প্রকাশকের সচিত্র বয়ানে ‘পুস্তক উৎপাদন ব্যবস্থাপনা’

প্রকাশ | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২১:০৫

সাফি উল্লাহ্

‘পুস্তক উৎপাদন ব্যবস্থাপনা’ শিরোনামের গবেষণাধর্মী মননশীল বইটিতে একজন প্রথিতযশা প্রকাশকের বয়ানে বই উৎপাদন ব্যবস্থাপনার আদ্যোপান্ত আলোচিত হয়েছে। লেখক কামরুল হাসান শায়ক তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রকাশনা জগতে অতঃপ্রতভাবে সংযুক্ত থেকে নিজ হাতে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। লেখক কর্মজীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কী ধরণের চর্চা হয়, সে উপলব্ধি এবং অসংখ্য গ্রন্থ অধ্যয়নলব্ধ জ্ঞান সৃজনশীলতার সাথে প্রয়োগ করে বাংলা ভাষায় প্রকাশনা বিষয়ক সিরিজ লেখায় ব্রত হয়েছেন। তিনি হলেন পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিেিটড এর প্রথিতযশা প্রকাশক, নন্দিত প্রকাশনা বিশেষজ্ঞ কামরুল হাসান শায়ক। লেখক শায়ক রচিত প্রকাশনা বিষয়ক সিরিজের তৃতীয় গ্রন্থ হলো ‘পুস্তক উৎপাদন ব্যবস্থাপনা’। সকলের পাঠযোগ্য সাবলিল ভাষায় প্রয়োজনীয় রঙিন চিত্র  ব্যবহার করে এই নান্দনিক বইটি প্রকাশ করেছেন। এ বইতে প্রকাশনায় ব্যবস্থাপনা বিষয়ক তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক তথ্যের সুষম বিন্যাস রয়েছে।

প্রকাশকদের পেশাদারিত্ব সৃষ্টিতে ‘পুস্তক উৎপাদন ব্যবস্থাপনা’ বইটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আমাদের দেশে অনেক নতুন প্রকাশক রয়েছেন যাদের প্রচেষ্টা ও আগ্রহের ঘাটতি নেই, কিন্তু যথার্থ দিকনির্দেশনা না পাওয়ার কারণে বারবার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এদের ব্যাপারে লেখক ভূমিকায় লিখেছেন, “আমার প্রকাশনা শিল্পে তিন দশকের অভিজ্ঞতায় দেখেছি অনেক প্রকাশক প্রকাশনা ব্যবসায় করতে এসে শুধু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে ছিটকে পড়ছেন।”  এই ছিটকে পড়া প্রকাশকদের জন্য নির্দেশনা হিসেবে এবং ইতোমধ্যে প্রকাশনায় নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করেছেন এবং কাঠামোবদ্ধ উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন চান এমন প্রকাশকদের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এ বই।

আলোচনা ও পাঠকের বোধগম্যতার সুবিধার্থে লেখক বইটিকে তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন। প্রথম অধ্যায়ে উৎপাদন ব্যবস্থাপনা কী এবং এর সাথে পুস্তক উৎপাদন ব্যবস্থাপনার সম্পর্ক কোথায় এবং বই উৎপাদন করতে হলে ব্যবস্থাপনা কেমন হয়, কী কী কাজ করতে হয়, তার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। শুধু তাই নয়, একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে অনেকগুলো বিভাগ থাকে, এক বিভাগের সাথে আরেক বিভাগের সম্পর্ক কী, এক বিভাগ আরেক বিভাগের কাজে কিভাবে সহযোগিতা করতে পারে, তার বর্ণনা দিতেও লেখক ভুলেননি। বই প্রকাশের জন্য কিভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়, পরিকল্পনায় বইয়ের মান, ধরণসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করবে, এমন তথ্যও উপস্থাপন করেছেন। এছাড়া বইয়ের মূল্য নির্ধারণ কিভাবে করতে হয়, কিভাবে মূল্য নির্ধারণ করলে পাঠক ন্যায্য মূল্যে বইটি পাবে এবং একই সাথে প্রকাশনা সংস্থাও লাভবান হবে, সেসব কথাও উঠে এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবে।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায় যথাক্রমে বই উৎপাদনে প্রি ও পোস্ট প্রোডাকশন, অর্থাৎ উৎপাদন-পূর্ব ও উৎপাদনোত্তর কার্যাবলি আলোচনা করেছেন। প্রি-প্রোডাকশন অংশে আলোচিত হয়েছে পুস্তক পরিকল্পনার পর থেকে প্রেসে প্রেরণের পূর্ব পর্যন্ত সম্পাদিত সকল কর্মকাণ্ড। বিশেষত, বই পরিকল্পনা ও রচনা শেষে তা জমা দিতে হয় সম্পাদনা বিভাগের নিকট। সম্পাদনা বিভাগের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগ পাণ্ডুলিপি আদ্যোপান্ত পড়েন এবং প্রয়োজনবোধে লেখককে পাণ্ডুলিপিটি আরো উন্নত ও পরিমার্জিত করার নানান পরামর্শ দেন। সম্পাদনা ও প্রুফ রিডিং শেষে প্রি-প্রেসে প্রেরণ করা হয়। প্রি-প্রেসে বইটির মুদ্রাক্ষরবিন্যাস ও ডিজাইন, প্রুফ, পরিমার্জন, আবারো প্রুফ সংশোধন এবং পরিশেষে সংশোধিত ও পরিমাজির্ত পাণ্ডুলিপি উৎপাদন বিভাগে প্রেরিত হয়। এমন নির্দিষ্ট কর্মপ্রবাহ অনুসরণ করে একটি পাণ্ডুলিপি উন্নত থেকে উন্নততর হয়ে কাগজে ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হওয়ার দিকে ধাবিত হয়। প্রকাশনা জগতে একাধিক কর্মপ্রবাহ অনুসরণ করা হয়। একেক কর্মপ্রবাহে একেক রকম ফলাফল পাওয়া যায়, প্রকাশনীর মান ও তাদের প্রকাশশৈলীর ওপর নির্ভর করে কর্মপ্রবাহ নির্বাচন করে। এখানে আরেকটি সময়োপযোগি অংশ সংযুক্ত করা হয়েছে, তা হলো ডিজিটাল ফরম্যাটে বই উৎপাদনের নীতিমালা ও উপায়। একুশ শতকের এই দ্বিতীয় দশকের দ্বারপ্রান্তে এসে ডিজিটাল বইয়ের গুরুত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া করোনাকালীন ও এর পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল ফরম্যাটের বইয়ের চাহিদা ইতোমধ্যে বেড়েছে, এবং ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। অথচ লেখকের দূরদর্শিতার কারণে করোনার মতো পরিস্থিতি শুরুর আগেই রচিত বইতে এর পরের সময়ে প্রকাশনা জগতের সমাধান নিয়ে আলোচনা করেছেন।

বইয়ের তৃতীয় অর্থাৎ শেষাংশে আলোচনা করেছেন বই উৎপাদনের চূড়ান্ত পর্যায় নিয়ে। পাণ্ডুলিপির মুদ্রাক্ষর বিন্যাস ও অলংকরণ কিংবা একে ডিজিটাল ফরম্যাটে রূপান্তরিত করলেই প্রকাশনার কাজ শেষ হয়ে যায় না, বরং কাগজে ছাপা অক্ষরে পেতে অতিক্রম করতে হয় আরো একটি ধাপ, সেটা হলো ছাপাখানা, অর্থাৎ মুদ্রণযন্ত্র। এখানে প্রয়োজন হয় অনেকগুলো কাঁচামাল, যেমন: কাগজ, কালি, আঠাসহ আরো অনেক কিছু। সব উপাদানই বিভিন্ন ধরণ ও বিভিন্ন মানে পাওয়া যায়। নির্দিষ্ট বইয়ের জন্য কোনটা উত্তম ও উপযুক্ত হবে, কোনটা কিভাবে প্রস্তুত করা হয়, কোন বইয়ের জন্য কোন উপাদান যথার্থ হবে, তার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন লেখক কামরুল হাসান শায়ক। বাঁধাই ও লেমিনেশন প্রক্রিয়া নিয়েও বর্ণনা দিয়েছেন।

এ অধ্যায়ের শেষাংশে মুদ্রণ ও মুদ্রণ প্রক্রিয়া বৃত্তান্ত বর্ণনা করে কিভাবে গুদামজাতকরণ করতে হয়, সেখান থেকে কিভাবে দেশের বিভিন্ন বাজারে এবং কাঙিক্ষত পাঠক ও ক্রেতার হাতে পৌঁছাবে, তারও রয়েছে আলোচনা। প্রতিটা ব্যবসার মতো প্রকাশনা ব্যবসাতেও ঝুঁকি রয়েছে, এজন্য নীতিমালা অনুসরণ করে বীমা করতে হয়, তাও তিনি দেখিয়েছেন।

‘পুস্তক উৎপাদন ব্যবস্থাপনা’ বইতে নানান টার্ম ব্যবহৃত হয়েছে। এ সমস্ত টার্ম ব্যাখ্যা করে পাশর্^টীকা সংযুক্ত করা হয়েছে। বইটির কোন তথ্য না বুঝলে সেখানে সন্নিবেশিত চিত্রটি যেমন পাঠককে সাহায্য করবে, তেমনি টার্মটিকে সহজতর করবে পাশর্^টীকা।

রাজিব রাজুর আঁকা নান্দনিক প্রচ্ছদ এবং গৌতম ঘোষের চমৎকার অলংকরণের কারণে ‘পুস্তক উৎপাদন ব্যবস্থাপনা’ বইটিতে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে। বইটি বিশ^বিদ্যালয়ের প্রকাশনা বিভাগ সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যেমন তাত্ত্বিক জ্ঞানার্জনে সহায়তা করবে, তেমনি প্রকাশনার সাথে সরাসরি যুক্ত প্রকাশক, উৎপাদক, মুদ্রক কিংবা বইতে ব্যবহৃত কাঁচামাল সরবরাহকারীদের জন্যও প্রায়োগিক কারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

সর্বোপরি, জোর দিয়েই বলা যায়- বইতে যে সরল ও সাবলিল ভাষা ব্যবহার করে প্রতিটি বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছে, প্রয়োজনীয় চিত্র ও লেখচিত্র ব্যবহার করে যেভাবে প্রতিটি বিষয়কে উপলব্ধি করার জন্য সহজতর করা হয়েছে, তা দেখে বোঝা যায়- এ বইয়ের পেছনে লেখকের কতোটা শ্রম, কতোটা অধ্যবসায় জড়িয়ে রয়েছে। শুধু বই পড়ে তাত্ত্বিক জ্ঞানাবলম্বনে যদি তিনি লিখতেন, তাহলে এতো সহজে কখনোই বর্ণনা করতে পারতেন না। আবার শুধু অভিজ্ঞতার আলোকেই যদি লিখতেন, তাহলে এতো একাডেমিক টার্মের ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারতেন না। একই সাথে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নানান প্রকাশনার আধুনিকায়নের কথাও তিনি এনেছেন। আমি মনে করি, প্রকাশনা ও বই সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য আবশ্যক একটি গাইড হিসেবে বইটি কাজ করবে। বাংলা ভাষায়, বিশেষভাবে বাংলাদেশে প্রকাশনা জগতের আদ্যোপান্ত নিয়ে এমন প্রাণবন্ত তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক আলোচনা করার যে প্রয়াস প্রকাশনা বিশেষজ্ঞ ও দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনীর কর্ণধার কামরুল হাসান শায়ক নিয়েছেন, তা প্রশংসার দাবিদার।

বইয়ের নাম: পুস্তক উৎপাদন ব্যবস্থাপনা

ধরণ: গবেষণাধর্মী মননশীল বই, প্রকাশনা বিষয়ক সিরিজের ৩য় গ্রন্থ

লেখক: কামরুল হাসান শায়ক

প্রচ্ছদ: রাজিব রাজু

প্রকাশক: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড

মূল্য: ৮৭৫ টাকা

আলোচনায়: সাফি উল্লাহ্, কথাসাহিত্যিক ও প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, শেখ হাসিনা বিশ^বিদ্যালয়, নেত্রকোণা।