বঙ্গবন্ধু হত্যা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও সংবিধান লঙ্ঘন প্রসঙ্গ

শ ম রেজাউল করিম
 | প্রকাশিত : ৩০ আগস্ট ২০২০, ০৮:৫৪

১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। আত্মস্বীকৃত খুনিরা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করেন যে “ক্ষমতা থেকে বঙ্গবন্ধুকে সরানোই ছিল তাদের লক্ষ্য। কিন্তু, তিনি এমন যোগ্যতা সম্পন্ন ছিলেন যে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে পরিবেশ পাল্টে দিতে সক্ষম ছিলেন, সে কারণে তাকে হত্যা করা ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না।”

তাদের এই বক্তব্য কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। কারণ, ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতাচ্যুত করার সঙ্গে তার শিশু পুত্র রাসেল, পরিবারের নারী সদস্য ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের কেন হত্যা করা হয়েছিল? কেন ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল? বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাষ্ট্রপতি, তাকে হত্যার পরে নিয়ম অনুসারে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন। তিনি না থাকলে জাতীয় সংসদের স্পিকার আব্দুল মালেক উকিল দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন। কিন্তু, কোন যুক্তিতে বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক আহম্মেদ রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হলেন? কেনই বা বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক ঘন্টার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান সরকার খুনি মোস্তাক সরকারকে স্বীকৃতি দিলেন? বঙ্গবন্ধুর জানাজা ও লাশ দাফনের সময়ে মধ্য প্রাচ্যের একটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলো? বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারী আরো কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে কেন স্বীকৃতি দেয়? তাহলে কি তারা অপেক্ষা করছিল যে, বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাবস্থায় এদেশকে তারা স্বীকৃতি দেবেন না? পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির আহবায়ক চরম স্বাধীনতা বিরোধী গোলাম আযমকে কেন পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসার সুযোগ করে দেয়া হয়? স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক শাহ আজিজ, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, খান এ সবুর, মাওলানা আব্দুল মান্নান, আব্দুল আলিমসহ অনেককেই পুনর্বাসিত হয় রাজনীতিতে এবং সরকারে, কি কারণে? মুক্তিযুদ্ধের প্রাণসঞ্চারী জয় বাংলা শ্লোগানের পরিবর্তে পাকিস্তান স্টাইলে “জিন্দাবাদ” আমদানি করা হলো? কার্যতঃ বাংলাদেশ পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়া হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সম্পূর্ণরূপে ভুলুন্ঠিত করা হয়। তাহলে কি এটা স্পষ্ট নয় যে, ১৯৭১ সনের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই স্বাধীনতাবিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র পরস্পর যোগসাজসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল? ঘটনার পরম্পরা বিশ্লেষণ করলে সমীকরণে তা-ই প্রতিভাত হয়।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম টুঙ্গিপাড়ায়। শৈশব থেকেই ন্যায়ের পক্ষে দ্রোহের লক্ষণ দেখা যায় তার মাঝে। ১৯৩৮ সালে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের স্কুল পরিদর্শনে এলে তার সাথে পরিচয় হয়। ১৯৩৯ সালে অতি অল্প বয়সে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা করার দুঃসাহস দেখালে প্রথম গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহকারী নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে বিএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায় সঙ্গত দাবি সমর্থন করলে তাকে বহিষ্কার করা হয়। মুচলেকা দিয়ে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবের প্রতিবাদ জানান এবং ১১ মার্চ বাংলা ভাষার দাবিতে ধর্মঘট করলে গ্রেপ্তার হন।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন কারাগারে থাকাবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। কারাগারে থাকাবস্থায় ১৯৫২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কারাগারে অনশন শুরু করেন। শহীদ, বরকত, রফিকদের হত্যার প্রতিবাদে তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়াসহ তিন দিনের অনশনের এক পর্যায়ে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৫৩ সালের ১৬ নভেম্বর প্রদেশিক আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। যুক্তফ্রন্ট ১০ মার্চের নির্বাচনে ২৩৭টির মধ্যে ২২৩টি আসনে বিজয়ী হয়। বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৪ সালের ১৪ মে সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু, ৩০ মে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল করেন এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করেন।

১৯৫৫ সালের ৫ জুন পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ১৭ জুন পল্টন জনসভায় তিনিই সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি করেন। দলটিকে সকল ধর্মের জন্য উপযোগী করতে ১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর মুসলিম শব্দ বাদ দেন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর ইস্কান্দার মীর্জা সামরিক শাসন জারি করেন এবং ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। কয়েকদফা গ্রেপ্তার ও মুক্তির শেষ পর্যায়ে ১৯৬২ সালের ২ জুন সামরিক শাসনের অবসান হলে ১৮ জুন কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।

১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আওয়ামী লীগকে পুনর্জীবিত করা হয় এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী কমিটি গঠন করেন। ২৬ জুলাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠন করা হয় সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ)। ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন করলে নির্বাচনের ১৪ দিন আগে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করতে পারেন যে, সায়ত্বশাসন, স্বাধিকার ও চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যেই এগোতে হবে। তাই তিনি গোটা জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেন মুক্তির মন্ত্রে। ১৯৬৬ সালে ৩ মাসে ৮ বার গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৮ সালে ৩ জানুয়ারি দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। আদালতের মাধ্যমে সাজানো রায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিঃশেষ করা-ই ছিল লক্ষ্য।

২৮ জানুয়ারি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আদালতে লিখিত বিবৃতি দেন। তার মুক্তির দাবিতে ছাত্র সমাজের ১১ দফা কার্যতঃ আন্দোলনের বিষবাস্প ছড়িয়ে দেয়। ১৯৬৯ সালের ৩০ জানুয়ারি প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন তিনি। ইতোমধ্যে সার্জেন্ট জহুরুল হককে নির্মমভাবে হত্যা করা হলে পরিস্থিতি গণঅভ্যুত্থানে রুপ নেয়, অসহায় পাকিস্তানি সরকার বাধ্য হয়ে মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১০ মার্চ আইয়ুবের গোলটেবিলে ৬ দফা দাবির প্রশ্নে দৃঢ় অবস্থান নেন তিনি, বৈঠক ব্যর্থ হয়। ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন জেনারেল আইয়ুব খান। ২৮ নভেম্বর এক ভাষণে ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও বছর শেষে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। আওয়ামী লীগকে নৌকা প্রতীক দেয়া হয়।

১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর বেতার ও টেলিভিশনে নির্বাচনে ভাষণ দিয়ে গোটা জাতির সামনে মুক্তির ম্যান্ডেট উপস্থাপন করে বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে “সোনার বাংলা শ্মশান কেন” নামের পোস্টার প্রকাশ করেন, যা বাঙ্গালি জাতিকে জাগ্রত করে তোলে। ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ১৬৭ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করে এবং প্রদেশিক পরিষদে ২৯৮টি আসন লাভ করে ১৭ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সনের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যরা “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি------” গান গেয়ে ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের শপথ নেন এবং জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান দিয়ে মুক্তির সংকল্প ব্যক্ত করেন।

১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সাথে তিন দফা বৈঠক করে বঙ্গবন্ধুকে “পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী” সম্বোধন করেন। ২৭ জানুয়ারি জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে কয়েকদফা বৈঠক করে অযৌক্তিক দাবি উত্থাপন করায় ওই বৈঠক ব্যর্থ হয়। ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করা হয় ১৩ ফেব্রুয়ারির একটি সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে। হঠাৎ করে অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে পাকিস্তানি সরকার। ২ মার্চ ঢাকায় হরতাল পালিত হয়। সরকার কারফিউ জারি করে এবং গুলিতে ৩ নিহত ও ৬০ জন আহত হয়। অসীম দূরদর্শী শেখ মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানিদের কুমতলব। তাই গোটা জাতিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন ৭ মার্চ।

ইয়াহিয়া খান ১৬ মার্চ বিস্ফোরণমুখী বাংলাদেশে এসে বঙ্গবন্ধুকে বৈঠকে ডাকেন। কালো পতাকা নিয়ে বৈঠকে যান তিনি। ২৩ মার্চ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। সব-ই ছিল বঙ্গবন্ধু সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত। ২৫ মার্চ বর্বোরোচিত গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি জান্তা। ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানে, দেয়া হয় মৃত্যুদণ্ড।

এদিকে ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ গঠন এবং বঙ্গবন্ধুকে করা হয় রাষ্ট্রপতি। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। উল্লেখ্য ১১ নভেম্বর ইয়াহিয়া ও ভুট্টো কারাগারে দেখা করতে এলে বঙ্গবন্ধু করমর্দনের হাত ফিরিয়ে দেন। ২ ডিসেম্বর কারাগারে ইয়াহিয়া সমঝোতার প্রস্তাব দিলে বঙ্গবন্ধু তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন। ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ৮ জানুয়ারি মুক্তি পেয়ে লন্ডন ও ভারত হয়ে ১০ জানুয়ারি স্বাধীন স্বদেশে ফিরে আসেন বিজয়ের মহানায়ক। এভাবেই তিনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নেয় আমেরিকা, চীনসহ অন্য কয়েকটি দেশ। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও রাশিয়া আমাদের পাশে দাঁড়ায়। যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি যারা মেনে নিতে পারেনি, তারা দেশকে অস্থিতিশীল করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য সু-পরিকল্পিতভাবে এগোতে থাকে।

উল্লেখ্য, ১৯৬৯ সালের ২০ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু জানতে পান, তাকে হত্যার জন্য আততায়ী পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি তিনি মার্কিন কনস্যুলেটের ডেপুটি চিফ সিডনি সোবারকে জানান। যা, ২৯ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দপ্তরকে অবহিত করা হয়। ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ওই পরিকল্পনা সফল হয়নি।

১৯৭২ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে কর্নেল ফারুক মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে অস্ত্র ক্রয়ের প্রস্তাব দেন। ১৯৭৩ সালের ১১ জুলাই কর্ণেল রশিদ মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে জানান যে, ব্রিগেডিয়ার জিয়ার নেতৃত্বে একটি কমিটির পক্ষ থেকে তাকে অস্ত্র ক্রয়ের প্রস্তাব নিয়ে পাঠানো হয়েছে। ১২ জুলাই কর্নেল ফারুক একইরূপ প্রস্তাব নিয়ে যান। ১৯৭৪ সালে ১৩ মে কর্নেল ফারুক গং মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাতে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সাহায্য চান। সেখানে উল্লেখ করেন, উচ্চতম পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাদের নির্দেশেই .......। ১৯৭৫ সনের ২০ মার্চ আর্মড রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন কমান্ড সৈয়দ ফারুক রহমান জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করে বঙ্গবন্ধুর সরকার উচ্ছেদের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ করেন।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের এক সপ্তাহ পূর্বে সিআই-এর স্টেশন চিফ চ্যারির সঙ্গে জিয়াউর রহমানের বৈঠক হয় এক ব্যবসায়ীর বাসায়। এছাড়া কুমিল্লার বার্ডসহ বিভিন্ন স্থানে বার বার ষড়যন্ত্রের বৈঠক হয়। ক্যান্টনমেন্টে উসকানিমূলক লিফলেট বিতরণ ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা দিয়ে সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা চলে। ভারতের হাই কমিশনারের গাড়িতে হামলা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও, গুপ্ত হত্যার মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। বঙ্গবন্ধু কখনোই বিশ্বাস করতে পারেননি যে, তার সৃষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশে নিজ বাড়িতে তিনি নিরাপদ নন। তিনি বঙ্গভবনে থাকেননি, নিরাপত্তার কোন কঠোর প্রটোকল নিতেন না। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হয়।

৯ দিনের মধ্যেই জিয়াউর রহমান হয়ে যান সেনাপ্রধান। বঙ্গবন্ধুকে উচ্ছেদ তথা খুনের পরিকল্পনাকারীরা তার কাছে ২০ মার্চ গেলেও তিনি তাদের গ্রেপ্তার বা নিবৃত করেননি। বরং সুকৌশলে এগিয়ে যেতে হুকুম দেন। সেনা কর্মকর্তা হিসাবে শপথ নিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি ও সংবিধানকে জীবনের বিনিময়ে হলেও রক্ষা করার, কিন্তু, করলেন তার বিপরীতটা। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে বললেন “প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড, সো ওয়াট? ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার”। অতি ভোরে তিনি ক্লিন সেভ হয়ে ইউনিফর্মড অবস্থায় অপেক্ষা করছিলেন। বিশ্লেষকদের মতে, তিনি সবই জানতেন, চূড়ান্ত খবর ও পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। খুনিদেরকে বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে নিরাপদে দেশের বাইরে পাঠানোর মূখ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১২টি রাষ্ট্রের দূতাবাসে তাদেরকে চাকরি দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে পদোন্নতিও দেওয়া হয়।

১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল তিনি আবু সাদাত মো. সায়েমকে পিস্তল টেকিয়ে পদত্যাগ করিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ দখল করেন। তিনি সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা হয়েও সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে নিজেকে রাষ্ট্রপতি দাবি করে “হ্যাঁ-না” ভোটের প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার অপকৌশল নেন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর গঠন করেন বিএনপি।

১৯৭৫ এর ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করা হলেও সংবিধানকে স্থগিত করা হয়নি। সেক্ষেত্রে সামরিক শাসন জারি, মোস্তাকের ক্ষমতা গ্রহণ, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল কোন কিছুরই আইনগত কোন ভিত্তি ছিল না। এমনকি খন্দকার মোস্তাক নিজেও সামরিক শাসন জারির ঘোষণা দেননি রাষ্ট্রপতি হিসাবে ক্ষমতা দখল করে। তাহলে কিভাবে এলো সামরিক শাসন, কে জারি করল?

বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত সংঘঠিত সকল অপকর্মকে বৈধতা দিতে ১৯৭৯ সালের পার্লামেন্টে ইমডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইনে রুপান্তরিত করতে এবং সংবিধানের অংশে পরিণত করতে বিল আনা হয়। আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানানো স্বত্বেও পাস করা হয় ইতিহাসের জঘন্যতম ওই আইন। ৯ এপ্রিল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসাবে স্বাক্ষর করেন ওই আইনে। রুদ্ধ হয়ে হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও অবৈধ ক্ষমতা দখলকে চ্যালেঞ্জ করার আইনি সুযোগ।

১৯৮১ সালে ১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে “বঙ্গবন্ধু ভবনে” ঢুকতে গেলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশায় কখনোই তিনি ওই বাড়িতে যেতে পারেননি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া করতে বাধ্য হয়েছেন। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন সরকার গঠন করে ১২ নভেম্বর ইনডেমনিটি আইন বাতিল করেন। তার বিরুদ্ধে কর্নেল ফারুক ও সুলতান শাহরিয়ার রশিদ হাইকোর্টে রিট দায়ের করে, যা ১৯৯৭ সালে ২৮ জানুয়ারি খারিজ হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করে যা, ১৯৯৮ সালের ১৯ এপ্রিল খারিজ হয়। শুরু হয় বিচার কার্যক্রম। বিচার আদালত ১৫ জন খুনিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। হাইকোর্টে আপিল হলে বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ও বিচারপতি খায়রুল হক দ্বিধা বিভক্ত রায় দেন। তৃতীয় বিচারক ফজলুল করিম ১২ জনের ফাঁসি বহাল রাখেন, যা আপিল বিভাগেও বহাল হয়। আসামিপক্ষ পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করলেও একই রায় বহাল থাকে। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি ৫ খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। উল্লেখ্য যে, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বার বার বলা স্বত্বেও বিএনপি সরকার আপিল বিভাগে একজন বিচারপতি নিয়োগ না দেওয়ায় ঝুঁলে তাকে আপিল। শেখ হাসিনা পুনরায় ক্ষমতায় এসে বিচার বিভাগের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখায় আপিল নিষ্পত্তি হয়। জাতিকে অপেক্ষা করতে হয় জনকের হত্যার বিচারের জন্য ৩৫ বছর।

পর্দার আড়ালে থেকে জিয়াউর রহমান-ই করেছেন সকল ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা, প্রতিদানে খুনের পরে তিনিই হয়েছেন সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি। বঙ্গবন্ধু কন্যাদের আবেদনে লন্ডনে গঠিত হয়েছিল বিখ্যাত আইনজীবী জেফরি টমাস ইউলিয়াম কিউসি ও সলিসিটর এ্যাব্রো রোজ এর নেতৃত্বে একটি কমিশন। তারা বাংলাদেশে আসতে চাইলে জিয়াউর রহমান সরকার তাদের ভিসা দিতে অস্বীকার করে। ১৯৮৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর হাউজ অব কমন্সে তারা একটি বৈঠক করে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে প্রাথমিক রিপোর্ট দেন। যাতে জিয়াউর রহমানকে অভিযুক্ত করা হয়। জাতীয় চার নেতা হত্যা ও অপরাপর বিষয়ে তদন্তের জন্য গঠিত হয়েছিল বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরী, বিচারপতি কে.এম. সোবহান ও বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন-এর সমন্বয়ে একটি কমিশন। ওই কমিশনকেও কাজ করতে দেওয়া হয়নি।

প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেঞ্জ লিফশ্যুলজ তার অনুসন্ধানী তথ্য উপস্থাপন করেন কর্নেল তাহের হত্যা মামলায় হাইকোর্টে এবং বিভিন্ন সাময়িকীতে দেয়া তথ্যে স্পষ্টভাবে বলেন যে, জিয়াউর রহমানের পৃষ্টপোষকতা ও সম্পৃক্ততা ছাড়া এই হত্যাকাণ্ড কোনভাবেই সম্ভব ছিলনা। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল ফারুক ও রশিদ লন্ডন টিভি, স্যাটারডে পোস্ট, লন্ডন সানডে টাইমসসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্বাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততার কথা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন। ফৌজদারি অপরাধ বিজ্ঞানের নীতিমালা অনুযায়ী, জিয়াউর রহমানকে কোনভাবেই নির্দোষ ভাবার সুযোগ নেই, বরং খুনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা প্রত্যক্ষ ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যতে প্রমাণিত হয়। খুনিদের এগিয়ে যাবার অনুমতি দিয়ে তিনি এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড সংঘঠনে “কমান্ড” দিয়েছেন। তার দায়িত্ব ছিল পরিকল্পনার বিষয় জেনেই তাদেরকে গ্রেপ্তার তথা নিবৃত করা, তা না করে এগিয়ে যেতে বলেছিলেন।

রাষ্ট্রপতির হত্যার খবর পেয়ে “প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড, সো ওয়াট? ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার” বলার মধ্য দিয়ে ঘটনার বিষয়ে মেনে নেওয়া তথা একমত হওয়ার পরিচয় মেলে। বঙ্গবন্ধু খুনের ৯ দিনের মধ্যে তিনি সেনা প্রধান হয়ে যান এবং ধারাবাহিকতায় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, অতঃপর রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দখল করেন। খুনিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আমলে না এসে নির্বিঘ্নে বিদেশে পাঠানো, ১২ জনকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া, আর্থিকভাবে সহায়তা করা এবং চূড়ান্তভাবে তার স্বাক্ষরেই ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল আইন পাস করে খুনিদের বিচারের পথ বন্ধ করে তিনি ঘটনার পূর্বে এবং পরে কৃতকর্মের মধ্য দিয়ে নিজের অংশ গ্রহণ ও সুবিধা ভোগের (বেনিফিশিয়ারি) মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি-ই নাটের গুরু তথা ঘটনার মূল ঘটক।

বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি ধ্বংস করা হয়েছিল। খুনিদের বিচার না করে দায়মুক্তি দিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি সৃষ্টি করা হয়েছিল। তার ধারাবাহিকতায় একের পর এক অনেক হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হয়। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে ক্যান্টনমেন্টে নির্বিচারে হত্যা করা হয় অনেক মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের। খুনিদের পুরস্কৃত করা জিয়াউর রহমান নিজেও হত্যাকাণ্ডের নির্মম শিকার হন। বঙ্গবন্ধুকন্যা রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে জাতির জনকের খুনিদের, জেল হত্যার খুনিদের, যুদ্ধাপরাধীদের, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদেরসহ সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার করে প্রমাণ করেছেন যে, কেউ-ই আইনের উর্দ্ধে নয়। অপরাধীদের দাম্ভিকতা চূর্ণ করে দিয়ে আইনের শাসন ফিরিয়ে এনেছেন। কিন্তু, অবাক বিস্ময়ে লক্ষণীয়, জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাবস্থায়ই জিয়াউর রহমানের হত্যা মামলার অপমৃত্যু হলা। তাহলে প্রশ্ন জাগে, তিনি কি ক্ষমতার স্বার্থেই নিজ স্বামী হত্যাকারীদের সঙ্গে কৌশলগত আপোষ করে নিলেন? এভাবেই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি ধ্বংস হয়, ক্ষমতায় আসে অবৈধ ব্যক্তিরা এবং খুনিদের দেয়া হয়েছিল প্রশ্রয়।

বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী ও সপ্তম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণকে অবৈধ, বেআইনি এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ বলে রায় দেন। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারিদের কৃত সকল কর্মকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। একইভাবে জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ক্ষমতা দখলকে অবৈধ ঘোষণা করে। এভাবেই উত্তোরণ হয় গণতন্ত্রের অভিযাত্রার। প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের শাসন ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা, যার কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার। তিনিও অন্তত ১৯ বার জীবননাশের আক্রোমণের মুখোমুখি হন। সর্বশেষ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। তৎকালীন সরকার সরাসরি অংশ নেয় এই নারকীয় গ্রেনেড হামলায়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের উৎসাহিত করা, পৃষ্টপোষকতা দেওয়া এবং খুন পরবর্তী দায়মুক্তি দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। একই ধারাবাহিকতায় ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, ডিজিএফআই-এর প্রধান, এনএসআই-এর প্রধান, পুলিশ প্রধানসহ সরকার ব্যবস্থাই জড়িত ছিল। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মতই ২১ আগস্টের খুনিদের পরিত্রাণ দিতে জজ মিয়া কাহিনির মত নিকৃষ্ট আষাঢ়ে গল্প সৃষ্টি করেছিল খালেদা জিয়া সরকার। এভাবেই বাংলাদেশে খুনের রাজনীতি ও সাংবিধানিক রাজনীতি ধ্বংসের ভয়াল খেলায় মেতে উঠে স্বাধীনতা বিরোধী ও ক্ষমতা লিপ্সু দেশি ও আন্তর্জাতিক মহল।

লেখক: মন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :