ভারত-চীন সংকটে বাংলাদেশ শান্তির দূত

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ
| আপডেট : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:৪৭ | প্রকাশিত : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১০:১৯

আমি আন্তর্জাতিক বিষয়ের একজন অবজার্ভার বিশেষজ্ঞ নই। আমার বিদ্যা ওই সাধারণ নাগরিকের মতো সাধারণ উপলব্ধি থেকে। সুতরাং, কিছু চীন-ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের বিষয়ে বলতে আমি ওই সাধারণ নাগরিকের আড্ডা থেকে কিছু কথা আপন মনে পর্যালোচনা করেছি। আমার মনে হয়েছে ভারত-চীন সংকটে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শান্তি দূতের ভূমিকা পালন করতে পারে। দুই দেশ যত কাছাকাছি আসবে তা বহুমাত্রিক আকার ধারণ করে বিশ্বকে চমক লাগিয়ে দেবে। নিবিড়ভাবে সমস্যাগুলোকে খুঁজে দেখার জন্য বাংলাদেশে একটি গবেষণা কেন্দ্র হতে পারে যেখানে চীন-ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কার গবেষকরা ঐকমত্যের সূত্রগুলো খুঁজবেন এবং কিভাবে বন্ধন আরও জোরালো করা যায় তা নিয়ে ভাববেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম থেকেই চীনকে নানাভাবে সমালোচনা ও প্রতিরোধ করছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা সংকট। এই সংকট মোকাবেলায় আমাদের সকলের একসঙ্গে কাজ করা খুবই জরুরি। কিন্তু সেখানে পুরোনো সুসম্পর্কটাতে চিড় ধরছে। সকলেই ব্যথিত এবং সঙ্গত কারণেই হয়তো চীনকে দায়ী করছে। এমনি একটি পরিস্থিতিতে কিছু আচরণ চীনকে সতর্ক হতে বাধ্য করেছে। চীন একটি অজানা চাপের মুখে আছে। সেটা আরও প্রকট হয়েছে ভারত সীমান্তে উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে।

বাংলাদেশের তিনপাশেই আছে ভারত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল ভারত। তারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই লড়াই করেছে। আমরা তাদের সেই অবদানকে কোনোভাবেই ভুলে যেতে পারিনা। আমরা ভুলে যেতে পারিনা সেই ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ের অর্জিত স্বাধীনতাকে স্বীকার করতে কুন্ঠিত ছিল চীন। এগুলোতে সময়ের আবর্তনে পরিবর্তিত হয়। নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে বোঝা যায় ওই দেশের জনগণ আমাদের পাশে আছে। আমরা হয়তো বন্ধুত্বর হাত বাড়াই। আমাদের বিরোধ চিরদিন থাকে না। কিন্তু ক্ষতটা গভীর হলে সেটাকে ভুলতে অনেক অনেক সময় লাগে।

ভারত-চীন, ভারত-পাকিস্তান বিরোধে কাশ্মীর একটি সমস্যা। অপরদিকে হংকং সমস্যা ব্রিটেনকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাইওয়ানকে নিয়েও চীনের সমস্যা আছে। চীন-জাপান সমস্যাও আছে। এমনি একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশেকে চীন বন্ধু হিসেবে কাছে পেতে চায়। কারণ তাদের অর্থ-রাজনৈতিক বিষয়। তারা নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কাতে বিনিয়োগ করেছে। ভারতেও তাদের বিনিয়োগ আছে। সুতরাং শান্তির সম্পর্ক ধরে রাখতে বাংলাদেশকে পাশে পেতে চীন খুবই মনোযোগী।

চীন ও ভারতের বর্তমান অবস্থা বিশেষ করে নাগরিকদের অধিকারের বিষয়টা সকলের সামনে চলে এসেছে। তাদের সংকীর্ণ নীতিতে সারা বিশ্ব আসলে ব্যথিত। ভারতে মুসলিম ও নিম্নবর্ণের মানুষেরা নিপীড়িত বলে জানা যায়। অপরদিকে হংকং স্বাধীন থাকতে চায়। তাইওয়ান স্বাধীন থাকতে চায়। এই স্বাধীনতার দাবিকে বাংলাদেশ কি উপেক্ষা করতে পারে?

স্বাধীনতা একটি মধুর শব্দ। প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতা চায়। সে স্বাধীনতার দাবিকে নাকচ করবার যুক্তি খুবই কম। কাশ্মির, নাগাল্যান্ড, শিখরা স্বাধীনতা চেয়েছে। হংকং-তাইওয়ান স্বাধীনতা চায়। ভারত-চীনের এই অভ্যন্তরীণ সমস্যা বাংলাদেশ বিবেচনায় নিতে পারে কি? মানবতাকে অখণ্ড দেখলে, স্বাধীনতাকে সুখী ও শান্তিপূর্ণ জীবনের মূল চালিকা শক্তি বিবেচনা করলে- সকলকেই মানতে হবে কিছু কিছু সমস্যা অভ্যন্তরীণ নয়।

আমরা স্বাধীনতা হীনতার কষ্টটা বুঝি। আর তাই স্বাধীনতা দাবি করা মানুষগুলোর মুখ দেখলে আমাদের মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। তখন মনে হয় চীন-ভারত কেউ আমার আপন নয়। তবে কি মনে করবো ভারত আমাদের স্বাধীনতা চেয়েছিল পাকিস্তানকে জব্দ করতে? চীন কি তবে তাদের স্বার্থেও আমাদেরকে বন্ধু ভাবে? আমরা নেপাল ভুটানকে সহযোগিতা করতে চাই। আমরা চাই ভারত আরও মানবিক হয়ে অখণ্ডতা বজায় রাখুক, আমরা চাই চীন হংকং এর অশান্তি দূর করে শান্তির সম্পর্ক স্থাপন করুক।

দীর্ঘদিন তাইওয়ান স্বাধীন আছে। তাতে কি চীনের কোনো ক্ষতি হয়েছে? আমার কাছে মনে হয়েছে ভারত সরকার ও চীন সরকার অন্য কোনো সংকটে আছে। মোদি সরকার যে হিন্দু রাষ্ট্রগঠন করতে চায় তা হুমকির মুখে। মানুষ আবার কংগ্রেসমুখী হচ্ছে। আর যেহেতু কংগ্রেস আরও নিবিড়ভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িত সুতরাং তারা দুঃচিন্তায় আছে।

অপরদিকে যে বাণিজ্য সম্পর্ক চীন আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে গড়ে তুলেছে তা করোনা সমস্যার সমাধান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যেতে পারে। কারণ সামনে চীনকে ইউরোপ-আমেরিকাকে সামলাতে হবে। এবং ২০২১ সালে গভীর সংকটে চীন সরকার পড়তে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন শেষ হলেই চীনকে আরও কঠিন অবস্থা মোকাবেলা করতে হতে পারে।

ভারতে সেক্যুলারিজমের পক্ষে মানুষ রাস্তায় নামবে হয়তো। আমরা ভালো নেই করোনাভাইরাসের কারণে। চীন-ভারতের সংকট অন্যখানে। বাংলাদেশ চীন-ভারতের মাঝে পড়ে যাতে সারা বিশ্ব থেকে আলাদা না হয়ে যায় সেটাও মনে রাখতে হবে।

মানুষের স্বাধীনতার কথা ভেবে ভারত-চীন যাতে আরও সহনীয় নীতি গ্রহণ করে সে অনুরোধ বাংলাদেশ করতে পারে। এবং যদি সেটা চীন ও ভারত গুরুত্ব দেয় তাহলে একটি শান্তি চুক্তিও হতে পারে যেখানে সকলের স্বাধীনতাকে তারা সর্বোচ সম্মান দেবে বলে স্বীকার করতে পারে। এভাবে যদি ঐকমত নিজেদের মাঝে সৃষ্টি করতে পারে তবে আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবেলায় সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ যেভাবে পার্বত্য জেলাগুলোতে শান্তিচুক্তির মধ্য দিয়ে উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা শুরু করেছে সেভাবে সকল মানুষের মর্যাদাকে সমুন্নত রাখবার জন্য হংকং, তাইওয়ানকে পাশে টেনে নিতে পারে চীন। অপরদিকে ভারত নাগরিক নিবন্ধন বাতিল করে কাশ্মিরসহ সমাজের অবহেলিত মানুষদের সমমর্যাদা দিতে পারে। এবং এমন একটি চুক্তি আগামীতে বিশ্ব শান্তির সেরা দলিল হয়ে পারে। “বাংলাদেশ চীনের দিকে বেশি ঝুঁকছে” বলে যে ভুল বার্তা বিশ্ববাসীকে দেয়া হচ্ছে সেখান থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করবার দায় আমাদের সকলের। আগামী দিন ভারত-চীন এক হয়ে যাবে, যুক্তরাষ্ট্র চীনকে আবার বুকে টেনে নেবে- কিন্তু আমাদের অবস্থা অন্যরকম হবে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের অন্যভাবে মূল্যায়ন করবে। বাংলাদেশ ওই ভুল বার্তা খণ্ডন করতে যেন বেশি কালক্ষেপন না করে সেটাই আমার উপলব্ধি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে চীনকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হতে পারে। তাকে একটু বেশি ছাড় দিতে হতে পারে। সেই জায়গাটা খুঁজে পাওয়া দুস্কর হবে না। অন্তত চীন কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের উপহার নিয়ে এই দেশগুলিতে শান্তির দ্বার খুলে দিতে পারে।

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :