ইউএনও’র ওপর হামলা: রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নেরই বহিঃপ্রকাশ

কাওসার রহমান
| আপডেট : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৪:২৪ | প্রকাশিত : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২১:২৭

এই প্রথম বাংলাদেশে প্রশাসনের ওপর হামলা হয়েছে। গত ২ সেপ্টেম্বর বুধবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর তার সরকারী বাসা ভবনে হামলা করা হয়। হামলাকারীরা বাসার পেছনের দিকে থাকা বাথরুমের ভেন্টিলেটর ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে তাকে হাতুরি দিয়ে আঘাত করে। হামলায় ওয়াহিদা ছাড়াও তাঁর পিতা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলীও মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। হামলার পর ৩ সেপ্টেম্বর ভোরের দিকে ওয়াহিদা খানম এবং তার বাবা ওমর আলী শেখকে উদ্ধার করে প্রথমে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে ওয়াহিদা খানমকে রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল ভর্তি করা হয়।

হামলায় ইউএনও মারাত্মকভাবে জখম হন। তার মাখার খুলির হাড় ভেঙ্গে ভেতরে মস্তিকে ঢুকে যায়। এজন্য তার শরীরের অনেক অংশ অবশ হয়ে পড়ে। তার অবস্থা তখন আশঙ্কাজনক ছিল। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সবাত্মক চিকিৎসার নির্দেশ দেন। পরে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকায় আনা হয়। কারণ তার মাথার বামদিকে বেশি আঘাত লেগেছে। সেখানে দেবে যাওয়ায় ডান হাত ও পা অবশ হয়ে গেছে। এছাড়া মাথার পানি গহ্বরে রক্তক্ষরণ হয়েছে। বর্তমানে তিনি শেরেবাংলা নগর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসাইন্স অ্যান্ড হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন। ৩ সেপ্টেম্বর রাতে প্রায় দুই ঘণ্টা অস্ত্রপচারের পর ওয়াহিদা খানমের জ্ঞান ফিরে।

৪ সেপ্টেম্বর তার সিটি স্ক্যান রিপোর্ট পাওয়া যায়। রিপোর্ট খুব ভালো এসেছে, অর্থাৎ অপারেশন ভালো হয়েছে। আইসিইউ-তে ডাক্তার রোগীর সাথে কথা বলেন। উনি তার স্বামীর সাথেও কথা বলেছেন এবং স্বামীকে চিনতে পেরেছেন। তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছেন এবং তাকে আপাতত বিদেশ পাঠানোর প্রয়োজন নেই বলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারা মনে করছেন। এটা খুবই আশাপ্রদ খবর। আমরা চাই, ওয়াহিদা এবং তার বাবা দ্রুত সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসুন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় ইউএনও বিষয়ে সার্বিক খোঁজখবর রাখছেন। তার সব রকম সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। এরমধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মহানুভবতা আবারও প্রকাশ পেল। এ ধরণের ঘটনায় শেখ হাসিনা সব সময় এগিয়ে আসেন। এতে এদেশের মানুষের প্রতি তার ভালবাসা ও মমত্ববোধের প্রধান পাওয়া যায়। এটি অবশ্য তার একটি বড় গুণ।

ঘটনার পর পরই আইন-শৃংখলা বাহিনী বেশ তৎপর হয়ে উঠে। এটাই স্বাভাবিক। সন্ত্রাসীরা এবার দেশের মুল প্রশাসন যন্ত্রের ওপর আঘাত করেছে। এতে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপর হওয়াটাই স্বাভাবিক। তার ওপর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ যেখানে রয়েছে। ঘটনার পর ৩ সেপ্টেম্বর রাতেই হামলার ঘটনায় ওয়াহিদা খানমের ভাই শেখ ফরিদ বাদি হয়ে ঘোড়াঘাট থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।

মামলায় অজ্ঞাত ৪-৫ জনকে আসামী করা হয়েছে। ঘটনার পর পরই পুলিশ বাসভবনের নিরাপত্তা প্রহরী পলাশকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানা হেফাজতে নেয়। র‍্যাব-১৩ গত ৪ সেপ্টেম্বর ভোর পাঁচটার দিকে ঘোড়াঘাট উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম, সদস্য আসাদুল ইসলাম, ৩ নম্বর সিংড়া ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি মাসুদ রহমান, নৈশ প্রহরী নাহিদ, সান্টু ও নবিরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে।

এদের মধ্যে সান্টু ও নবিরুল পেশায় রং মিস্ত্রি। তাদের কাছ থেকে হামলায় ব্যবহৃত একটি হাতুড়ি উদ্ধার হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলমকে আটকের পর আবার তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। জাহাঙ্গীরকে ছেড়ে দেওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তাদের দাবি, ঘটনা ভিন্ন খাতে চলে যাচ্ছে কি না তা তারা বুঝতে পারছে না।

৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রংপুরে র‍্যাব-১৩-এর কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এর অধিনায়ক রেজা আহমেদ ফেরদৌস বলেন, হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ছয়জনকে আটক করেছিল র‍্যাব। তাদের মধ্যে আসাদুল ইসলাম, নবীরুল ইসলাম ও সান্টু কুমারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। আসাদুলের দাবি অনুযায়ী, এটি একটি চুরির ঘটনা। তারা মূলত চুরির উদ্দেশ্যে ওয়াহিদা খানমের সরকারী বাসভবনের পেছনের বাথরুমের ভেন্টিলেটর ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকেছিল। ভেতরে ঢোকার পর পরই চুরির সময় প্রথমে ওয়াহিদার পিতা জেগে যায়। তিনি চোর চোর বলে চিৎকার করতে থাকেন। এ সময় চোরেরা তার উপর হামলা করে। তাকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করে। তার পিতার চিৎকার শুনে ওয়াহিদা খানম জেগে যান। তিনিও চোর চোর করে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকেন।

এ সময় চোরেরা ওয়াহিদাকেও হাতুড়ি দিয়ে মারাত্মকভাবে আঘাত করে। তারা অচেতন হয়ে পড়ে গেলে লোকজন আসার আগেই চোরেরা পালিয়ে যায়। তবে প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য আরো সময় দিতে হবে, আরো তদন্ত করতে হবে, প্রয়োজনে সম্পৃক্তদের রিমান্ডে নিতে হবে। তিনি বলেন, আসামিদের রাজনৈতিক পরিচয় তদন্তে বাধা হবে না। হামলার মোটিভ জানতে ছায়া তদন্ত চলছে। এটি নিছক চুরির ঘটনা নাকি এমন ঘটনার নেপথ্যে আরও কোন রহস্য আছে তা জানার চেষ্টা চলছে।

আসলেই প্রশ্নটা এখানেই। ওয়াহিদা খানম ও তাঁর পিতার ওপর নির্মম হামলার প্রকৃত কারণ চুরি নাকি অন্যকিছু, তা নিয়ে এলাকায়ও নানা গুঞ্জন চলছে। এলাকার সাধারন মানুষ বলছে, হামলার পিছনে থাকতে পারে মাদক কারবার, চাঁদাবাজি, নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন ও অবৈধ দখলে বাধা দেওয়ার ঘটনার প্রতিশোধ। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, শুধু চুরি উদ্দেশ্য থেকে এই হামলার ঘটনা ঘটেনি।

ঘটনায় জড়িত অভিযোগে যাদের আটক ও গ্রেপ্তার করা হয়, তাদের মধ্যে নৈশ প্রহরী নাহিদ হোসেন পলাশ, রংমিস্ত্রি নবিরুল ও সান্টু ছাড়া বাকি সবার নামে ঘোড়াঘাট থানায় রয়েছে একাধিক মাদক, চাঁদাবাজি ও জমি দখলের মামলা। তাদের নেতৃত্বে ঘোড়াঘাটে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে ছিনতাই ও জমি দখলের ঘটনা। উপজেলাজুড়ে মাদক কারবারেও তারা জড়িত। করোনাকালে ত্রাণ চুরি, জমি কেনাবেচায় চাঁদা আদায়, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন এবং সংসদ সদস্যের ওপর হামলার চেষ্টাসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

ঘোড়াঘাট রানীগঞ্জ বাজার এলাকায় নুনদহ ঘাটে অবৈধভাবে শ্যালো মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করে ৩ নম্বর সিংড়া ইউনিয়নের যুবলীগের সভাপতি মাসুদ। ইউএনও ওয়াহিদা খানম সেখানে বালু উত্তোলনের সরঞ্জাম পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ ঘটনাও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার একটি কারণ হতে পারে বলে এলাকাবাসীর ধারণা।

গত ১৪ মে প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা সায়েদ আলীর জামাতা আবিদুর রহমান যুবলীগ দিনাজপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক বরাবর একটি অভিযোগ পাঠান। অভিযোগটি ইউএনও ওয়াহিদার কাছেও আসে। অভিযোগে বলা হয়, ‘উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম ও মাসুদ রানা আমার কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিল। বিভিন্ন সময় তাদের দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়। বাকি টাকা দিতে বিলম্ব হলে তারা কলোনিপাড়া এলাকায় আমাদের এক একর জমি দখল করে নেয়।’ ওয়াহিদা খানম বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে জমি উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। ফলে ওই হামলার পর এলাকাবাসী ইতোপূর্বে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার যোগসূত্র খুঁজছেন। তারা মনে করছেন, ওসব ঘটনার কারণেও ইউএনও নাহিদা খানমের উপর হামলা হতে পারে।

এর আগে, গত ১২ মে দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য নিজ তহবিল থেকে ঘোড়াঘাট পৌরসভার মেয়র আ. সাত্তার মিলনের মাধ্যমে ইফতারসামগ্রী বিতরণের উদ্যোগ নেন। সেই ইফতার সামগ্রী ও ত্রাণ ছিনিয়ে নিয়ে মেয়র আ. সাত্তার মিলনের পাঞ্জাবি ছেঁড়াসহ তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। এ ঘটনার মামলায় যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর ও তার সহযোগী মাসুদ রানা, ইয়াদ আলী, নাহিদ, আব্দুর রবকে আসামি করা হয়েছে। সে সময় উপজেলা নির্বাহী অফিসার ওয়াহিদা খানম পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

ওই সময় (তিন মাস আগে) দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাকে (জাহাঙ্গীর) দল থেকে বহিষ্কার করার জন্য কেন্দ্রে চিঠি পাঠিয়েছিলেন দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক। কয়েক মাস আগে ওই থানার সম্মেলন করে কমিটি দেওয়া হয়। অথচ রাতারাতি এই সাংসদ ও উপজেলা চেয়ারম্যান শাহেনশাহ এক হয়ে যুবলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যানকে সুপারিশ করে জাহাঙ্গীরকে আহ্বায়ক করেন। এখন সেই জাহাঙ্গীরই তার জন্য ‘গোদের ওপর বিষ ফোরা’ হয়ে দাড়িয়েছে।

যাইহোক, বিষয়টি তখন কেন্দ্রীয় যুবলীগ আমলে নেননি। সেই জাহাঙ্গীর আলম ও আসাদুল ইসলামকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু ঘটনা ঘটার পর। এক্ষেত্রে যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটিকে আরও আগেই তৎপর হওয়া উচিত ছিল। এছাড়া সারাদেশে যুবলীগের যে কমিটি রয়েছে তা নিয়ে অনেক বদনাম আছে। যুবলীগের বর্তমান দায়িত্বে আছেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ মনিরই বড় ছেলে। ফলে তার উচিৎ দেশব্যাপী যুবলীগে একটি শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা। যে সকল জামায়াত শিবির এবং বিএনপি কর্মী ও সন্ত্রাসী সংগঠনটিতে ভীড়েছে তাদের সমুলে উৎপাটন করা। যুবলীগের একটি ঐতিহ্য ও ভাবর্মূতি রয়েছে। সেটিকে আবার দ্রুত পুনরুদ্ধার করা।

সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে এসেছে, ঘোড়াঘাট অঞ্চলে খাস জমি দখলের কর্মযজ্ঞও চলে। যে ক্ষমতাবান হয়, পেশিশক্তি বেশি যার সে-ই ওইসব জমি দখলে নিতে চায়। উপজেলার কলোনিপাড়ায় বিশাল অংশের খাস জমি দখলে নিতে চেয়েছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান ও ঘোড়াঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানম নিয়মকানুন দেখিয়ে কিছুটা আপত্তি তোলেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে অনেক সময় ইউএনওর সঙ্গে মতের অমিল ঘটে তার। তা ভালোভাবে নিতেন না তিনি। এলাকাবাসীর ধারণা, এটাও কারণ হতে পারে হামলার।

তবে উদ্দেশ্য যে চুরি ছিল না হামলাকারীদের তা স্পষ্ট। ধরা পড়ার পর চুরির দিকে নিয়ে ঘটনা হালকা করতে চাইছে মূল পরিকল্পনাকারীরা। এর পেছনে পৌর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতার নামও এসেছে। কারণ স্থানীয় কৃষক দলের সভাপতি থেকে তাকে ২০১৯ সালে ঘোড়াঘাট পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি বানানো হয় তদবির করে।

ফলে ইউএনওর বাসায় গভীর রাতে হামলা যে পরিকল্পিতভাবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ওয়াহিদা খানমের উপর হামলা কোনো চুরির ঘটনা নয় বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ এমনটাই দাবি করেন। তিনি বলেছেন, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল বেআইনী তদবিরে ব্যর্থ হয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। কোন কোন মহল মহল ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে ‘বিছিন্ন ও চুরির ঘটনা’বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। ওয়াহিদা খানম একজন সৎ, নির্লোভ ও নির্ভীক কর্মকর্তা। তিনি কোনো দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন না। এজন্য তিনি হামলার শিকার হয়েছেন বলে মনে করছে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।

এই হামলার ঘটনায় কোন না কোনভাবেই ঘোড়াঘাট আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের প্রভাশালী নেতৃবৃন্দ জড়িত রয়েছে। ঘটনা সম্পর্কে জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও তদন্ত করা হচ্ছে। কেন্দ্রের নির্দেশে তারা এই তদন্ত করছে। তদন্ত শেষে জেলা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে তাদের রিপোর্ট জমা দেব।

ফলে সত্যিকার তদন্ত হলে উপজেলায় ক্ষমতাসীন দলের কোন সংগঠনের কারা জাড়িত তা বেরিয়ে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। আবার সরকারের তরফ থেকে রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) জাকির হোসেরে নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটিও তদন্ত করছে। এছাড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকেও সাত সদস্যের একটি কমিটি তদন্ত করছে।

আরও একটি ব্যাপার স্থানীয় সাংবাদিকের রিপোর্টে উঠে এসেছে, তা হলো ঘোড়াঘাট থানার ওসির ভূমিকা। ইতোপূর্বে ওই ওসি অপর একটি থানায় কর্মরত ছিলেন সেখানেও ইউএনওর ওপর হামলা হয়েছিল। যদিও ঘোড়াঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) আমিরুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাকে সেখান থেকে ক্লোজড করে রংপুর পুলিশ লাইনে আনা হয়েছে।

আমরা ইদানিং দেখছি, এক শ্রেণীর পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের সখ্যতা বাড়ছে। শহর এলাকায় হোক, আর গ্রাম এলাকায় হোক তাদের প্রশ্রয়েই বর্তমান সরকারের নামধারী সন্ত্রাসীরা একের পর অপরাধ করে যাচ্ছে। এর সত্যতার বিষয়টিও তদন্তে উঠে আসা দরকার।

এসব তদন্তে সঠিক চিত্রই বেরিয়ে আসবে বলে আমরা আশা করছি। দেশের স্বার্থে, একটি শক্তিশালী প্রশাসনের স্বার্থে এটি খুবই জরিুরি। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পরিস্কার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে আমি মনে করি। গত ৯ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে যে বক্তব্য দিয়েছেন তারপর আর কোন সংশয় থাকতে পারে না।

সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার পেছনের কারণ উদঘাটনের পাশাপাশি হামলায় মদদদাতাদেরও খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিতের আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অপরাধীরা কেউ ছাড় পাবে না। অপরাধী আমার চোখে অপরাধীই। সে কোন দলের কে বা কি সেটা আমি কিন্তু বিচার করি না। অপরাধী যদি আমার দলেরও লোক হয়, সমর্থক হয় তাকেরও আমি ছাড়ি না, ছাড়ব না- এটাই হল আমার নীতি। অপরাধীরা ঠিকই শাস্তি পাবে। মাঠ প্রশাসনের যারা এত আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছে তাদেরকে এইভাবে আঘাত করে এটা তো কখনও গ্রহণযোগ্য না।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ইতোমধ্যে ইউএনও’র ওপর হামলার ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের গ্রেফতার করা হয়েছে, গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং বিষয়টা কি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শুধু চুরি না এর সঙ্গে আরও কী কী ঘটনা থাকতে পারে সেগুলোও যথাযথভাবে দেখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে তিনি সংসদ সদস্যদেরও সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এসব ব্যাপারে এমপিরা যেন অপরাধীদের রক্ষার চেষ্টা না করেন। কারণ অপরাধ যে করে আর যারা প্রশ্রয় দেয়- তারা সমান অপরাধী।

এখন সময়ের সাথে সাথে মাঠ প্রশাসনের কাজের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়েছে। এখন সন্ত্রাসের প্রেক্ষাপট সারা পৃথিবীতেই ব্যাপকভাবে পরিবর্তন হয়েছে। এটার প্রতিফলন আমাদের সমাজেও ঘটেছে। সরকারের বিভিন্ন আদেশ নির্দেশ পালন করতে গিয়ে মোবাইল কোর্ট করা এবং এলাকায় যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বা বালুমহাল, জলমহালসহ সরকারি জায়গা যারা অবৈধভাবে দখল করে থাকে, এদের বিরুদ্ধে মাঠ প্রশাসন আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এসব বিভিন্ন কারণে ইউএনওর অফিস বা গাড়ি ভাঙচুর করা, ইউএনওর সাথে রাগারাগি করা বা গালাগালি করা বা অফিসে হামলা করা- বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে এসব হচ্ছে।

২০১৮ সালে জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে ইউএনওদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও এসেছিল এবং প্রধানমন্ত্রীও ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি এতদিন কার্যকর হয়নি। অবশ্য ওয়াহিদার ওপর হামলার পর সরকার তরিৎ দেশের সব উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা বা ইউএনওদের বাসভবনে আনসার ব্যাটালিয়নের পাঁচজন করে সদস্য দিয়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিচ্ছে। এখন পুরো কমপ্লেক্সই নিরাপত্তার আওতায় নিয়ে আসা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

রাজনীতির যে পরিকল্পিত দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে, যেভাবে চিহ্নিত সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতকারীরা দলে দলে দলের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে, তাতে এ কথা আর বলা চলে না যে, সন্ত্রাসীর কোনো দল নাই। বরং কী করে তারা দলে ঢুকল, কাদের প্রশ্রয়ে তারা দুর্বীনিত ও বেপরোয়া হয়ে উঠল সেটি বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নেয়াটাই এখন বেশি জরুরি। আওয়ামী লীগ পরপর টানা তিন মেয়াদে এখন ক্ষমতায়। নিজের ত্যাগী কর্মীরাই আফসোস করে যে, তারা বঞ্চিত, বরং অন্য দল থেকে অনেক দুর্বৃত্ত দলে ঢুকে দল ও দেশের ক্ষতি করছে। এই অভিযোগটি গুরুতর। দুষ্কৃতকারীরা অনেকেই কেবল তাদের ছত্রটি পরিবর্তন করে শাসক দলে ঢুকেছে, কিন্তু তাদের মূল রাজনীতির রীতি অপরিবর্তিত রেখে অপকর্ম করে চলেছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা অনেক সময়ই এদের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না। পরিবর্তনের দায়িত্ব নেতৃত্বকে নিতে হবে। দলীয় নেতৃত্বকে এই দুর্বৃত্তায়নের প্রক্রিয়ায় ছেদ টানতে হলে আগে দুর্বৃত্তায়নের সংস্কৃতি থেকে দলকে টেনে বের করে আনতে হবে। কাজটি দুরূহ। রাতারাতি সম্ভবও নয়। কিন্তু দুর্বত্তায়নের এই বর্বরতাকে থামাতেই হবে।

নিরাপত্তা ঝুঁকির পেছনে অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের প্রশ্রয় দেয়ার প্রায়শই অভিযোগ ওঠে। আসলে নিরাপত্তার ঝুঁকি যারা তৈরি করে, তারা অনেকে রাজনীতিকে ব্যবহার করে। কিন্তু রাজনীতি তাদের উদ্দেশ্য নয়, তারা রাজনীতিকে ব্যবহার করে। যাতে এই অবৈধ কাজগুলো তারা নির্বিঘ্নে করতে পারে, তখন তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যানারে সামনে চলে আসে। তারা সন্ত্রাসী হোক বা চর দখলকারি হোক- তারা রাজনৈতিক ব্যানারেই কাজগুলো করতে থাকে। আবার সরকার যখন ব্যবস্থা নেয় তখন সন্ত্রাসী কোন দলের তা বিবেচনা করেন না। এটাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পরিচালনার বৈশিষ্ট।

সর্বপরি, ওয়াহিদা হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দৃষ্ঠান্তমুলক শাস্তি হওয়া দরকার শুধু দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলাই নয়, নারীর ক্ষমতায়নের পথকে সুগম করার জন্যও। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মুখোশধানীরা এখনও চায় না এদেশে নারীর ক্ষমতায় বাড়ুক, নারীদের মেধা কাজে লাগুক এদেশে উন্নয়নে। কিন্তু সকল বাধা উপেক্ষা করে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারীদের নিয়ে আসছেন সরকারি কর্মকান্ডের মুল ধারায়। সরকার পারিচালায় কাজে লাগাতে চাইছেন নারীদের মেধা এবং দক্ষতাকেও। তারই বদৌলতে এখন দেশের ৪৯২টি উপজেলায় ৪৪৫ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মধ্যে ১৪০ জনের মতোও রয়েছেন নারী। জেলা প্রশাসক পদে আছেন আট নারী। আর প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে সচিব পদে আছেন দশ নারী কর্মকর্তা। অথচ ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত প্রশাসন ক্যাডারে নারীদের সুযোগ ছিল না। মেধাসহ সার্বিক যোগ্যতা দিয়ে গত ৩৮ বছরে সেই চিত্র আমূল বদলে দিয়েছেন নারী কর্মকর্তারা। শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত তাঁরা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফলে সরাকরও আস্থা রাখছেন তাদের ওপর। এতে তৃণমূলে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র উপজেলায় শীর্ষ পদে নারী কর্মকর্তার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। শুধু তাই নয়, দু’এক জায়গায় বিতর্কিত ভূমিকা ছাড়া সার্বিকভাবে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন পরিচালনায় তারা সফলতার পরিচয় দিচ্ছেন। বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছেন সরকারি সম্পদ রক্ষায় ও দক্ষতার সঙ্গে উপজেলা প্রশাসন পরিচালনায়। এই ধারাকে কোনভাবেই ব্যাহত হতে দেয়া যাবে না।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :