করোনায় যশোরে ফুল চাষে বিপর্যয়

মহসিন মিলন, বেনাপোল (যশোর) প্রতিনিধি
| আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৮:১১ | প্রকাশিত : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৭:৪৯

করোনা পরিস্থিতির সঙ্গে অবিরাম বৃষ্টির কারণে দেশে ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের গদখালী-পানিসারার ফুল চাষাবাদ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন ফুল চাষীরা।

করোনা পরিস্থিতিতে ফুল বিক্রি করতে না পারায় অর্থের অভাবে আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত ফুলের শেডগুলো আজো পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। ফুলচাষের মৌসুম এলেও নতুনভাবে চাষাবাদ শুরু করতে না পারায় ফুল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। ফুল চাষিদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের সহায়তা চেয়ে দুই বছরের স্বল্প সুদে ঋণ চেয়েছেন এ অঞ্চলের ফুলচাষি-ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি সূত্র মতে, যশোরের ঝিকরগাছা ও শার্শা উপজেলার ৭৫টি গ্রামের প্রায় সাড়ে ছয় হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করা হয় হরেক রকমের ফুল। ঝিকরগাছার পানিসারা-গদখালী গ্রামগুলোর রাস্তার দুইপাশে দিগন্ত বিস্তৃত জমিতে সারাবছরই লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি আর সাদা রঙের ফুলের সমাহার হয়ে থাকে। শত শত হেক্টর জমি নিয়ে গাঁদা, গোলাপ, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, জারবেরা, কসমস, ডেইজ জিপসি, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের চাষ হয়েছে এখানে।

প্রতিদিন উপজেলার পানিসারার শত শত ফুলচাষির আনাগোনা শুরু হয় গদখালীর বাজারে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছোট-বড় পাইকাররাও সেখান থেকে ফুল কিনে নিয়ে যান। এরপর বিভিন্ন হাতবদল হয়ে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে ফুল ছড়িয়ে পড়ে দেশ বিদেশের বিভিন্ন জায়গায়। তবে করোনার কারণে এই কার্যক্রমে ছেদ পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রতি বছর ৩০০ কোটি টাকার ফুল উৎপাদন হয় এ অঞ্চল থেকে।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস, প্রভল বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড় আম্পানের থাবায় থমকে গেছে গদখালী এলাকা। গত পাঁচ মাসে ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীদের ৩০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। হতাশায় ভেঙে পড়েছেন ফুল চাষের ওপর নির্ভর এলাকার হাজার হাজার মানুষ।

করোনায় ফুল বিক্রি করতে না পারায় নষ্ট হয়ে থাকা জমি ফেলে রেখেছে। কেউ বা অর্থের অভাবে আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত শেড মেরামত করছেন না। ক্ষতির এই বোঝা কাটিয়ে উঠতে অনেক কৃষক তাদের জমিতে ফুলের বদলে ধান, পাট, সবজিসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করছেন। কিন্ত‍ু এখনই ফুলের চাষ শুরু করতে না পারলে ব্যাহত হবে এ বছরের ফুল উৎপাদন।

করোনাভাইরাস ও সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ফুল সেক্টরের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয় বলেছেন ফুলচাষিরা। এই মুহূর্তে সম্ভাবনাময় এই সেক্টরটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই সরকারি সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন বলে দাবি করছেন তারা।

২০০৪ সালে স্বামী ইমামুল হোসেন অসুস্থ হওয়ার পরে সংসারের হাল ধরেন সাজেদা বেগম। অসুস্থ স্বামীর অনুপ্রেরণা আর স্বল্প পুঁজি নিয়েই বাড়ির পাশেই বর্গা নেয়া ১০ কাঠা জমিতে শুরু করেন জারবেরা ফুল চাষ। সততা আর উদ্যোমীর কারণে হয়েছিলেন সফলও।

বর্তমানে সাজেদার ফুলের বাগান দেড় একক। কিন্তু করোনা আর আম্পান ঝড়ে সাজেদার সফলতার ফুলের বাগান ধ্বংসের মুখে। ওই সময় সাজেদার ফুলের বাগানে সৌন্দর্য উপভোগ করতে ক্রেতা-বিক্রেতা-দর্শনার্থীদের ভীড় জমতো। তার সেই ফুলের জমি এখন ধূসর মাঠে পরিণত হয়েছে। আবার কোনো জমিতে ফুল গাছ উঠিয়ে সবজি বা ধান লাগিয়েছেন তিনি। করোনা পরিস্থিতির কারণে একদম ফুল বেচাকেনা না হওয়ায় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত ফুলের শেডগুলো পড়ে রয়েছে ঝড়ের পরবর্তী চার মাস পরেও।

গত বছরের ঋণের কিস্তির চাপে এখন শুধু হতাশা আর দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন তিনি। এমন অবস্থায় নতুনভাবে শুরু করার স্বপ্ন দেখছেন সাজেদা বেগম। তবে অর্থের অভাবে তিনি ফুল চাষ করতে পারছেন না। ফুল চাষ শুরু করবেন কবে জানতে চাইলে তিনি জানান, আম্ফানে আমার জারবেরার চারটি শেডই নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো যে মেরামত করবো টাকা নেই।

ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে তার দেড় বিঘা জমির দুটি জারবেরা শেড উড়ে যায়। কাছে টাকা নেই তাই কয়েকটি মিস্ত্রি নিয়ে তার পাশাপাশি আমার দুই স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া সন্তানকে নিয়ে এই শেড মেরামত করছি। ব্যাংকে ১৩ লাখ টাকা এবং দুটি এনজিওতে সাত লাখ টাকার ঋণ রয়েছে। গত চার মাসে এক টাকাও ঋণের কিস্তি দিতে পারিনি। ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য ব্যাংক ও এনজিও থেকে চাপ দিচ্ছে। কী করব বুঝতে পারছি না।

সাজেদা বলেন, গড়ে তোলা শেডগুলো হঠাৎ ভেঙে পড়ায় শিশুকালের মতো করে আবার এই ফুলের শেডগুলো পরিচর্যা করতে হবে। আম্ফান ও করোনায় তার ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে দাবি করছেন তিনি।

সাজেদার পঙ্গু স্বামী ইমামুল হোসেন বলেন, আমার ২৫ বছরের জীবনে ফুল চাষে এমন ক্ষতির মুখোমুখি হইনি কখনো। এমন খারাপ অবস্থা আমার জীবনে আর আসেনি। আমার দুটি টিনের শেড ছিল। প্রতিটি টিন এক হাজার ৫০ টাকা করে কিনে শেডটি তৈরি করেছিলাম। ঝড়ে শেডটি ভেঙে গেছে। এখন প্রতিটি টিন ২০০ টাকা করে বিক্রি করেছি। টিন বিক্রির টাকা দিয়ে সংসার চালাচ্ছি।

ইমামুল বলেন, বর্তমানে সাত লাখ টাকার মূলধন পেলে নতুনভাবে এই ফুল চাষ শুরু করতে পারবেন। তা না হলে এই চাষ বাদ দিয়ে ধান চাষ করতে হবে।

এলাকার তরুণ ফুলচাষী ইমরান হোসেন। এলাকায় অনেকেই ফুলচাষ করে এ পেশায় স্বাবলম্বী হওয়ায় তিনিও নেমে পড়েন এ সেক্টরে। আড়াই বিঘা জমিতে জারবেরা এবং দুই বিঘা জমিতে চায়না গোলাপের চাষ করেছিলেন গতবছর। কিন্তু করোনা আর আম্পান ঝড়ে তার ১০ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।

সম্প্রতি জারবেরা বাগানে গিয়ে দেখা যায় পরিত্যক্ত শেডগুলো পরিচর্যা করছেন ইমরান। এ সময় তিনি বলেন, গত বছরে প্রায় ১০ লাখ টাকার উপরে খরচ করে চার বিঘা জমিতে ফুলচাষ করেছিলো। ফুল বাগানে ভালো পরিচর্য়া করে অনেক ফুল হয়েছিলো জমিতে।

কিন্তু ফুলের সঠিক মৌসুমে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে করোনার হানা দেয়। এতে ফুল বিক্রি করতে পারেননি তিনি। ফলে ফুলগুলো গাছে শুকিয়ে যেতে থাকে। বলা যায়, গত মৌসুমে চাষে লাগানো সব মূলধনই জলে গেছে। আবার যে নতুনভাবে শুরু করবো নগদ কোনো টাকাও নেই। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে তার দুটি শেডই লন্ডভন্ড হয়ে গেছে।

৫০ হাজার টাকা খরচ করে ইমরান দুটি শেড মেরামত করেছেন। মূলধনের অভাবে আর দুটি শেড এখনো হাত দিতে পারেননি। তাই কিছুটা ক্ষতি কাটিয়ে উঠার জন্য শেডগুলোতে বেগুন চাষ করেছেন। পাঁচ বছর ধরে এই ফুল চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও গত মৌসুমে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সেটা কল্পনার বাইরে ছিল বলে তিনি জানান।

ইমরান বলেন, তার মতো অনেক চাষির এমন অবস্থা। সরকারি সহায়তা না পেলে ফুল চাষ থেকে সরে দাঁড়াবেন অনেকেই বলে তিনি জানান।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, দেশে ফুলের বাজার বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার। দেশের চাহিদার ৮০ ভাগ ফুল যশোর থেকে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। করোনার কারণে গত ৫ মাস ফুল বিক্রির সুযোগ না থাকায় এবার ৪৫০ কোটি টাকার ফুল নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে শুধু যশোর অঞ্চলে অন্তত ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ফুলক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শত শত শেড ধ্বংস হয়েছে। বেচাকেনা বন্ধ থাকায় চাষিরা বাগান থেকে ফুল কেটে তা পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছেন। এ অঞ্চলের ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন।

আবদুর রহিম বলেন, আগামী মৌসুমের বাজার ধরতে বর্তমানে চাষিরা ফুলচাষের বীজ বপন, পরিচর্যা করছেন। কিন্তু মূলধনের অভাবে তারা শুরু করতে পারছেন না। যশোর অঞ্চলে প্রায় ১০ হাজার ফুলচাষি রয়েছেন এই সংকটে। করোনাভাইরাস ও আম্ফানে এই খাতে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে ৫০০ কোটি টাকার কৃষি প্রণোদনা প্রয়োজন।

ক্ষতিগ্রস্ত ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ীদের ফুল চাষের খরচ বিবেচনায় সহজ শর্তে কৃষি প্রণোদনার ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে হবে। আর সেটা দিতে না পারলে এই খাত বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে অনেক চাষিই এই পেশা বাদ দিয়ে অন্যদিকে মনোযোগ দিয়েছেন বলেও জানান আবদুর রহিম।

জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, মহামারি করোনা ও ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে যশোরের প্রায় সব ফুলচাষিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে ফুলের সব ক্ষেত। ক্ষতির কারণে কোনো কৃষক যেন এই খাতের বাইরে চলে না যায়। সরকার এজন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/৫সেপ্টেম্বর/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :