‘তাইলে তোমরা একটু উবাও, আমি থোড়া ফান খাইয়া আই’

তাইসির মাহমুদ
| আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১১:২২ | প্রকাশিত : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১১:১৫

৫ই সেপ্টেম্বর (২০২০) ছিল বাংলাদেশের কৃতীসন্তান মরহুম অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের এগারোতম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে বহনকারী গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পানিতে পড়ে ডুবে যায়। তিনি গাড়ির ভেতরেই মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর আকস্মিক ও মর্মান্তিক মৃত্যুর খবরে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। ব্যথিত হয়েছিলেন সিলেটবাসী। তিনি এভাবে চলে যাবেন বিশ্বাস হয়নি। এগারোতম মৃত্যুবার্ষিকীকে এই মহান ব্যক্তি সম্পর্কে অনেক কথাই আজ মনে পড়ছে। তিনি ছিলেন উন্নয়নপাগল এক জনপ্রতিনিধি। কাজের ক্ষেত্রে তিনি কখনো টাকার তোয়াক্কা করতেন না। বলতেন, প্রজেক্ট দাও। টাকা দেওয়ার দায়িত্ব আমার। ছোটো-খাটো প্রজেক্টের আবেদন নিয়ে তাঁর কাছে গেলে তিনি রেগে যেতেন। বলতেন, পাঁচ-দশ লাখ টাকার রাস্তার কাজের জন্য বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর কাছে এসো না। পাঁচ-দশ কোটি টাকার প্রজেক্ট হলে নিয়ে এসো। তাঁর কথাবার্তা ছিলো একেবারেই সহজ সরল। সিলেটি ভাষায়ই কথা বলতেন। সংসদে বাজেট বক্তৃতায়ও সিলেটি শব্দ চলে আসতো। অনেক সময় এ নিয়ে হাস্যরসের সৃষ্টি হতো। তবে এসবে তিনি পাত্তা দিতেন না।

সংবাদকর্মী হিসেবে বিভিন্ন সময় তাঁর সভা-সমাবেশ কাভার করতে গিয়ে বিচিত্রসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। এসব ঘটনা প্রমাণ করে সাইফুর রহমান ছিলেন খুবই সরল মনের মানুষ। তিনি রাজনীতির মারপ্যাচ বুঝতেন কম। সবসময়ই সোজাসাপ্টা কথা বলতেন। মুখে যা বলতেন অন্তরেও তা লালন করতেন। এ লেখায় কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরবো। দুটো ঘটনা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। বাকিগুলো সিলেট প্রেসক্লাবের প্রাক্তন সভাপতি মুকতাবিস উন নূর রচিত ‘আমার দেখা সামাদ আজাদ ও সাইফুর রহমান’ গ্রন্থ থেকে নেয়া।

এক.

২০০৩ সালের ১৫ই নভেম্বর। এ দিনটি আমার কাছে স্মরণীয়। কারণ ওইদিন ওসমানী বিমানবন্দর থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছেড়েছিলাম। বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বসে ফ্লাইটের অপেক্ষা করছি। সঙ্গে কিছু বন্ধু-বান্ধবও। হঠাৎ দেখলাম অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ভিআইপি লাউঞ্জের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকছেন। তিনি সিলেট সফর শেষে ঢাকা ফিরছেন । পাশে তৎকালীন সিলেট জেলা বিএনপির সেক্রেটারি (বর্তমান সিটি মেয়র) আরিফুল হক চৌধুরীসহ বিএনপির একদল নেতাকর্মী। আমরা অর্থমন্ত্রীকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। আরিফুল হক চৌধুরী এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করে বললেন, ‘লন্ডন চলে যাচ্ছেন- আপনি না বললেও জানতাম’। অর্থমন্ত্রী পাশ দিয়ে অতিক্রম করছেন দেখে তাঁর দিকে হাত বাড়ালাম। তিনি হ্যান্ডশেক করে তাঁর সেই সহজ-সরল ভঙ্গিমায় বললেন, ‘খই যাইরায়, লন্ডন নি? যাও যাও। বেশি খরি টাকা পাঠাইও।’

দুই.

দিন তারিখ মনে নেই। সম্ভবত ২০০১ সালে একবার তাঁর সঙ্গে আমরা ১৫/১৬ জন সাংবাদিকের একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচনী সমাবেশ কাভার করতে বড়লেখা ও কুলাউড়ায় গিয়েছিলাম। বড়লেখায় বিএনপির প্রার্থী ছিলেন এডভোকেট এবাদুর রহমান চৌধুরী (সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী) আর কুলাউড়ায় চারদলীয় ঐক্যজোটের প্রার্থী ছিলেন ডা. শফিকুর রহমান। সিলেট শহর থেকে বের হয়ে প্রথমেই আমাদের গাড়িরবহর থামলো শহরতলীর কুচাইয়ে ডা. আলা উদ্দিন আহমদের (ঢাকার প্রখ্যাত নাক কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞ) বাড়ির আঙ্গিনায়। সকালের নাস্তার জন্য ডা. আলা উদ্দিন আহমদ আগেই আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন। আমরা নাস্তা সেরে ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির পুকুর পারে এসেছি । হঠাৎ সাইফুর রহমান সহেব বলে ওঠলেন, ‘ও আলা উদ্দিন, তোমরার বাড়ির বেটিনতে ফান খাইননানি।’ ডা. আলা উদ্দিন ইতস্তবোধ করে বললেন, ‘জি অয় স্যার। খাইতানা কেনে খাইনতো।’ সাইফুর রহমান বললেন- ‘তাইলে তোমরা একটু উবাও (দাঁড়াও) আমি থোড়া ফান খাইয়া আই।’ এই বলে তিনি আবার ঘরে ফিরে গেলেন। সরাসরি গিয়ে ঢুকলেন রান্নাঘরে। নিজেই পানদান খুঁজে বের করে সুপারি খেলেন। হাতে করে আরো কিছু নিয়ে এলেন। বললেন, ‘‘বউত লম্বা রাস্তা। পথো খাওয়া যাইবো।’

তিন.

একবার তিনি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় গেছেন। এই উপজেলা তাঁর নির্বাচনী আসন সিলেট সদরের অন্তর্গত। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নতুন যোগ দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী তাঁর উপজেলা সফরের গেছেন তাই তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁর জন্য কী খাবার আয়োজন করবেন। অর্থমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন, স্যার আপনি কী মাছ খেতে পছন্দ করেন। জবাবে সাইফুর রহমান বলেন, “মখা-টখা ফাইলে ভালা”। ইউএনও সাহেব মখা মাছকে ‘মক্কা’ মনে করলেন । তিনি তাঁর স্টাফকে বললেন, স্যার ‘মক্কা’ মাছ খেতে চেয়েছেন, যেভাবে হয় ব্যবস্থা করো। কিন্তু মক্কা মাছ তো কেউই চিনেন না। বিপদে পড়লেন তাঁরা । অর্থমন্ত্রীকে আবার জিজ্ঞেস করতেও সাহস করতে পারছেন না। উপায়ন্তর না দেখে ইউএনও সাহেব ফোন করলেন সিলেট প্রেস ক্লাবের প্রেসিডেন্ট মুকতাবিস উন নূরকে। কারণ তিনি জানতেন, অর্থমন্ত্রীর সাথে প্রেসক্লাব সভাপতির ভালো সম্পর্ক আছে। ইউএনও তাঁকে বললেন, অর্থমন্ত্রীতো ‘মক্কা’ মাছ খেতে চেয়েছেন। আমার স্টাফতো কেউই মক্কা মাছ চিনেনা। এটা কী মাছ, কোথায় পাওয়া যায়, আপনি কি জানেন? তখন প্রেস ক্লাব প্রেসিডেন্ট জানতে চাইলেন, অর্থমন্ত্রী ঠিক কী বলেছেন বলুনতো । ইউএনও বললেন, ‘আমি শুনেছি তিনি বলেছেন, মক্কা-টক্কা পাইলে ভালা’। প্রেসক্লাব সভাপতি বিষয়টি বুঝতে পেরে বললেন, অর্থমন্ত্রী সম্ভবত বলেছেন, মখা-টখা পাইলে ভালা । এবার ইউএনও সাহেব বললেন, হ্যা হ্যা তিনি এভাবেই বলেছেন। তিনি বললেন, মখা মানে এক ধরনের ছোট মাছ। আপনি আপনার অফিসের সিলেটি কোনো স্টাফকে বলুন। তারা চিনবে। পরে অর্থমন্ত্রীর জন্য মখা মাছের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো।

চার.

সাইফুর রহমান সাহেবের স্মরণশক্তি ভালো ছিলোনা । অতি ঘনিষ্ট না হলে তিনি সহজে চিনতেন না। একদিন রাতে সিলেট প্রেসক্লাব সভাপতিকে সার্কিট হাউজে যেতে খবর দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছুটে গেলেন। অর্থমন্ত্রী তাঁকে দেখেই বললেন, তোমারে সকালে দেখা করার কথা বললাম, আগে আইলায়না? আপনি কোনদিন বললেন বলতেই সাইফুর রহমান বললেন, কেনে- সকালেউতো এয়ারপোর্ট তোমারে কইলাম। তিনি অবাক হয়ে বললেন, আমি তো আজ এয়ারপোর্টেই যাইনি । তখন পাশে থাকা আরিফুল হক চৌধুরী বললেন- স্যার, নূর ভাই (প্রেসক্লাব সভাপতি মুকতাবিস উন নূর) নায় । ইনি তো সিলেট বাণীর সম্পাদক (মরহুম আলহাজ্ব জাহিরুল হক চৌধুরী) আছলা। এবার সাইফুর রহমান সাহেব বললেন, ইনো (সিলেটে) দাড়িআলা সম্পাদক দুইজন নি? দেখতেও তো তোমার লাখান।’

পাঁচ. ২০০৬ সাল। সাইফুর রহমান সাহেব সফরে গিয়ে দেখেছেন ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের চারতলা ভবন। এরপর সিলেট সফরে গিয়ে প্রেসক্লাব সভাপতিকে ডাকলেন। মুখোমুখী হলে বললেন, ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব চারতলা, তোমারটা দো’তলা কেনে । তিনি হেসে বললেন, আমাদের এখানেতো সালাম তালুকদার (বিএনপির তদান্তিন মহাসচিব) নেই । তাদের আছে । এই জন্য তাঁরা চারতলা প্রেসক্লাব ভবন বানাইতে পারছে । তখন সাইফুর রহমান সাহেব বললেন, ‘তুমি কয়তালা চাও”। তখন প্রেসক্লাব সভাপতির মুখ ফসকিয়ে বেরিয়ে এলো ‘সাততালা’। তখন সাইফুর রহমান বললেন, অইবো, কাইল থাকি ভাঙ্গা শুরু করো। প্রেসক্লাব সভাপতি বললেন, আপনাদের সময় শেষ হয়ে আসছে । এখন আর ওইদিকে না এগুনোই ভালো । আমাদের দুতলা ভবন দিয়ে মোটামুটি চলে যাচ্ছে। এখন ভাঙলে বিপদে পড়তে হতে পারে। তাঁর কথা শোনে অর্থমন্ত্রী বলে ওঠলেন, অত জলদি মরতামনায় রাবা । প্রেস ক্লাব সভাপতি বললেন, শেষ সময় বলতে আমি সরকারের শেষ সময়ের কথা বলছি। নতুনভাবে আপনাদের সরকার ক্ষমতায় এলে না হয় করবেন। তখন সাইফুর রহমান বললেন, ‘ক্ষমতাত না আইলেও তোমার বিল্ডিং সাততলা অইবো। মালসামানা তাড়াতাড়ি হরাও। ইটা ভাঙো।’ পরবর্তীতে সত্যিই দুতলা ভবন ভেঙে বহুতল ভবন নির্মিত হয়।

ছয়. একটি শোনা গল্প দিয়ে শেষ করতে চাই। একবার কয়েকজন সাংসদ তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে সাইফুর রহমানের ব্যাপারে অনুযোগ করলেন। বললেন, অর্থমন্ত্রী সিলেটের ফাইল ছাড়া অন্য এলাকার উন্নয়নের কোনো ফাইলে সহজে স্বাক্ষর করেন না। অনুযোগ শোনে খালেদা জিয়া নাকি মৃদু হেসে বলেছিলেন, তাহলে আপনারা আপনাদের ফাইলের উপরে সিলেটের একটি ফাইল রেখে দিবেন। তাহলেই তো হয়ে গেলো। তিনি (সাইফুর রহমান) সেটি দেখে বাকি ফাইলগুলোতেও স্বাক্ষর করে দেবেন।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ১২ বার বাজেট পেশ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান। ছিলেন একজন পেশাদার একাউন্টেন্ট। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় নবদিগন্তের সূচনা হয়েছিলো। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও তাঁকে সম্মান করতেন। সম্মান করতেন বিরোধীদলের রাজনীতিকরাও। উগ্র ও অসৎ রাজনীতিকদের তিনি পছন্দ করতেন না, প্রশ্রয়ও দিতেননা । রাজনৈতিক হানাহানি তাঁর কাছে ছিলো চরম বিরক্তিকর। সিলেটের অনেকের মতো তিনিও মনে করতেন দেশ বিভক্তির পর সিলেট উন্নয়নবঞ্চিত ছিলো। আর তাই সিলেটের উন্নয়নে তিনি ছিলেন আপোসহীন।

আওয়ামী লীগ আমলে সিলেট শহরের পুরানলেনে ডায়াবেটিক হাসপাতালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন তৎকালীন স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। অনুষ্ঠানমঞ্চ থেকে নেমে স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সাইফুর রহমানের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন আপনার সঙ্গে একটু কোলাকুলি করি। সাইফুর রহমান বললেন, কোলাকুলির আবার কী হলো?

জবাবে স্পিকার বললেন- সাইফুর রহমান সাহেব, ওইদিন যখন জাতীয় সংসদে বক্তৃতাকালে সিলেটের উন্নয়ন বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরে বক্তব্য রাখছিলেন সেদিন গর্বে আমার বুক ভরে ওঠেছিল। স্পিকারের চেয়ারে বসে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা যায় না, তাই সেদিন নীরব থাকতে হয়েছিল। আজ কোলাকুলি করে সেই উচ্ছ্বাসটুকু প্রকাশ করতে চাই।

সাইফুর রহমান তাঁর সারল্য, সোজাসাপ্টা কথাবার্তা এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদানের জন্য যুগযুগ ধরে সাধারণ মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন। এগারোতম মৃত্যুবার্ষিকীতে এই মহান ব্যক্তিকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করি। সৃষ্টিকর্তা যেন তাঁকে জান্নাতের স্থায়ী বাসিন্দা করেন।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ, লন্ডন

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :