লালি, কালি, সুন্দরীরা কি সত্যিই বেওয়ারিশ?

রাশেদ বাপ্পী
 | প্রকাশিত : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৯:৫২

বিশ্ব এখন অনেক আধুনিক। মানুষসহ যেকোনো প্রাণীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ মামুলি ব্যাপার। অথচ দীর্ঘ চার বছর ধরে কুকুরের জন্ম নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া বন্ধ রেখেছে খোদ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এখন আবার তারাই বলছে, 'বেড়ে গেছে কুকুরের সংখ্যা।' তাহলে এই দায়ভার কার? কেনই বা কর্তৃপক্ষের অবহলোর খেসারত দিতে হবে অবলা কুকুরগুলোকে।

১৪ সেপ্টেম্বর, সোমবার। বেলা সাড়ে এগারোটা (আনুমানিক)। নিয়মিত অ্যাসাইনমেন্টের ফাঁকে টিএসসি এলাকায় যাই শুধু 'কৌতূহলের বসে'। হুট করেই কয়েকজন মানুষের তৎপরতা চোখে পড়ে। যাদের কারো হাতে জালের তৈরি ফাঁদ। কারো হাতে ওষুধ ও ইনজেকশন। এসব সামগ্রীর মাধ্যমে তাদের সবাই ব্যস্ত কুকুর ধরায়। প্রথম দেখায় মনে হয় কুকুর ধরার কারণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া কিংবা জলাতঙ্কের টিকা প্রয়োগ। কিন্তু যখনই দেখলাম অচেতন কুকুরগুলো অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে ছুড়ে মারা হচ্ছে লোহার তৈরি পিকআপ ভ্যানে তখন আর আর চুপ থাকা যায় না। ক্যামেরা বের করে ছবি নিতে শুরু করায় বন্ধ হয় অমানবিক কায়দায় কুকুর ছুড়ে মারা।

ছবি নিতে নিতেই কথা হয় দক্ষিণ সিটি থেকে আসা কর্মীদের সঙ্গে। জানান, কুকুরগুলোকে অচেতন করে ফেলে আসা হবে মাতুয়াইলের ময়লার ভাগাড়ে। অথচ কয়েকদিন আগে এমন সিদ্ধান্ত উঠার পর প্রাণীপ্রেমিদের প্রতিবাদে অবস্থান পরিবর্তন করে নগর কর্তৃপক্ষ। যৌক্তিক সমাধানে চলছিল সংশ্লিষ্ট প্রাণীপ্রেমি সংগঠনগুলোর সঙ্গে কর্তৃপক্ষের আলোচনা। তবে কেন হুট করে দিনেদুপুরে এমন কার্যক্রম?

কুকুরগুলোকে ভ্যাকসিন প্রয়োগের প্রক্রিয়া দেখলেই গা শিঠবে যে কারো। ওষুধের ডোজ কিংবা কোনো বিধি না মেনেই যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই প্রয়োগ করা হচ্ছিল ওষুধ। এমনকি ইনজেকশনের বেকে যাওয়া সুঁই যাচ্ছে তাই ভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয় অবলা প্রাণীগুলোর দেহে। কোথায় হাড়, কোথায় নরম মাংস সেসবে কোনো খেয়াল নেই তাদের। কুকুর ধরার এই টিমে কোনো প্রাণী চিকিৎসক আছেন কি না এমন প্রশ্ন করতেই উত্তর আসলো, ‘আমরা সিটি করপোরেশনের কর্মী।’ আরও কিছু জানতে চাওয়ার আগেই সদলবলে এলাকা ছাড়ে কুকুর ধরতে আসা ব্যক্তিরা। ততক্ষণে ৭/৮টি কুকুর অচেতন করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যান তারা।

এবার উত্তর খোঁজা যাক কার স্বার্থ রক্ষায় এমন অমানবিক আচরণ? কুকুর অপসারণের এই প্রক্রিয়াকে সাময়িক বলছে দক্ষিণ সিটি। তাদের বক্তব্য, মাঝে মাঝে কিছু এলাকা থেকে কুকুর নিয়ে অভিযোগ আসে। এসবের ভিত্তিতেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কুকুর সরানো হয়। তবে এবারই প্রথম মাতুয়াইলে ময়লার ভাগাড়ে ফেলা হলো কুকুর। কথাগুলো বলছিলেন দক্ষিণ সিটির ভেটেরিনারি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম। তবে এভাবে কুকুর অপসারণ যে বেআইনী সে বিষয়টি জানা আছে তারও। তবে তার বক্তব্য, সিটি মেয়রের নির্দেশেই কিছু কুকুর অপসারণ করা হচ্ছে, কিন্তু এই প্রক্রিয়ার সাথে একমত নন তিনিও। তিনি মনে করেন, বন্ধ্যাত্বকরণই একমাত্র উপায় কুকুর নিয়ন্ত্রণের। তবে এই প্রক্রিয়া বন্ধ দীর্ঘ চার বছর ধরে। অনেক বলার পরও বন্ধ্যাত্বকরণ প্রজেক্ট চালু করা যায়নি জানিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি নিজেই।

সড়কে থাকা অধিকাংশ কুকুরই নিজের খাবারের সংস্থান নিজেই করে একথা ঠিক। তবে এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়, যারা প্রতিদিন নিজ হাতে রান্না করে কুকুরের খাবার। আবার অনেকে বিভিন্ন বাসাবাড়ি কিংবা ক্যান্টিনের উচ্ছিষ্ট খাবার সংগ্রহ করে কুকুরকে দিয়ে থাকনে। করোনাকালে কিছু প্রাণবিক মানুষকে আমারা দেখেছি যারা, জনমানবশূন্য শহরে খাবারের অভাবে মরতে বসা কুকুরের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

শেষ করার আগে ফিরতে চাই লেখাটির শিরোনাম প্রসঙ্গে। ধরুন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কারো চিৎকার শুনতে পেলেন, 'ফেইসবুক', 'ফেইসবুক'। থেমে গিয়ে পেছনে ফিরতেই দেখলেন কোনো একটা কুকুর আদুরে ভঙ্গিমায় চিৎকার করা ব্যক্তিটির পায়ে ছুটে এসে লুটোপুটি খাচ্ছে। হ্যাঁ, ওই কুকুরটির নামই ফেইসবুক। আপনার আমার মতো কিছু প্রাণবিক মানুষেরাই সড়কের কুকুরগুলোকে আদর করে। খাবার দেয়। আবার নামও রাখে। এদের কারো কারো নাম, লালি, কালি, সুন্দরী কিংবা ফেইসবুক। বিশেষ নাম ধরে ডাকলে প্রত্যেকে সাড়া দেয়। কাছেও ছুটে আসে। তবে প্রশ্ন আসা কি স্বাভাবিক নয়, লালি, কালি, সুন্দরীরা কি সত্যিই বেওয়ারিশ?

লেখক: সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মুক্তমত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা