আজ মহালয়া এবং দুর্গাপূজার ক্ষণগণনা শুরু

সুব্রত বিশ্বাস (শুভ্র)
| আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:০৩ | প্রকাশিত : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:০০

মা দুর্গা যখন আমাদের মাঝে আসেন, প্রকৃতিই সবার আগে স্বাগত জানায়। আকাশে তুলো মেঘের রাশি, কাশফুল আর শিউলি ফুলের সমাহারে মা আসেন আমাদের কাছে শরতের আশ্বিন মাসে। তবে এ বছর আর সেটা হবে না। মা আসবেন শরতের আশ্বিনের বদলে হেমন্তের কার্তিক মাসে, যা কি না শারদোৎসবের ইতিহাসে একটু অন্য রকম।

এমনিতে মহালয়ার ছয়দিন পরেই শুরু হয় দেবীর বোধন। সেইভাবেই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূজার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু এ বছর মহালয়ার ৩৫ দিন পর দুর্গাপূজা। মহালয়া ১৭ সেপ্টেম্বর আর দেবীর বোধন অর্থাৎ মহাষষ্ঠী ২২ অক্টোবর। পুরোহিতদের মতে, দু-দুটি অমাবস্যা একই মাসে হলে সে মাস মলমাস হিসেবে গণ্য হয়। আর মলমাসে কোনো শুভ কাজ হয় না। সে হিসেবে ১৪২৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাস মলমাস। কারণ, এ মাসে দুটি অমাবস্যা পড়েছে। তাই পূজা হবে আশ্বিন নয় কার্তিক মাসে। শারদীয় উৎসবও তাই হবে হেমন্তিকা উৎসব অর্থাৎ হেমন্তে। একবিংশ শতাব্দীতে দ্বিতীয়বার এমন ঘটনা ঘটেছে। শেষবার এমন ঘটনা ঘটেছিল ২০০১ সালে। এর আগে ১৯৮২ সালেও এমন বিভ্রাট ঘটেছিল।

সাধারণভাবে মহামায়া মানে দুর্গাপূজার দিন গোনা, মহালয়ার ৬ দিন পর মহাসপ্তমী, দেবীকে আমন্ত্রণ জানানো ইত্যাদি। কিন্তু মহালয়ার তার চেয়ে বড় গুরুত্ব আছে। সেটা এখন আলোচনা করব।

মহালয়া মানে পিতৃপক্ষের শেষ আর দেবীপক্ষের শুরু। পিতৃপক্ষ হলো পূর্বপুরুষদের তর্পাদির জন্য প্রশস্ত এক বিশেষ পক্ষ। হিন্দু পুরাণ মতে, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই লোক স্বর্গ ও মর্ত্যরে মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পিতৃলোকের শাসক মৃত্যুদেবতা যম। তিনি সদ্য মৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং পরমাত্মায় লীন হন। এই প্রক্রিয়ায় তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ঊর্ধ্বে উঠে যান। এ কারণে কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে। ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবীকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য। আসল দুর্গাপূজা হলো বসন্তে। সেটাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়। শ্রীরামচন্দ্র অকালে-অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে এই শরতের পূজাকে দেবীর অকাল-বোধন বলা হয়। সনাতন ধর্মে কোনো শুভ কাজ করতে গেলে সমগ্র জীব জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়। কার্যাদি অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। তর্পণ মানে খুশি করা।

শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কা বিজয়ের আগে এদিনে এমন করেছিলেন। সেই অনুসারে এই মহালয় তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করেন। পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন। সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মর্তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাকে মহালয় বলা হয়। এই মহালয় থেকে মহালয়া। পিতৃপক্ষেরও এটি শেষ দিন।

সনাতন ধর্ম অনুসারে বছরে একবার পিতা-মাতার উদ্দেশে পি- দান করতে হয়, সেই তিথিতে করতে হয় যে তিথিতে তাঁরা প্রয়াত হয়েছেন। মহালয়াতে যারা গঙ্গায় অঞ্জলি প্রদান করেন পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তির জন্য, তারা শুধু পূর্বপুরুষদের নয় সৃষ্টির সমগ্র কিছুর জন্য প্রার্থনা ও অঞ্জলি প্রদান করেন।

পৌরাণিক মতে, মহাভারতের মহাযুদ্ধে কর্ণ মারা যাওয়ার পর তাকে খাদ্য হিসেবে সোনার অলংকার দেওয়া হয়। বিস্মিত, বিমূঢ় কর্ণ এর কারণ জানতে চান মহারাজ ইন্দ্রের কাছে। ইন্দ্র তখন তাকে জানান যে, কর্ণ তার জীবদ্দশায় কখনো পূর্বপুরুষদের খাবার এবং জল অর্পণ করেননি। বরং তার দানের বিষয় ছিল শুধুই সোনা। আর সেই কর্মফলেই তার এই দশা। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে যে খাবার ও জল অর্পণ করতে হয় তা কর্ণ জানতেন না বলে তাকে ১৬ দিনের জন্য পৃথিবীতে ফিরে আসতে সুযোগ দেওয়া হয়। যাতে তিনি পিতৃপুরুষদের জল এবং খাবার অর্পণ করতে পারেন। এই সময়কালই পিতৃপক্ষ হিসেবে পরিচিত হয়। মহালয়া পক্ষের পনেরোটি তিথির নাম হলো প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও অমাবস্যা। এই জন্য মহালয়া মানেই আর ৬ দিনের প্রতীক্ষা মায়ের পূজা শুরু হওয়ার। এই দিনেই দেবীর চক্ষুদান করা হয়। মাহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গা সমস্ত অশুভ শক্তি বিনাশের প্রতীক রূপে পূজিত। মহামায়া অসীম শক্তির উৎস। পুরাণ মতে, মহালয়ার দিনে দেবী দুর্গা মাহিষাসুর বধের দায়িত্ব পান। ব্রহ্মার বর অনুযায়ী কোনো মানুষ বা দেবতা কখনো মাহিষাসুরকে হত্যা করতে পারবে না। ফলত অসীম ক্ষমতাশালী মাহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেন এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর হতে চান। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব ত্রয়ী সম্মিলিতভাবে ‘মহামায়া’ এর রূপে অমোঘ নারী শক্তি সৃষ্টি করলেন এবং দেবতাদের দশটি অস্ত্রে সুসজ্জিত করলেন দেবী দুর্গাকে। দেবী দুর্গা ৯ দিনব্যাপী যুদ্ধে মহিষাসুরকে পরাজিত ও হত্যা করলেন।

লেখক : কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :