ইসরায়েল এবং ইউএই সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ কতটা স্বাভাবিক?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
| আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৬:৩৬ | প্রকাশিত : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৬:২৭

ইসরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সমঝোতা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, উপসাগরীয় অঞ্চল এবং আরব বিশ্বের বাইরের মুসলিম দেশগুলোতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলছে। যদিও ইসরাইলের সাথে ইউএইর এই চুক্তিতে একটা বিস্ময় আছে সবার প্রতিক্রিয়ায়, কিন্তু বাস্তবতা হলো দুই দেশ বহু বছর ধরেই গোপনে কূটনৈতিক সম্পর্ক রেখে চলছিল। এখন তারা প্রকাশ্যে এল মাত্র।

এই চুক্তির নানামুখী প্রভাব নিয়ে আলোচনায় সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে এর ফলে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ঝুলে গেল কি না সে বিষয়টি। ফিলিস্তিন প্রশ্নে আরবের বাইরের মুসলিম দেশগুলো যতটা সরব, যতটা ইসরাইলকে ঘৃণা করে, ততটা সেই মনোভাব নেই আরব দেশগুলোর মাঝে। নানা ইস্যুতে বিভক্ত এই দেশগুলো এখানেও বিভাজিত।

স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ফিলিস্তিনিরা। তারা এটিকে চরম বিশ্বাসঘাতকতা বলেছে। প্রায় প্রতিদিনই বিক্ষোভ করছে, আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের ছবি পোড়াচ্ছে। উপসাগরীয় রাজতন্ত্রের দেশগুলো খুব সতর্ক প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে এই সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। তাদের চিন্তায় ইসরায়েল নিয়ে ইতিবাচক নতুন ভাবনা-চিন্তাই বেশি প্রকাশিত হচ্ছে। একমাত্র ব্যতিক্রম ইরান, যারা কড়া সমালোচনা করেছে এই চুক্তির। ইরান ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব বজায় থাকা মুসলিম দেশগুলোকেও সক্রিয় করার চেষ্টা করছে।

এই বাস্তবতায় বোঝা যাচ্ছে, ইসরায়েল-ইউএই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় খুলেছে। এখন দেখার পালা আরব আমিরাতকে অনুসরণ করে আর কোন কোন দেশ। ইরান, তুরস্ক আর পাকিস্তান চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করলেও অনেক আরব দেশ নিশ্চুপ আছে। এতে বোঝা যায় তাদের কোনো আপত্তি নেই এই সমঝোতায়। আরব লীগ এবং সৌদি আরব নীরব রয়েছে। তবে সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ মিত্র বাহরাইন প্রথম দেশ হিসেবে আরব আমিরাতকে অভিনন্দন জানিয়েছে। এরপরই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে ওমান।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল-ইউএই চুক্তিকে উপসাগরীয় দেশগুলো কৌশলগত সুযোগ হিসেবে দেখছে। তারাও চায় ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে। তারা দেখতে চায় এর ফলাফল কি দাঁড়ায়। বরফ গলিয়েছে আরব আমিরাত। এখন বাকিরা দেখছে কি উপকার ঘরে তুলতে সক্ষম হবে দেশটি। ছোট ছোট উপসাগরীয় দেশ আরব আমিরাতের পথে হাঁটবে। সবার আগে এগিয়ে আসার সম্ভাবনা বাহরাইনের। ইতোমধ্যেই বাহরাইনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বিএনএ এই চুক্তিকে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছে, এর মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে।

বাহরাইন সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ মিত্র। সে ইরানকে নিজের জন্য বড় শত্রু বলে মনে করে। আর এ কারণে দেশটি এই অঞ্চলের শক্তিশালী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বাড়াতে চায়। রিয়াদের দিক থেকে সংকেত পেলেই বাহরাইন ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে এগুবে যদিও উপরে উপরে বলছে, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ছাড়া ইসরায়েলের সাথে কোনো সম্পর্ক হবে না।

আরেক সম্ভাবনাময় দেশ ওমান। আরব আমিরাতকে স্বাগত জানিয়ে ওমান ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবি আদায়ের প্রতি তার প্রতিশ্রুতির কথা উচ্চারণ করেছে। ওমান দীর্ঘ সময় ধরে এই অঞ্চলে নিজের একটি নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি ধরে রাখতে সক্ষম হলেও হঠাৎ করেই এই চুক্তিকে সমর্থন করেছে। দুই বছর আগে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বাহরাইন সফরও করেছেন।

কাতার এবং কুয়েত নীরব আছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে পরবর্তী প্রথম দেশ সুদান যে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে। ইতোমধ্যেই নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে সুদান। মার্কিন অবরোধে বিপর্যস্ত সুদান চায় ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে নিজের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে।

সৌদি আরবের নীরবতা রহস্যজনক, যদিও সবাই বিশ্বাস করে আরব আমিরাতকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়েছে রিয়াদ। সৌদিরা চুক্তির সমালোচনা করেনি, চুক্তিকে স্বাগতও জানায়নি। তবে ইউএই-ইসরায়েলের বিমান চলাচলে সুবিধা দিবে বলেছে। আর বলেছে তেল আবিবকে অবশ্যই ফিলিস্তিনের সাথে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য চুক্তি করতে হবে। সৌদি আরবও দেখছে কোন দিকে পানি গড়ায়। সৌদি আরব দেশের ভেতরে জনগণের প্রতিক্রিয়া আরও বুঝতে চায় এবং অন্যান্য মুসলিম দেশের সাথে তার সম্পর্কের জায়গায় এখনই কোনো নতুন বার্তা দিতে চায় না।

গণতন্ত্রের চর্চা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকায় আরব দেশগুলোর জন-প্রতিক্রিয়া জানা সম্ভব হয় না। ধারণা করা যায় যে বেশিরভাগ মুসলিম দেশের নাগরিক এই চুক্তিতে খুশি নয়। তবে একটি সমীক্ষা বলছে, আমিরাতের জনগণ ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে নিজ দেশের এই উদ্যোগে।

একটি বড় বিবেচনার বিষয় হলো, ইসরায়েল নিজে কী ধরনের ব্যবহার করবে আগামী দিনগুলোতে। ফিলিস্তিনের ভূমি দখল থেকে সরে আসবে কি না, সেখানকার জনগণের ওপর চালানো নিপীড়ন-নির্যাতন বন্ধ করবে কি না– এসব প্রশ্ন এখন বড় করেই উঠছে। ইসরায়েলের অতি মাত্রায় আগ্রাসী আচরণে বিপদ বেশি হবে আরব আমিরাতের। তখন প্রশ্ন উঠবে এই সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের উদ্যোগ কতটা অস্বাভাবিক কাজ হলো আমিরাতের জন্য।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :