় যেমন বসতবাড়ি গড়ে উঠেছে, তেমনি শিল্পায়নের নিদির্ষ্ট কোন জায়গা না থাকায় সুবিধা মতো গঠে উঠছে এসব চালকল। তবে,আমরা এখন পরিবেশের বিষয়টি মাথায় রেখে চালকল গড়ে তুলছি।’

এদিকে অভিযুক্ত এক চালকল মালিক অহিদুল ইসলাম জানান, এলাকাবাসীর আন্দোলন অযৌক্তিক। তার নির্মাণাধীন চালকলটি অধুনিকায়ন। তার এই মিল দ্বারা কোনো প্রকার বায়ু এবং পানি দূষণ হবেনা।

দিনাজপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, জেলার বেশকিছু চালকলের বর্জ্য, ধোঁয়া, তুষ ও ছাই পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। ওইসব চালকল বন্ধের জন্য তিনি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন।

তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত হস্তক্ষেপ নেবেন, এমনটাই প্রত্যাশা করছেন পরিবেশবিদ ও ভুক্তভোগি সাধারণ মানুষ।

(ঢাকাটাইমস/২৭আগস্ট/পিএল)