ক্ষমা চাইতে হয় বিবেকের নির্দেশে কারো আদেশে নয়...

শহীদুল্লাহ ফরায়জী
 | প্রকাশিত : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৯:৫৮

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আদালত অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত করেছিল আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণকে। শাস্তি ঘোষণার আগে বিচারপতিরগণ তাকে ক্ষমা চাইতে বললেও তিনি রাজি হননি। ক্ষমা চেয়ে নির্দোষ হওয়ার প্রলোভনে প্রশান্ত ভূষণের বিবেক সায় দেয়নি। বরং প্রশান্ত ভূষণের আইনজীবী বলেছেন ক্ষমা চাইতে বলাটা আদালতের জবরদস্তি। আদালত তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে অভিযোগ থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ দিয়েছিল কিন্তু তাতেও রাজি না হয়ে বরং জানিয়ে দেন আদালতের দেয়া শাস্তিই তিনি মেনে নেবেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন ক্ষমা চাইতে হয় বিবেকের নির্দেশে কারো আদেশে নয়।

প্রশান্ত ভূষণের যুক্তি ছিল মত প্রকাশের স্বাধীনতা তার মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। সে অধিকার থেকেই টুইটারে নিজস্ব মতামত জানিয়েছেন।

ভারতের প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদে প্রবীণ আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের টুইটে অপমানিত হয়েছেন সেজন্য আদালত অবমাননার মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। ১৪ আগস্ট দোষী সাব্যস্ত করার পর ৩১ আগস্ট শাস্তি ঘোষণা করে উচ্চতর আদালত।

এক টাকা জরিমানা দিতে হবে। ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মিটাতে হবে জরিমানার টাকা। না দিলে তিন মাসের জেল হবে আইনজীবীর। পাশাপাশি তিন বছর আইনজীবী হিসেবে মামলায় লড়তে পারবেন না।

সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়ার পরেই সাংবাদিকদের বৈঠকে একটি এক টাকার মুদ্রা হাতে ধরে ছবি তোলেন প্রশান্ত ভূষণ এবং জানান 'রায়কে সম্মান জানিয়ে আমি তা পালন করব'। তবে তার সঙ্গে উল্লেখ করেন যে 'রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি জানানোর অধিকার তিনি নিজের কাছেই রাখছেন'। এক টাকা হাতে নিয়ে হাসিমুখে তোলা দুটো ছবি টুইটও করেন প্রশান্ত ভূষণ। সঙ্গে লেখেন 'রায় ঘোষণার পরই আমার সিনিয়র সহকর্মী ও আমার আইনজীবী রাজিব ধবন এই টাকাটি আমাকে দিয়েছেন। কৃতজ্ঞচিত্তে আমি তা গ্রহণ করেছি। রায় প্রদানের পর প্রশান্ত ভূষণ বিবৃতিতে বলেন 'আমি বরাবর বিশ্বাস করে এসেছি সুপ্রিমকোর্ট দুর্বল ও নিপীড়িতদের আশার শেষ দুর্গ। আমি টুইটগুলোতে আদৌ বিচার ব্যবস্থাকে আঘাত করতে চাইনি । সেই উজ্জ্বল ঐতিহ্য থেকে তার বিচ্যুতি দেখে নিজের ক্ষোভ জানিয়েছি। আদালত দুর্বল হয়ে পড়লে তাতে দেশ দুর্বল হয়। ক্ষতি হয় মানুষের।

প্রশান্ত ভূষণের মামলার রায়ের পর প্রশান্ত ভূষণের মন্তব্য খুবই প্রণীধানযোগ্য। তিনি বলেছেন' রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি জানানোর অধিকার নিজের কাছেই রাখছেন'। এতে বোঝা যায় এ রায়ে তিনি বিচলিত বোধ করছেন। রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি পেশ করার উৎসাহ তিনি হারিয়ে ফেলছেন। মানুষের ভেতরের গণতান্ত্রিক উপাদানকে আরো এগিয়ে দেবার প্রশ্নে রাষ্ট্র সচেষ্ট থাকার কথা কিন্তু উপনিবেশিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ব্যক্তির নিজস্বতা বহুমুখিতাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়, ব্যক্তির আত্মমর্যাদাবোধে হানা দেয়, ব্যক্তির সৃজনশীল বিকাশে হস্তক্ষেপ করে। মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান, আত্মরক্ষামূলক নৈতিক মানদন্ড ও রাষ্ট্রীয় সুশাসনের জন্য যুগে যুগে জীবন বলিদান করেছে। ন্যায় বিচার হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য আবশ্যিক শর্ত। কোন ব্যক্তির আত্মমর্যাদা ধ্বংস করা রাষ্ট্রের এখতিয়ার বহির্ভূত। ন্যায়ের বিকৃতি বা ভীরুতা আর আত্মস্বার্থ রক্ষার্থে অন্যকে বলি দেওয়া গহির্ত অপরাধ। ন্যায়বিচার ছাড়া, গণতন্ত্র ছাড়া, সুশাসন ছাড়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলো চোরাবালির উপর অট্টালিকা স্থাপন করা। মানুষের আত্মমর্যাদা যেন ক্ষমতার বলয়ে বিলীন করে দেয়া না হয়। উপনিবেশিক ধ্যান ধারণার কারণে আভ্যন্তরীণ দিক থেকে এখনও আমরা স্বাধীন নই। ক্ষমতার অপব্যবহারকেই এখনও আমরা স্বাধীনতা মনে করি। নীতিবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়ে কর্তব্যকাজ সম্পাদনে আগ্রহী নই। কর্তব্য সম্পাদনে 'ethical', juridical' and 'moral'এর অপরিহার্য তাৎপর্য আমরা প্রতিনিয়ত উপেক্ষা করে যাচ্ছি।

আমরা অনেকেই এখনো নৈতিক জীবনের গৌরব অনুভব করতে পারিনি। আদালত অবমাননার মামলা উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলোর উপর বেশ প্রভাব পড়েছে। আদালত অবমাননা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে ব্যাপকভাবে। আদালত অবমাননা আইন অসাংবিধানিক। ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থী বলে শীর্ষ আদালতে মামলা দায়ের করেছেন আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ সহ তিনজন। তাদের বক্তব্য আদালত অবমাননা আসলে মত প্রকাশের মৌলিক অধিকারকে আঘাত করে। আদালতের সমালোচনাকে যদি অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয় তবে তা স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, কাজেই এই আইন বাতিল করা হোক। আদালতের আদেশ নির্দেশ, আদালতের কর্তৃত্ব এবং আদালতের মর্যাদা অবমাননা করাকে আদালত অবমাননা বলা হয়। আদালত চলাকালে ইচ্ছাকৃতভাবে অবমাননাকর উক্তি বা বিঘ্ন সৃষ্টি করলে, আদালতের আদেশ অমান্য করলে এবং আদালতের বাইরে মর্যাদা বিনষ্ট করলে এই তিন ধরনের ক্ষেত্রে আদালত অবমাননার বিষয় জড়িত।

আদালত অবমাননা ব্যতিক্রমধর্মী আইন। বিচারের সর্বজন স্বীকৃত সাধারণ নীতি হলো অভিযোগকারী অভিযুক্তের বিচার করতে পারেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া যায়না। কিন্তু আদালত অবমাননা আইনে নিজেই সংক্ষুদ্ধ হিসেবে অভিযোগকারী হয়ে নিজেই অভিযোগের বিচারও করতে পারেন। অপরাধের নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে কিন্তু আদালত অবমাননার কোন সংজ্ঞা নেই। ফলে অপরাধ নির্ধারণের কোন স্বীকৃত নীতি গড়ে ওঠেনি।

উপমহাদেশে আদালত অবমাননার যে আইনটি কার্যকর আছে ব্রিটিশরা তা ১৯২৬ সালে জারি করেছিল। আদালত অবমাননা শাস্তিযোগ্য। আদালত অবমাননাকারীকে অনধিক ৬ মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা দুই হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত। ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশিক বিচার ব্যবস্থাকে জনগণের সমালোচনা থেকে রক্ষা করার জন্য এসব আইন প্রণয়ন করেছিল। ব্রিটিশদের আইনের উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে অনুগত ও পদানত রাখা, শাসিতকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। বিদেশি প্রভুর পরিবর্তে দেশীয় প্রভুর আবির্ভাবের নাম স্বাধীনতা নয়।

ভারত-বাংলাদেশ সে উত্তরাধিকারের দূর্বিষহ বোঝা বহন করে চলছে। বাংলাদেশের মানুষ চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য অনেক বেশি মূল্য দিয়েছে।

বিশ্বের উন্নত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আদালত অবমাননা সংজ্ঞায়িত হওয়ায় লেখক প্রকাশক আইনজীবী কাউকে কোন ধরনের হয়রানির কারণ হতে দেখা যায় না।

রাজতন্ত্রে রাজা রানী রাজপরিবারের প্রাথমিক সদস্যদের সমালোচনা করাও ফৌজদারি অপরাধ। আমরা সৌভাগ্যবান প্রজাতন্ত্রের নাগরিক। রাজতন্ত্রে বিচারকরা হলেন রাজা রানীর প্রতিনিধি। আর প্রজাতন্ত্রে বিচারপতিরা হলেন জনগণের কর্মচারী মাত্র। যারা রাষ্ট্রপতি দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত এবং প্রজাতন্ত্রের প্রচলিত আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

প্রজাতন্ত্রে সবাই জনগণের কর্মচারী। শাসনবিভাগ আইনবিভাগ এবং বিচার বিভাগ সবাই রাষ্ট্রের তথা জনগণের কর্মচারী। এ তিনটি স্তম্ভের আলোচনা সমালোচনা করা রাষ্ট্রের জনগণের মৌলিক অধিকার। সমালোচনা করার অধিকার মানেই যা ইচ্ছা তা নয় কেননা এতে অন্য নাগরিকের মৌলিক অধিকার খর্ব হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অবশ্যই গঠনমূলক সমালোচনার অধিকার সবার থাকতে হবে। সমালোচনার উর্ধ্বে কেউ নয়।

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সমালোচনা, সামাজিক প্রেক্ষাপটে এবং রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে দু'ভাবে হতে পারে। এ দুটোর ক্ষেত্রেই সমালোচনা করার অধিকার জনগণ দুই ভাবে সংরক্ষণ করেন।

১. ব্যক্তি নাগরিক হিসাবে সমালোচনার অধিকার

২. ভোটার এবং করদাতা হিসেবে সমালোচনার অধিকার। কারণ জনগণ রাষ্ট্রের মালিকানা সংরক্ষণ করেন।

'সমালোচনা' এবং 'অবমাননা: দুটি ভিন্ন ব্যাপার। সমালোচনা করা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার এবং অবমাননা ভিন্ন ব্যাপার।

একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতির সমালোচনা করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের আছে। একজন লাইসেন্সধারী দেহপসারিণীকেও অপমান করার অধিকার রাষ্ট্রের কারও নেই, যেমন নেই রাষ্ট্রপতি বা বিচারপতিকে অপমান করার অধিকার। আমরা ভুলে যাই কর্তব্যরত পুলিশকে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠ বস করালে সমগ্র মানব জাতিকে অপমান করা হয়। আমরা বিচারের আগেই কাউকে যেন শাস্তি না দেই।

আমাদের প্রজাতন্ত্রের সাথে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক যে সমস্ত উপনিবেশিক আইন আছে তাকে অবশ্যই বদলাতে হবে। রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের সমঝোতায় গণতন্ত্র, জনগণের অধিকার যেন ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত না হয়।

আমরা যেন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এক করে না ফেলি। ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুই এর চেতনা 'আমিই রাষ্ট্র' 'আমিই প্রতিষ্ঠান'

এ ধরনের আত্মম্ভরিতা আমাদের মাঝে যেন জন্ম না নেয়। ব্যক্তির সমালোচনা করলে যদি প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করা হয় আর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয় তাহলে সেটা হবে চতুর্দশ লুইয়ের চেতনার কাজ, যেটা প্রজাতন্ত্রে পুরোপুরি বর্জনীয়।

ভারত আদালত অবমাননা আইন ১৯৭১ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশ ২০১৩ সালে আদালত অবমাননা আইন প্রনয়ণের পর হাইকোর্ট বিভাগ সম্পূর্ণ অবৈধ ঘোষণা করে। এই মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ অভিমত ব্যক্ত করেছে যে কোনো আইনেই দেশের সব নাগরিকের সমান অধিকার দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু আদালত অবমাননা আইন ২০১৩ তে সরকারি কর্মকর্তা ও সাংবাদিক এ দুটি বিশেষ শ্রেণীকে নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে যা বৈষম্যমূলক। আইনটিতে আদালতের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে যা সংবিধানের ২৭,১০৮ ও ১১২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী।

আমাদের প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী আইন প্রণয়ন আরো সমৃদ্ধ ও সার্বজনীন করা হোক যাতে অবমাননার বেড়াজালে বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা পক্ষপাতহীন বিশ্লেষণ অবরুদ্ধ হয়ে না পড়ে। সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও সুশাসন নিশ্চিত করার উপযোগী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হোক। তাহলে মানুষের আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা ও সংকল্প ভিত্তিক ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের 'সাম্য','মানবিক মর্যাদা' ও 'সামাজিক সুবিচার' ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের পথ প্রশস্ত হবে।

লেখক: গীতিকার

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :