সালমান-ট্রাম্পের স্বার্থের কাছে বলি ফিলিস্তিনিদের অধিকার

প্রকাশ | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৭:৫০ | আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৮:৪২

এনএইচ সাজ্জাদ

কিছুদিন আগেও ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে অবস্থান ছিল তার। এজন্য কান্নারত কণ্ঠে সৃষ্টিকর্তার কাছে বহুবার প্রার্থনা করেছেন যাতে ‘ইহুদিদের আগ্রাসনের’ হাত থেকে ফিলিস্তিনিদের মুক্তি হয়। জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদকে পৃথিবীর তৃতীয় পবিত্র স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও তার ব্যাকুলতা ছিল চোখে পড়ার মতো।

বলছি মক্কার ঐতিহাসিক আল হারাম মসজিদের পেশ ইমাম আবদুল্লাহ আল সৌদস এর কথা। যিনি সবসময় ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিয়ে সচেতন ছিলেন।

সেই বিখ্যাত ইমামই দেশটির সমালোচিত যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বার্থে এখন ভোল পাল্টেছেন। যুগের পর যুগ ধরে নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের অধিকারের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে ‘ইহুদিদের বন্ধু’ হিসেবে গ্রহণ করতে অনুরোধ জানিয়েছেন বিশ্ব মুসলিমকে।

গেল ৫ সেপ্টেম্বর সৌদি টেলিভিশনে এক বয়ানে তিনি সমগ্র বিশ্বের মুসলিমকে ইহুদিদের বিষয়ে ‘অতি আবেগ’কে পরিত্যাগ করতে তাগাদা দিয়েছেন। প্রিয়নবী মোহাম্মদের উদাহরণ টেনে তিনি বলেছেন, ‘নবী মোহাম্মদ তার ইহুদি প্রতিবেশীদের প্রতি সদয় ছিলেন এবং সবসময় চেষ্টা করতেন কীভাবে তাদের ইসলাম ধর্মের দীক্ষায় দীক্ষিত করা যায়। তাই আমাদেরও উচিত তাদের (ইহুদি) সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা।’

ওই বয়ানে তিনি বাহরাইন ও আরব আমিরাতের সঙ্গে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিকরণের চুক্তির পক্ষে সায় দিয়েছেন। যা সমালোচিত হচ্ছে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে। রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘এই বয়ানের মাধ্যমে সৌদি সরকার জনগণকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণে উৎসাহিত করেছে।’   

এক্সটার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্ট্যাডিজ বিভাগের শিক্ষক মার্ক ওয়েন জনস বলেছেন, ‘তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে সৌদি সরকার আদতে ইসরায়েল সম্পর্কে জনগণের মতামত পরীক্ষা করেছে।’

প্রিন্স সালমানের দ্বারা নিযুক্ত এই ইমাম বেমালুম ভুলে গেছেন ২০০২ সালে আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে করা ইসরায়েলের চুক্তির কথা। যেখানে বলা হয়েছিল, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে আরবদের থেকে দখল করে নেয়া ভূমি ফেরত না দেয়া পর্যন্ত ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হবে না। কিন্তু কোনো কিছুই মানা হয়নি।

এমনকি গেল ১৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বাহরাইন-আরব আমিরাত ও ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ছিলেন না ফিলিস্তিনের কোনো প্রতিনিধি। রিয়্যালিটি শো’র মতো এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ট্রাম্প নিজেকে ‘শান্তির দূত’ হিসেবে ‍নিজেকে জাহির করতে চেয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিজের ইমেজকে শক্তিশালী করতে তার এই নতুন ছলনা। তিনি দেশটির সাবেক রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামাকে ছাপিয়ে যেতে চান। হতে চান আবারও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি।

তাই এই চুক্তি আদতে কতটুকু শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সেটা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ এই চুক্তি আরবদের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কের নৈতিক, আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে চূর্ণবিচূর্ণ করেছে। চুক্তি সইয়ের দিনই ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জঙ্গিবিমান ও হেলিকপ্টার নিয়ে গাজার বেইত লাহিয়া এলাকায় হামাসের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বোমা হামলা চালায়। তবে যুবরাজ সালমানের স্বার্থের কারণে দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের সমালোচনা করা আরব লীগও নিশ্চুপ।

দিনশেষে, যুবরাজ সালমান বিন আবদুল আজিজের খুনের দায়মুক্তির পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নোবেল প্রাপ্তি ও যুক্তরাষ্ট্রে পুনঃনির্বাচিত হওয়ার বাসনার কাছে পরাজিত হয়েছে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার।

এদিকে, ডেমোক্র্যাট মনোনীত প্রার্থী জো বাইডেন ক্ষমতায় এলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরান এবং কাতারের মধ্যকার সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে। এই ভয়েই আরব দেশগুলো ও ইসরায়েল তড়িগড়ি করে চুক্তি স্বাক্ষরের টেবিলে বসেছে। কারণ এই ট্রাম্পই আরব দেশগুলোকে বিভিন্নভাবে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করেছে এবং কাতারকে একঘরে করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তাই তাদের লক্ষ্য ট্রাম্পকে আবারও ক্ষমতার মসনদে বসানো।

অন্যদিকে সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যার পর রাজনৈতিক চাপে আছে সৌদি সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া তথ্য অনুযায়ী খাসোগিকে খুনের নির্দেশ দেন সৌদি এই যুবরাজ। সাংবাদিক বব উডওয়ার্ডের লেখা ‘রেইজ’ নামে প্রকাশিত বইয়ে ট্রাম্প নিজেও বলেছেন ‘খাসোগি হত্যার ঘটনায় তিনিই সালমানকে রক্ষা করেছেন।’ 

আর এই কারণেই ট্রাম্পের কাছে মাথা নত সৌদি সরকারের। কিন্তু এই মুহূর্তে সৌদির সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ সম্ভব নয়। ফলে সৌদির বলয়ে থাকা বাহরাইনকে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তির টেবিলে বসিয়েছে সৌদি আরব।

তবে খুবই শিগগির তারাও বসতে যাচ্ছে ইসরায়েলের সাথে চুক্তি সইয়ের টেবিলে। ইতিমধ্যে ইসরায়েলি বিমান চলাচলের জন্য নিজেদের আকাশসীমা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন সৌদি সরকার। গেল মঙ্গলবার ট্রাম্প নিজেও বলেছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের ধারাবাহিকতায় সৌদি আরবও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে নাকি সৌদি বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজের সঙ্গেও কথা হয়েছে ট্রাম্পের।

এর আগে যুবরাজ সালমান নিজেও প্রতিজ্ঞা করেছেন যে, দেশ সংস্কারের জন্য তিনি আন্তঃবিশ্বাসীয় একটি আলোচনার আয়োজন করেবেন। বলেছেন, ‘নিজেদের জমি’তে ইহুদিদের শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের অধিকার আছে।

ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর এই বিশ্বাসঘাতকতা ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার আদায়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অখণ্ড আরব রাষ্ট্র গঠনের যে স্বপ্ন তারা এতদিন দেখে এসেছে তা অধরাই থেকে গেল।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।